Advertisment

কলকাতার কৈলাস: ভূকৈলাস  

১৭৮২ সালে জয়নারায়ণ ঘোষাল দিল্লির বাদশা মহম্মদ জাহান্দার শাহের কাছ থেকে মহারাজা বাহাদুর খেতাব পান। সে বছরেই বিশাল রাজপ্রাসাদের মধ্যে নির্মিত হয় কুলদেবী মা পতিতপাবনী দুর্গার মন্দির।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Bhu Kailash Temple Nandi the Bull

ভূকৈলাস মন্দির চত্বরে নন্দী

খিদিরপুর অঞ্চলের ঘিঞ্জি রাস্তা। ডক, ট্রামডিপো, ফ্যান্সিমার্কেট – সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার। কার্ল মার্কস সরণি থেকে গঙ্গার ঠিক উল্টোমুখে চলে গেছে ভূকৈলাস রোড। রাস্তা শুরুর মুখে প্রায় নতুন তৈরি হওয়া এক তোরণ। তারপর সে পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে নহবতখানা পার হয়ে এক বিশাল পুষ্করিণীর দিকে। তার চারপাশ জুড়ে পড়ে আছে ভূকৈলাস রাজবাড়ির একাংশ। কয়েকটি সুউচ্চ স্তম্ভ, বটের ঝুরি নামা বসবাসের অযোগ্য কিছুটা, কিছুটা আবার কোনো সচ্ছল শরিকের ভাগে, ফলে রঙের কলি ফেরানো। পুষ্করিণী সংস্কার করা হয়েছে, এর নাম শিবগঙ্গা। রয়েছে দুটি বিশালাকার শিবলিঙ্গ সম্বলিত মুখোমুখি দুই শিব মন্দির, একটি রক্তকমলেশ্বর, একটি কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর। পুষ্করিণীর অপর পারে জয় নারায়ণ মন্দির, তাতে রাজা জয় নারায়ণ ঘোষালের মূর্তি। রাজবাড়ির একাংশে ভূকৈলাস বংশের কুলদেবী পতিতপাবনী দশভুজার মন্দির। আর এখন সবটা ঘিরে দুশো বিঘে জমি দখল করে গ্যারাজ, বস্তি, একের পর এক কুৎসিতদর্শন ফ্ল্যাটবাড়ি যাদের অধিকাংশই অবৈধ নির্মাণের ফসল ।

Advertisment

সপ্তদশ শতাব্দী, যখন নবাবি আমল প্রায় শেষ, ইংরেজরা ভার নিচ্ছে ভারতবর্ষের, তখনই কলকাতায় তৈরি হয়েছে বেশ কিছু রাজবাড়ি। আসলে এঁরা সবাই জমিদার বা উপাধিপ্রাপ্ত রাজা। সেসব রাজবাড়ির বেশ কিছু এখনো টিকে আছে শহরের বুকে, কোনোটি ক্ষয়িষ্ণু আবার কোনোটি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কলকাতার রাজবাড়িদের সেই তালিকায় ভূকৈলাসও একটি নাম, কিন্তু তাকে সহজে মনে করে না কেউ। অথচ এই রাজবাড়ি, সংলগ্ন পুকুর, মন্দির ইত্যাদি ১৯৯৬ সাল থেকেই কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন কতৃক হেরিটেজ তালিকাভুক্ত।

Raktakamaleshwar রক্তকমলেশ্বর

এই রাজপরিবারের ইতিহাস প্রাচীন। প্রায় হাজার বছর আগের কথা। পাল যুগের শেষ, বৌদ্ধ ধর্মও তার কৌলীন্য হারিয়েছে। শুরু হয়েছে সেন বংশ। তাঁরা হিন্দু ধর্ম পুনরুদ্ধারের জন্য বেশ সক্রিয়। সে আমলে কনৌজ অর্থাৎ কান্য়কুব্জ থেকে একদল ব্রাহ্মণ এদেশে এলেন। তাঁদের অন্যতম ভূকৈলাশের ঘোষালরা। ঘোষাল বংশের আদি পুরুষ কন্দর্প ঘোষাল থাকতেন গোবিন্দপুর অঞ্চলে। তখনও কলকাতার পত্তন হয়নি। তাঁর ছেলে গোকুল চাঁদ ঘোষাল নুনের ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন এবং ইংরেজদের সুনজরে আসেন। ইংরেজরা তাঁকে চিটাগং বা চট্টগ্রাম (অধুনা বাংলাদেশ)-এর দেওয়ান নিযুক্ত করেন। সময়টা ১৭৬১ থেকে ১৭৬৪। একাজে অচিরেই গোকুল চাঁদ সুনাম ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। জমির কর দেওয়ার পদ্ধতিতে কিছু বদল আনেন। খিদিরপুর অঞ্চলে তিনি নিজে প্রচুর ভূসম্পত্তি কেনেন। তাঁর ভাই কৃষ্ণচন্দ্রের ছেলে জয়নারায়ণ ঘোষাল (১৭৫২ – ১৮২১) ঘোষাল বংশের আরো উন্নতি ঘটালেন। সে সময় তাঁদের বসবাস ছিল ফোর্ট উইলিয়াম অঞ্চলে। তখন (১৭৫৮ সাল) সবে সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট বানাতে শুরু করেছে। তাঁদের অনুরোধে জয়নারায়ণ ঘোষাল সে অঞ্চল ছেড়ে খিদিরপুরে চলে আসেন। তৈরি করলেন বসতবাড়ি।

আরও পড়ুন, কলকাতায় মহীশূরের বাঘ

দুশো বিঘে জমি জুড়ে গড়ে উঠল রাজাবাহাদুর জয়নারায়ণ ঘোষালের রাজপাট। প্রতিষ্ঠা করলেন মন্দির, পুষ্করিণী, পতিতপাবনী দুর্গার অষ্টধাতু নির্মিত ঘোটকাকৃতি সিংহারূঢ়া মহিষাসুরমর্দিনী দশভুজা মূর্তি। ১৭৮২ সালের ফাল্গুন মাসে মধু ত্রয়োদশী সংক্রান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হন কুলদেবী। তার আগের বছরেই ১৭৮১ তে শিবগঙ্গার খনন ও শিবমন্দির স্থাপনা। এই দুই যমজ মন্দির মুখোমুখি হলেও লিঙ্গের মুখ কিন্তু পুষ্করিণীর দিকে নয়। বিশাল আটচালা রীতির মন্দির দুটি, কলকাতায় আটচালা মন্দির নির্মাণে ঘোষাল বংশকে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। মন্দির দুটির নাম জয়নারায়ণ ঘোষাল তাঁর মাতা-পিতার নামানুসারে রাখেন। ত্রি-খিলানযুক্ত আটচালা মন্দির দুটির পুব দিকেরটির নাম রাখেন রক্তকমলেশ্বর, এর শিবলিঙ্গের মুখ পশ্চিমদিকে। দ্বিতীয়টির গঠনশৈলীও হুবহু এক। এটির নাম কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর।  ১৮ ফুট উচ্চতার একেকটি করে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ রয়েছে মন্দিরে, যা কিনা একটি মাত্র পাথর কেটে তৈরি শিবলিঙ্গ হিসেবে এশিয়ার মধ্যে উচ্চতম। দুটি মন্দিরের মাঝখানে নন্দী অর্থাৎ শিবের বাহন ষাঁড়ের মূর্তি। প্রচুর সংস্কারের পর মন্দিরগাত্রের কারুকাজ আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবে উঁচু চাতালের ওপর উঠে ভিতরে প্রবেশ করলে দেওয়ালে কিছু পংখের কাজ নজরে আসে। বিশেষত রক্তকমলেশ্বর মন্দিরে। কথিত আছে সাধক রামপ্রসাদ এই মন্দির দেখতে এসে মুগ্ধ হয়ে বলেন কৈলাশ থেকে শিব স্বয়ং নেমে এসেছেন। সেই থেকে জয়নারায়ণ ঘোষালের এই ভূসম্পত্তি ভূকৈলাস নামে খ্যাত হয়।

পুষ্করিণীর অপর প্রান্তে নির্মিত জয়নারায়ণ ঘোষাল স্মৃতি মন্দির, তাতে রাজা জয়নারায়ণের উপবিষ্ট মূর্তির হাতে রুদ্রাক্ষের মালা, পরনে উপবীত,  খড়ম। সংস্কারের পর পুষ্করিণীর চারদিকে ছোট ছোট ছটি মন্দির তৈরি করা হয়েছে। ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিক থেকে ধরলে পরপর গণেশ, রাম-সীতা, হনুমান, সরস্বতী, রাধা-কৃষ্ণ ও দেবী দুর্গা। এই মূর্তিগুলি রাজস্থান থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে।

১৭৮২ সালে জয়নারায়ণ ঘোষাল দিল্লির বাদশা মহম্মদ জাহান্দার শাহের কাছ থেকে মহারাজা বাহাদুর খেতাব পান। সে বছরেই বিশাল রাজপ্রাসাদের মধ্যে নির্মিত হয় কুলদেবী মা পতিতপাবনী দুর্গার মন্দির। গ্রিক, মুসলিম ও হিন্দু স্থাপত্য আঙ্গিকের মিশেলে দালান রীতিতে মন্দিরটি নির্মিত। মন্দিরটির অবস্থান এমন যেন কুলদেবী সরাসরি দেখতে পান পুষ্করিণীর পাশের শিবমন্দির এবং রাজপ্রাসাদ। মন্দিরগাত্রে খোদিত ফলকে নির্মাণের তারিখের উল্লেখ আছে। দুর্গামন্দিরের উঠানের চারদিকে চারটি পৃথক মন্দিরে অবস্থান করছেন মকরবাহিনী গঙ্গা, পঞ্চাননদেব, রাজরাজেশ্বরী এবং মহাকাল ভৈরব। মন্দির চত্বরে নজর কাড়ে দুটি কামান, সিঁড়ির ধাপের অভিনব বিন্যাস। মহারাজা কুলপুরোহিত নিযুক্ত করেছিলেন চণ্ডীচরণ পাঠককে। আজও তাঁর বংশধরেরাই পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন। আজও রাজবাড়ির মাঠে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে এক মাসব্যাপী মেলা বসে। নহবতখানাও মেরামত করা হয়েছে। শুধু রাজবাড়ির ভগ্নদশা। খানিক বেদখল, খানিক ভগ্নপ্রায়, দেওয়াল দখল করেছে বট-অশত্থের ঝুরি। পুরোনো কয়েকটা গোলাকার থাম আকাশপানে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। রাজবাড়ির আস্তাবল পরিণত হয়েছে পার্কিং স্পেসে।

স্থানীয় মানুষ তো বটেই, রাজবাড়ির বর্তমান প্রজন্মও ভুলতে বসেছে প্রাচীন ঐতিহ্যকে। জয়নারায়ণ ঘোষালের অবদান শুধু মন্দির নির্মাণে নয়। ইসলামিক যুগের অন্ধকার কাটিয়ে শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা স্মরণযোগ্য। খ্রিস্টান ধর্মকে তিনি যথেষ্ট সম্মান করতেন। ১৭৮২ সালে সেন্ট জনস চার্চ তৈরির সময় তিনি পাঁচশ টাকা দান করেছিলেন, বাইবেল সোসাইটিকে দিয়েছিলেন একশ টাকা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে জয়নারায়ণ কাশী চলে যান, সম্পত্তি দেখাশোনার ভার তুলে দেন পুত্র কালীশংকর ঘোষালের হাতে। বাবা ও ছেলের যৌথ প্রচেষ্টা ছিল দেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের। মিশনারিদের সাথে মিলে তাঁরা তৈরি করেন স্কুল, যেখানে দেশের ছেলেদের ফার্সী, হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শেখানো হত। এই স্কুলের জন্য জয়নারায়ণ বরাদ্দ করেছিলেন চল্লিশ হাজার টাকা, যার থেকে মাসে দুশো টাকা করে স্কুলের খরচে ব্যয় করা হত। শুধু খিদিরপুরে নয়, বেনারসেও স্থাপন করেছিলেন স্কুল। আজও সেখানকার জয়নারায়ণ কলেজ তাঁর নামের স্মৃতি বহন করছে। খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন জয়নারায়ণ, তাঁর অসুখের সময় এক ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ী জি হুইটলি কিছু খ্রিস্টধর্মীয় তুকতাকে তাঁকে আরোগ্য দিয়েছিল। তবু তিনি আমৃত্যু নিজ ধর্ম ত্যাগ করেননি এবং তাঁর বিশাল ভূসম্পত্তি ইচ্ছাপত্রের মাধ্যমে দান করে যান দেবত্তর সম্পত্তি হিসেবে মা পতিতপাবনী দুর্গার নামে।

মন্দির দেখতে কিছু মানুষ নিয়মিত আসেন ভূকৈলাশে, শিবরাত্রির মেলায় জনসমাগমও হয় উল্লেখযোগ্য। কিন্তু রাজাবাহাদুর জয়নারায়ণ ঘোষাল আর তাঁর জমিদারির ইতিহাস মনে রাখেনি কেউ। শুধু মন্দিরের শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা আছে - ‘মহারাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল বাহাদুর সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা, আরবী, ফার্সি ও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁর সাহিত্যিক অনুরাগ ও কবিত্ব শক্তির জন্য তিনি রাজকবি হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন। তদানীন্তন পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট জন শেক্সপিয়রের সময় তিনি সরকারি সুপারিন্টেডেন্টের পদ গ্রহণ করে শৃংখলার সঙ্গে সুশাসনের প্রবর্তন করেন। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অন্য জ্ঞানী ও  গুণিজনের সঙ্গে নানা হিতকর কাজ করেন।’ তবে এই লেখাটুকুই বা কজনের চোখে পড়ে, কে জানে!

Advertisment