ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বাজেট অধিবেশন শুরু হতে চলেছে। কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বিধানসভায় রাজ্য বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই রাজ্যের কৃষকদের জন্য একটি নতুন জীবন বীমা প্রকল্প সহ বিভিন্ন নতুন প্রকল্পের ঘোষণা করে দিয়েছেন। আসন্ন রাজ্য বাজেটে এই সমস্ত প্রকল্পের বিবরণই থাকবে বলে মনে হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি বাস্তবে ঠিক কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে? এটা দুর্ভাগ্যজনক, যে সারা দেশের অর্থনীতি নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেমন মিথ্যাচার চালাচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তৃনমূল কংগ্রেস সরকারও অপপ্রচার করে যাচ্ছে।
এই তথ্যবিকৃতির সবচেয়ে বড় নিদর্শন ছিল গত বছরের রাজ্য বাজেট, যা অর্থমন্ত্রী ৩১ জানুয়ারি ২০১৮-তে বিধানসভায় পেশ করেন। এক বছর আগের সেই বাজেট বক্তৃতায় রাজ্য সরকারের সাফল্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী একগুচ্ছ আজগুবি দাবি করেন, বিধানসভায় লিখিত আকারে পরিবেশন করেন ভুল তথ্য। এই বছরের বাজেট পেশ হওয়ার প্রাক্কালে এই বিষয়গুলি জনসমক্ষে নিয়ে আসা প্রয়োজন।
মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং রাজস্ব আয়
গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দাবি করেছিলেন যে ২০১৭-১৮ আর্থিক বর্ষে (এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০১৮) পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ছিল ১১.৫ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (সিএসও) জানায় যে এই বৃদ্ধির হার আসলে ছিল ৯.১ শতাংশ। উপরন্তু সিএসও বিগত বছরগুলিতেও পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার রাজ্য সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক কম ছিল বলে জানায়।
সিএসও-র নির্ধারিত অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ তে পশ্চিমবঙ্গের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ৭ লক্ষ ১৮ হাজার কোটি টাকা, যেখানে গোটা দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ১৩০ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা। গত আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি আয়তনে ছিল জাতীয় অর্থনীতির ৫.৫ শতাংশ। অথচ ২০১১-১২ তে রাজ্যের অর্থনীতি ছিল জাতীয় অর্থনীতির ৬ শতাংশ। অর্থাৎ বিগত ছয় বছরের হিসেব ধরলে জাতীয় অর্থনীতির তুলনায় রাজ্যের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কম থেকেছে, যার ফলে জাতীয় উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের অংশ কমে গেছে। অর্থমন্ত্রী কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরতে চাইছেন।
অর্থমন্ত্রী গত বছরের বাজেটে দাবি করেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গ ২০১৭-১৮ তে দেশের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সিএসও-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বিচারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান কিন্তু ষষ্ঠ - মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট এবং কর্ণাটকের পরে। ২০১৬-১৭-তে মাথাপিছু আয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশের ২১টি বড় রাজ্যের মধ্যে ছিল ১৬ নম্বরে।
রাজ্য বাজেটের নথিপত্রে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব আয় ২০১১-১২ তে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ১১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৭-১৮ তে প্রায় ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই হিসেব আরেকটু তলিয়ে দেখলেই পাওয়া যায় যে ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের নিজস্ব রাজস্ব আয় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মোটামুটি পাঁচ শতাংশেই আটকে থেকেছে। যেটা বেড়েছে সেটা হল রাজ্যকে দেওয়া কেন্দ্রীয় করের অংশ - ২০১১-১২ তে রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্র ৩.৫ শতাংশ আন্দাজ কেন্দ্রীয় করের অংশ পেত রাজ্য সরকার; ২০১৭-১৮ তে সেটা বেড়ে প্রায় পাঁচ শতাংশে পৌঁছেছে। কেন্দ্রীয় অনুদানের হারও বেড়েছে। এই সবই হয়েছে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুসারে। এতে রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন কোন কৃতিত্ব নেই।
কৃষকের আয়বৃদ্ধি
গত বাজেটে অর্থমন্ত্রীর সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ দাবি ছিল, যে পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ২০১১ তে ৯১ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ২০১৬-১৭ তে নাকি হয়েছিল ২ লক্ষ ৩৯ হাজার টাকা। এই হিসেব রাজ্যের অর্থদপ্তর কোন ভিত্তিতে করেছে, তা আজও অজানা। তথ্যের অধিকার আইনের ভিত্তিতে অর্থদপ্তরকে এই সংক্রান্ত প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নি। অথচ মুখ্যমন্ত্রীও বারংবার বলে যাচ্ছেন যে ওঁর আমলে নাকি রাজ্যের কৃষকদের মাথাপিছু আয় দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে গেছে।
সিএসও-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ছিল ২.৫ শতাংশ, যা কিনা একই সময়ে জাতীয় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ২.৭ শতাংশ হারের থেকে কম থেকেছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার এতো কম হওয়া সত্ত্বেও কৃষকদের মাথাপিছু আয় ছয় বছরে ১৬২ শতাংশ বাড়ল কি করে, সেটাই রহস্য! ২০১৭-১৮ তে পশ্চিমবঙ্গে মাথাপিছু আয় ছিল ৯৫ হাজার টাকা, সারা ভারতে ১ লক্ষ ১২ হাজার টাকা। যে রাজ্যে গোটা জনসংখ্যার মাথাপিছু আয় বার্ষিক ১ লক্ষ টাকার নিচে, সেখানে কৃষকদের মাথাপিছু আয় ২ লক্ষ টাকার বেশি কী করে হতে পারে?
গোটা দেশের কৃষিনির্ভর পরিবারগুলির বার্ষিক আয়ের সর্বশেষ হিসেব পাওয়া যায় ২০১৩-র ৭০তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় (এনএসএস)। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ৬৩ লক্ষ কৃষক পরিবার সমূহের ২০১৩ তে গোটা বছরে কৃষি থেকে আয় হয়েছিল গড়ে মাত্র ১১ হাজার টাকা, যা ছিল দেশের ১৮টি বড় রাজ্যের মধ্যে সর্বনিম্ন। সারা ভারতে এই গড় আয় ছিল ৩৭ হাজার টাকা।
কৃষি-অকৃষি সমস্ত আয় মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিনির্ভর পরিবারগুলির গড় আয় ছিল ৪৭ হাজার টাকা; এর থেকে কম গড় আয় ছিল একমাত্র বিহারের। গোটা দেশের ক্ষেত্রে গড় আয় ছিল ৭৭ হাজার টাকা। ২০১৩-র পর পশ্চিমবঙ্গে কোন কৃষি বিপ্লবটা ঘটে গেল যার ফলে কৃষকদের মাথাপিছু আয় ২ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গেল? ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে, ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ধান চাষি বা আলু চাষিদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতি বছরই। তা সত্ত্বেও কৃষকদের আয় বৃদ্ধি নিয়ে এই মিথ্যাচার করা হচ্ছে কেন, তার জবাব রাজ্য সরকারের দেওয়া দরকার।
শিল্পে ঋণ এবং বিনিয়োগ
২০১৫-১৬-র ৭৩তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮৯ লক্ষ ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্পের ইউনিট (এমএসএমই) আছে, যেখানে ১ কোটি ৩৫ লক্ষ মানুষ কর্মরত। সমস্ত রাজ্যের মধ্যে উত্তর প্রদেশের পর সব থেকে বেশি এমএসএমই ইউনিট পশ্চিমবঙ্গেই আছে। গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছিলেন যে বিগত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্পে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রদান করা হয়েছে, যা কিনা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দেওয়া ঋণের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে এমএসএমই সেক্টরে ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি থেকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ হল মাত্র ২৮ হাজার কোটি টাকা।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য এও দেখায় যে ২০০০ সালে দেশের সামগ্রিক শিল্পক্ষেত্রে ঋণের মোট পরিমাণের ৭ শতাংশ আসত পশ্চিমবঙ্গে, ২০১৭-তে তা কমে ঠেকেছে ৬ শতাংশে। অর্থাৎ গত দেড় দশকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পক্ষেত্রে ঋণবৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে কম থেকেছে। ২০১৬-১৭ তে তো রাজ্যে শিল্প ঋণের বৃদ্ধির হার শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছিল। বিগত এক দশকে ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গে ঋণবৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে কম থেকেছে। তাই রাজ্যের এমএসএমই ইউনিটগুলির দেশের মধ্যে সর্বাধিক ঋণ পাওয়া সংক্রান্ত অর্থমন্ত্রীর দাবির ভিত্তিটা কী, সেটাই বোঝা মুশকিল।
অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের যে অধোগতি বিগত কয়েক দশক ধরেই দৃশ্যমান, ২০১১-র সরকার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু সেই প্রবণতায় কোন পরিবর্তন আসেনি। জাতীয় স্তরের বার্ষিক শিল্প সমীক্ষার (এএসআই) তথ্য দেখাচ্ছে যে কল-কারখানায় (ফ্যাক্টরি সেক্টরে) সর্বভারতীয় স্তরে মূল্য সংযোজন, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অংশভাগ ২০১০-১১ থেকে ২০১৫-১৬ (সর্বশেষ পাওয়া তথ্য) পর্যন্ত লাগাতার কমেছে। অর্থাৎ রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার জাতীয় গড়ের তুলনায় ক্রমাগত কমেছে।
প্রতি বছর ঘটা করে রাজ্য সরকার যে 'গ্লোবাল বিজনেস সামিট'-এর আয়োজন করে, ২০১৮-র সেই সম্মেলনের পরে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন যে প্রায় ২ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে নাকি সমঝোতা হয়েছে। তার আগের বছরও ২ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের গল্প শোনান হয়েছিল বাজেট বক্তৃতায়। বাস্তবে পশ্চিমবঙ্গে বৃহৎ শিল্পে কত বিনিয়োগ হয়েছে?
কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৭, এই ছয় বছরে যেখানে গোটা দেশে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা, একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা, যা সর্বভারতীয় বিনিয়োগের ৩ শতাংশ মাত্র। দেশে মোট বিনিয়োগের অর্ধেকের বেশি গেছে শুধু দুটি রাজ্য, মহারাষ্ট্রে এবং গুজরাটে। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আছে অষ্টম স্থানে। বোঝাই যাচ্ছে যে অর্থমন্ত্রীর শিল্প বিনিয়োগ সংক্রান্ত ঢক্কানিনাদ আসল বিনিয়োগে মোটেও প্রতিফলিত হচ্ছে না।
উপসংহার
আজকের 'উত্তর-সত্য' যুগে মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, অতিরঞ্জিত প্রচার এবং তথ্যবিকৃতি, সরকারি নীতি প্রণয়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে বিশ্বের অনেক দেশেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও যে তার ব্যতিক্রম নয়, উপরের তথ্যাদি থেকেই তা স্পষ্ট। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার আসল সমস্যাগুলি ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে; লোক দেখানো কিছু ছিটেফোঁটা অনুদানের আড়ালে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে জনমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কর্মসূচী। তাই জনস্বার্থেই রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর গত বাজেটের প্রদত্ত অতিরঞ্জিত এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলিকে খারিজ করা প্রয়োজন; কারণ এই বছরের বাজেটেও এর পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা।