Advertisment

কক্স অ্যান্ড কিংস: আপাদমস্তক দুর্নীতির কাহিনী

কীভাবে লাটে উঠল প্রখ্যাত ভ্রমণ সংস্থা কক্স অ্যান্ড কিংস? এতদিন বলা হচ্ছিল, আর্থিক মন্দাই কারণ। এখন জানা যাচ্ছে, এর নেপথ্যে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি। পড়ুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
cox and kings audit

কক্স অ্যান্ড কিংস-এর সিএফও অনিল খান্ডেলওয়াল (বাঁদিকে) এবং প্রোমোটার পিটার কেরকর। ফাইল ছবি

চার বছর (২০১৫-১৯) ধরে ২১ হাজার কোটি টাকা পাচার; তথ্য জাল করা; "এক ভাইয়ের কাছ থেকে আরেক ভাইয়ের কাছে" ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ, যা জিম্মাদারির সবরকম নিয়ম-বহির্ভূত; ১৬০ জনেরও বেশি নকল গ্রাহককে ৯ হাজার কোটি টাকার বিক্রি; বর্ধিত ব্যাঙ্ক ব্যালান্স এবং একগুচ্ছ আর্থিক বিচ্যুতি - ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেউলিয়া ভ্রমণ সংস্থা কক্স অ্যান্ড কিংস-এর ফরেনসিক অডিটের খাতায় এগুলি ছাড়াও উঠে এসেছে একাধিক সম্ভাব্য দুর্নীতির খতিয়ান।

Advertisment

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এই অডিট সম্পূর্ণ করে প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারস (PWC), যাদের এই দায়িত্ব দেয় কক্স অ্যান্ড কিংস-কে ঋণ প্রদানকারী ইয়েস ব্যাঙ্ক। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর কাছে যা নথিপত্র আছে, তাতে বিশদ বিবরণ রয়েছে, কীভাবে তথ্য বিকৃতি এবং কোম্পানির ডেটা জাল করে কক্স অ্যান্ড কিংস।

অজয় অজিত পিটার কেরকর এবং তাঁর পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কক্স অ্যান্ড কিংস সংস্থাকে অক্টোবর ২০১৯-এ দেউলিয়া আদালতে পাঠানো হয়, ঋণ শোধ করতে না পারার দায়ে। এই সংস্থার ১২.২০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে প্রোমোটার গোষ্ঠীর হাতে, বাকি ৮৭.৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক জনসাধারণ। ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রখ্যাত এই ভ্রমণ সংস্থার অপরিশোধিত ঋণের মোট পরিমাণ ৫,৫০০ কোটি টাকা। এবং ইয়েস ব্যাঙ্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রাণা কাপুরের জমানায় এই সংস্থাই ছিল ইয়েস ব্যাঙ্কের সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহিতা সংস্থাগুলির একটি।

কক্স অ্যান্ড কিংস গোষ্ঠীকে ২,২৬৭ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয় ইয়েস ব্যাঙ্ক। মার্চ মাসে রাণা কাপুরের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পিটার কেরকরকে তলব করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। বর্তমানে জেলে অধিষ্ঠিত কাপুরের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, বিভিন্ন সংস্থাকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে 'কিকব্যাক' বা ঘুষ গ্রহণ করেন তিনি। সেইসব সংস্থা ঋণ পরিশোধ না করায় চরম সঙ্কটের সম্মুখীন হয় ইয়েস ব্যাঙ্ক।

anil ambani ed মুম্বইয়ে হেফাজতে ইয়েস ব্যাঙ্কের কর্ণধার রাণা কাপুর। ফাইল ছবি: নির্মল হরিন্দ্রন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

ফরেনসিক অডিটে অভিযোগ উঠেছে যে কক্স অ্যান্ড কিংসের অধিকাংশ লেনদেনই তাদের বোর্ডের "যথাবিহিত অনুমোদন" ছাড়া এবং ঋণ চুক্তি ছাড়াই সংঘটিত হয়। তদন্তে দেখা গেছে, অলোক ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি পীড়িত সংস্থাকে ১,০০০ কোটি টাকা দেয় কক্স অ্যান্ড কিংস, যে সংস্থা ২০১৭ সালে দেউলিয়া হয়ে যায়। তবে এই সংস্থার সঙ্গে অন্যান্য কোনোরকম ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল না কক্স অ্যান্ড কিংস-এর।  উল্লেখ্য, যে সময় ঋণ দেওয়া হয়, সে সময় এই অলোক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) ছিলেন সুনীল খান্ডেলওয়াল, যিনি আবার কক্স অ্যান্ড কিংস-এর সিএফও অনিল খান্ডেলওয়ালের ভাই।

এছাড়াও স্রেফ ২০১৯ আর্থিক বর্ষেই "ঋণের চুক্তি কার্যকর না করে" ১১ জন সংশ্লিষ্ট গ্রহিতাকে ৫৮৯ কোটি টাকার ঋণ দেয় কক্স অ্যান্ড কিংস।

তদন্তের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম হলো, "প্রাথমিকভাবে যা মনে হচ্ছে, তাতে এইসব ঋণ দেওয়া হয় যথাযথ অনুমোদন/নথিপত্র ছাড়াই, যা থেকে সন্দেহ জন্মায় যে এইসব লেনদেনের উদ্দেশ্য ছিল অর্থ পাচার করা।"

পিটার কেরকর, অনিল খান্ডেলওয়াল, এবং কক্স অ্যান্ড কিংস-কে ইমেইল মারফত পাঠানো বিশদ প্রশ্নাবলীর কোনও উত্তর মেলে নি।

cox and kings audit স্রেফ ২০১৯ আর্থিক বর্ষেই "ঋণের চুক্তি কার্যকর না করে" ১১ জন সংশ্লিষ্ট গ্রহিতাকে ৫৮৯ কোটি টাকার ঋণ দেয় কক্স অ্যান্ড কিংস

২০১৭ সালে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সমেত একাধিক সংস্থার ২৯,৫০০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেউলিয়া আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ায় অলোক ইন্ডাস্ট্রিজ। গত বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে, ৫,০৫০ কোটি টাকার বিনিময়ে এই সংস্থা অধিগ্রহণ করে নেয় জেএম ফিনান্সিয়াল এবং রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

কক্স অ্যান্ড কিংস-এর অডিট রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে যে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে নিজেদের আর্থিক বিবরণ "বিকৃত" করে তারা, প্রধানত "বিক্রির হার বেশি দেখিয়ে এবং ঋণের পরিমাণ কম দেখিয়ে"। এছাড়াও নজরে এসেছে বহুবিধ "কাল্পনিক" লেনদেন। রিপোর্টে উল্লিখিত কিছু প্রধান অভিযোগ এই প্রকার:

# ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১৪৭ জন নকল গ্রাহকের সঙ্গে ৫,২৭৮ কোটি টাকার ব্যবসা করে কক্স অ্যান্ড কিংস। এই গ্রাহকদের মধ্যে অন্তত ১৪১ জন গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি) বিভাগে নথিভুক্ত নয়। এবং অন্তত ছয়জন কক্স অ্যান্ড কিংস-এর জিএসটি রেজিস্ট্রেশন নম্বরকেই নিজেদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর হিসেবে দেখিয়েছে।

# ২০১৬ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে কক্স অ্যান্ড কিংস-এর মোট ৩,৯০৮ কোটি টাকার ব্যবসার অনেকটাই আসে ১৫ জন গ্রাহকের কাছ থেকে, যাদের কোনও অস্তিত্বই নেই বলে অভিযোগ। এইসব গ্রাহকদের ঠিকানা যাচাই করে দেখা গিয়েছে যে সেগুলি সবই আবাসিক ঠিকানা, যেখান থেকে কোনোদিনই কোনও ট্র্যাভেল এজেন্সি পরিচালনা করা হয় নি।

# কক্স অ্যান্ড কিংস-এর খাতাপত্রে এই ১৫ জন গ্রাহকের কাছ থেকে ২,৫৪৮ কোটি টাকা প্রাপ্তির হিসেব দেখানো হয়েছে, অথচ এই টাকার কোনও চিহ্ন নেই কক্স অ্যান্ড কিংস-এর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে, যেহেতু আদপেই কোনও টাকা জমা পড়ে নি। এপ্রিল ২০১৪ থেকে জুন ২০১৫-র মধ্যে এই ১৫ জন গ্রাহকের প্রত্যেকের সঙ্গে কক্স অ্যান্ড কিংস-এর ২৫০-২৬০ কোটি টাকার ব্যবসা দেখানো হয়েছে। তবে এই সমস্ত লেনদেন "অদ্ভুতভাবে" শুধুমাত্র মাসের শেষ দিনেই নথিভুক্ত করা হতো।

# ২০১৯ আর্থিক বর্ষে কক্স অ্যান্ড কিংস তাদের নগদ এবং ব্যাঙ্ক ব্যালান্স দেখায় ৭২৩ কোটি টাকা এবং ১,৮৩০ কোটি টাকা, যথাক্রমে স্বতন্ত্র এবং একত্রিত স্তরে। তা সত্ত্বেও জুন ২০১৯ থেকে ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয় সংস্থা, যার অর্থ হলো তাদের নগদ এবং ব্যাঙ্ক ব্যালান্স কৃত্রিমভাবে বর্ধিত হয়, যার ফলে আর্থিক বিবরণে কারচুপির প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

# ২০১৯ আর্থিক বর্ষে কক্স অ্যান্ড কিংস জানায়, তাদের সংস্থার মোট ঋণের পরিমাণ ২,০০০ কোটি টাকা, যেখানে সংস্থার স্বতন্ত্র ঋণের পরিমাণ ছিল ৩,৬০০ কোটি টাকা। এছাড়াও ৭৫০ কোটি টাকার ক্রেডিট কার্ড ঋণের কথা ঋণ প্রদানকারীদের কাছে গোপন করে সংস্থা।

জানুয়ারি মাসে দেউলিয়া মামলার শুনানি গ্রহণকারী ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনাল পিটার কেরকর, উরশিলা কেরকর, অনিল খান্ডেলওয়াল, কোম্পানির আরও তিনজন ডিরেক্টর, এবং ১৬ জন কর্মীকে আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে যেতে নিষেধ করে।

(আগামীকাল: কীভাবে নিজেদেরই কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত সংস্থাকে ঋণ পাইয়ে দেয় কক্স অ্যান্ড কিংস)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment