শুক্রবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত একদা প্রখ্যাত, এবং বর্তমানে দেউলিয়া ভ্রমণ সংস্থা কক্স অ্যান্ড কিংস-এর বিরুদ্ধে ফরেনসিক অডিটে উঠে আসা অভিযোগের তালিকায় ছিল তথ্য বিকৃতি, টাকা পাচার, নকল লেনদেন, এবং অপরিশোধিত ঋণ। সেই তালিকায় এবার যোগ হবে জালিয়াতি, স্বার্থ সংঘাত এবং ফৌজদারি চক্রান্ত।
অভিযোগ, বর্তমানে সঙ্কটাপন্ন ইয়েস ব্যাঙ্কের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণের একটি অংশ চালান করে দেওয়া হয় কক্স অ্যান্ড কিংস-এর শীর্ষ আধিকারিকদের দ্বারা পরিচালিত আরও একটি সংস্থায়। এই আধিকারিকদের মধ্যে ছিলেন সংস্থার নিজস্ব অডিটরও। এই দ্বিতীয় সংস্থাটি আবার ওই ঋণের টাকা দিয়ে কিনে নেয় একটি সরকার-সমর্থিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশীদারি। এই তথ্য উঠে এসেছে ইয়েস ব্যাঙ্ক এবং ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনাল দ্বারা যৌথভাবে পরিচালিত এক তদন্তে।
ইয়েস ব্যাঙ্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রাণা কাপুরের জমানায় কক্স অ্যান্ড কিংস-ই ছিল ইয়েস ব্যাঙ্কের অন্যতম ঋণ গ্রহিতা সংস্থাগুলির একটি। কক্স অ্যান্ড কিংস গোষ্ঠীকে ২,২৬৭ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয় ইয়েস ব্যাঙ্ক।
কাপুরের অপসারণের পর এই তদন্ত চালানো হয়, এবং অভিযোগ উঠেছে যে কক্স অ্যান্ড কিংস দ্বারা সমর্থিত ইজিগো ওয়ান ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড (Ezeego One Travel and Tours Ltd) নামক এক সংস্থাকে ইয়েস ব্যাঙ্কের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণের টাকা থেকে ১৫০ কোটি টাকা "পাচার" করা হয়, যা পরবর্তীকালে বিনিয়োগ করা হয় রেডকাইট ক্যাপিটাল (Redkite Capital) নামক এক সংস্থায়। জানুয়ারি ২০১৮ এবং মার্চ ২০১৯-এর মধ্যবর্তী সময়ে দুই কিস্তিতে নন-কনভারটেবল ডিবেঞ্চার-এর মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয় এই টাকা।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত রেডকাইট ক্যাপিটাল আরও চারটি সংস্থার মালিকানাধীন, যেগুলি পরিচালনা করতেন কক্স অ্যান্ড কিংস-এর চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) অনিল খান্ডেলওয়াল, তাঁর বাবা ওমপ্রকাশ খান্ডেলওয়াল, কক্স অ্যান্ড কিংস-এর নিজস্ব অডিটর নরেশ জৈন, এবং খান্ডেলওয়াল ও জৈন পরিবারের কিছু অন্যান্য সদস্য।
নথি ঘেঁটে যা পাওয়া গেছে, তাতে রেডকাইট ক্যাপিটাল ইজিগো-র কাছ থেকে পাওয়া ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে সরকার-সমর্থিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ট্যুরিজম ফিনান্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (TFCI)-তে ৩২.৮১ অংশীদারি কিনতে। এই লেনদেন, যার সময়কাল ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০১৯, অনুমোদন করে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই)। ব্যাঙ্কের সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন, কোনও স্বতন্ত্র ব্যক্তি সম্পর্কে কোনও মতামত দেয় না আরবিআই।
তদন্তে জানা গিয়েছে, জানুয়ারি ২০১৮ সালে রেডকাইট ক্যাপিটালকে দেওয়া ৮০ কোটি টাকার প্রথম কিস্তির কথা নিজেদের অডিট করা ব্যালেন্স শিটে উল্লেখ করে নি ইজিগো। উল্লেখযোগ্যভাবে, বিনিয়োগের দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে ৩০ মার্চ, ২০১৯ সালে ৭০ কোটি টাকা জমা করে ইজিগো, কিন্তু ইয়েস ব্যাঙ্কের ঋণ পরিশোধের কোনও উদ্যোগ নেয় নি তারা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইজিগোর কোম্পানি অ্যাকাউন্ট জাল বলে আরবিআই-এর কাছে অভিযোগ জানায় ইয়েস ব্যাঙ্ক। ওই সংস্থাকে মোট ৯৪৫ কোটি টাকা ঋণ দেয় এই ব্যাঙ্ক।
TFCI একটি নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (NBFC) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালে। এই আর্থিক সংস্থা প্রতিষ্ঠানের পিছনে মূল উদ্যোক্তা ছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিনান্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (IFCI), এবং এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যোজনা কমিশনের সাহায্যে গঠিত ন্যাশনাল কমিটি অন ট্যুরিজম-এর সুপারিশ মতো দেশের কিছু পর্যটন প্রকল্পকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
রেডকাইট ক্যাপিটাল ছাড়া TFCI-এর অন্যান্য অংশীদাররা হলো IFCI (০.৬৭ শতাংশ), লাইফ ইন্সিওরেন্স কর্পোরেশন (৩.৭৩ শতাংশ), ওরিয়েন্টাল ইন্সিওরেন্স কোম্পানি (১.০৭ শতাংশ), তামাকা ক্যাপিটাল (মরিশাস) (৩ শতাংশ), এবং কোপ্পারা সজীব টমাস (৫ শতাংশ)। সংস্থার অবশিষ্ট ৩০.৭৪ শতাংশ শেয়ার জনসাধারণের হাতে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, TFCI-এর কাছ থেকেও ঋণ পেয়েছে কক্স অ্যান্ড কিংস, যার পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এই ঋণ রেডকাইট ক্যাপিটাল TFCI-এর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশীদার হওয়ার আগেই দেওয়া হয়। নথিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, TFCI-তে অংশীদারি কায়েম করে নিয়েই TFCI-এর শেয়ার বন্ধক রেখে ঋণদাতাদের কাছ থেকে ৮৫ কোটি টাকা আদায় করে রেডকাইট।
বর্তমানে ইয়েস ব্যাঙ্কের অভিযোগ, রেডকাইট এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে মিলে "ফৌজদারি চক্রান্ত রচনা করেছে" ইজিগো, যার উদ্দেশ্য ব্যাঙ্ককে "ঠকানো", এবং "জালিয়াতি করে" ইজিগো-কে প্রেরিত ঋণের টাকা পাচার করে দেওয়া। এছাড়াও ইয়েস ব্যাঙ্ক অভিযোগ করেছে যে জুন ২০১৭-য় তাদের দেওয়া ৪৫০ কোটি টাকার একটি 'টার্ম লোন' থেকে ৮৫ কোটি টাকা চালান করে দেয় ইজিগো, এবং ব্যাঙ্কের কাছে জাল 'এন্ড-ইউজ সার্টিফিকেট' জমা দেয়।
ইমেইল মারফত রেডকাইট ক্যাপিটাল এবং নরেশ জৈন, উভয়েরই দাবি, ইয়েস ব্যাঙ্কের তরফে কোনোরকম ভাবে যোগাযোগ করা হয় নি তাঁদের সঙ্গে, এবং ব্যাঙ্কের কোনও অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত নন তাঁরা। "আমরা সর্বতোভাবে কোনোরকম অভিযোগ অস্বীকার করছি। আমাদের লেনদেনে আগাগোড়া উচ্চমানের পরিচালনা বিধি মেনে চলেছি আমরা," বলেন তাঁরা। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন ইয়েস ব্যাঙ্কের এক মুখপাত্র।
ইজিগো বা কক্স অ্যান্ড কিংস-এর পৃষ্ঠপোষক অজয় অজিত পিটার কেরকরকে পাঠানো কোনও মেইলের প্রতিক্রিয়া আসে নি। জবাব মেলে নি অনিল খান্ডেলওয়ালকে পাঠানো মেইলের-ও।
কেরকর এবং তাঁর পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কক্স অ্যান্ড কিংস সংস্থাকে অক্টোবর ২০১৯-এ দেউলিয়া আদালতে পাঠানো হয়, ঋণ শোধ করতে না পারার দায়ে। এই সংস্থার ১২.২০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে প্রোমোটার গোষ্ঠীর হাতে, বাকি ৮৭.৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক জনসাধারণ। ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রখ্যাত এই ভ্রমণ সংস্থার অপরিশোধিত ঋণের মোট পরিমাণ ৫,৫০০ কোটি টাকা।
মার্চ মাসে রাণা কাপুরের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পিটার কেরকরকে তলব করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। বর্তমানে জেলে অধিষ্ঠিত কাপুরের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, বিভিন্ন সংস্থাকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ‘কিকব্যাক’ বা ঘুষ আদায় করেন তিনি।
আগামীকাল: কীভাবে জাল করা হয় অডিট রিপোর্ট, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন