ক্রমশ কমতে থাকা জিএসটি (GST) আদায়ের হার নিয়ে বিব্রত কেন্দ্রীয় সরকারকে এবার নতুন অস্বস্তির মুখে ফেলল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জিএসটি কাউন্সিল। কাউন্সিলের একাংশ জানতে চেয়েছেন, গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (কম্পেনসেশন টু স্টেটস) অ্যাক্টে যে ১৪ শতাংশ "উচ্চ" কর আদায় বৃদ্ধির ভিত্তিতে প্রতিটি রাজ্যকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই ভিত্তি কতটা নির্ভরযোগ্য।
বিজেপি-শাসিত এক রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, "যেখানে মুদ্রাস্ফীতির হার ৪-৫ শতাংশ, এবং দেশে বৃদ্ধির হার ৫-৬ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে, সেখানে কেন্দ্রের পক্ষে প্রতিটি রাজ্যকে বার্ষিক ১৪ শতাংশ হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া মুশকিল হবে।"
জিএসটি-র হার যে আপাতত আর বাড়ানো যাবে না, সেকথা নিশ্চিত, অতএব এবার নজর বিভিন্ন রাজ্যের দ্বারা সংগৃহীত ট্যাক্সের বৃদ্ধির হারের ওপর, যে ট্যাক্স জুলাই ২০১৭ থেকে জিএসটি-র অন্তর্ভুক্ত হয়ে এসেছে। যে আর্থিক বর্ষে জিএসটি চালু হয়, অর্থাৎ ২০১৫-১৬, তার আগের তিন বছরে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত নয় এমন রাজ্যগুলিতে রাজস্ব বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৮.৯ শতাংশ। যা কোনোভাবেই ২০১৫-১৬ সালের ভিত্তিতে ঘোষিত ১৪ শতাংশ বৃদ্ধির হারের ধারেকাছেও আসে না, যে হারের ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্ষতিপূরণের হিসেব।
বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত রাজ্যগুলিকে হিসেবের মধ্যে আনলে ২০১৫-১৬ সালের আগের তিন বছরে সারা দেশে রাজস্ব বৃদ্ধির গড় হার ছিল ১০.৬ শতাংশ।
জিএসটি কাউন্সিলের কাছে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সালে রাজ্যগুলির জন্য সংরক্ষিত আয়ের মাসিক পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৯,০২০ কোটি টাকা। সেখানে তাদের সংগৃহীত করের মাসিক পরিমাণ ছিল গড়ে ৪৩,১৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ কেন্দ্রকে মাসে মাসে ৬,০০০ কোটি, বা বছরে ৭২,০০০ কোটি টাকার খামতি পূরণ করতে হয়েছে।
সমস্যা হলো, ২০১৯-২০ তে এই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি মাসে প্রায় ১৩,০০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ বছরে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা কিনা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। যে টাকা যোগাড় করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ফাঁপরে পড়েছে কেন্দ্র। ইতিমধ্যেই একাধিক রাজ্য জিএসটি-র ক্ষতিপূরণ পেতে বিলম্ব হওয়ায় তাদের অসন্তোষ জানিয়েছে কেন্দ্রের কাছে।
চলতি আর্থিক বর্ষের বাজেটে কেন্দ্রের হিসেব অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ শুল্ক (compensation cess) বাবদ বরাদ্দ হয়েছে ১.০৯ লক্ষ কোটি টাকা। নভেম্বর পর্যন্ত শুল্ক আদায় হয়েছে ৬৪,৫২৮ কোটি টাকা। সেই হার বজায় থাকলে সম্পূর্ণ আর্থিক বর্ষের আয় দাঁড়াবে ৯৬,৭৯২ কোটি টাকা, যার পরেও ঘাটতি থাকছে ৫৯,২০৮ কোটি টাকার।
বলা বাহুল্য, জিএসটি বৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশ ধরে না নিলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণও কম হতো।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস দ্বারা প্রাপ্ত রাজ্যভিত্তিক পরিসংখ্যান বলছে, বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত নয়, এমন ১৭টি রাজ্যের মধ্যে স্রেফ আটটি রাজ্যে ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৫-১৬, এই তিন বছরে রাজস্ব বৃদ্ধির গড় হার 'ডাবল ডিজিট', অর্থাৎ ডবল অঙ্ক ছুঁয়েছে: ঝাড়খণ্ড (১৩.১ শতাংশ), বিহার (১৩ শতাংশ), হরিয়ানা (১১.৭ শতাংশ), রাজস্থান (১১.৬ শতাংশ), মধ্যপ্রদেশ (১১ শতাংশ), কর্ণাটক (১০.৭ শতাংশ), গোয়া (১০.৫ শতাংশ), এবং কেরালা (১০.৪ শতাংশ)।
গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের মতো কারখানাজাত উৎপাদন-নির্ভর রাজ্যে কর বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৩.৬ এবং ৯.৪ শতাংশ, এবং অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, এবং উত্তর প্রদেশে করের গড় বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৩.৫, ৭.৭ এবং ৯.৪ শতাংশ।
ক্ষতিপূরণের আনুমানিক বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করার সময় বিভিন্ন বিকল্প আলোচনা করে জিএসটি কাউন্সিল। একটি বিকল্প ছিল ২০১৫-১৬ সালের আগের তিন বছরের কর বৃদ্ধির গড় হার বিবেচনা করা; অথবা পাঁচ বছরের গড় হারের হিসেব করা; অথবা পাঁচ বছরের মধ্যে তিন বছর ধরে সমস্ত আনুষঙ্গিক ফ্যাক্টর বাদ দিয়ে; অথবা দেশের নামমাত্র জিডিপি (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) বৃদ্ধির হারের সমতুল্য হারকে ভিত্তি করে।
কিন্তু জিডিপি বৃদ্ধির হারের হিসেব ধরে চলার প্রস্তাবে সায় ছিল না কেন্দ্রের। মনে করা হয়েছিল যে যেহেতু অর্থনীতির বৃদ্ধির ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজস্বের সংগ্রহ, অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আসবে না, যার ফলে উচ্চতর বৃদ্ধির হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হবে না।
জিএসটি কাউন্সিলের প্রথম কয়েকটি বৈঠকে সভাপতিত্ব করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ১০.৬ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হোক রাজস্ব বৃদ্ধির হার, যেহেতু বাস্তবে তা ২০১৫-১৬ সালের আগের তিন বছরে ভারতে গড় বৃদ্ধির হারের কাছাকাছি। কিন্তু জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকের রেকর্ড বলছে ১৪ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির প্রস্তাব "সমঝোতার মনোভাব নিয়ে" গৃহীত হয়, সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব মেনে নেওয়ার উদ্দেশ্যে।
সেপ্টেম্বর মাসে গোয়ায় অনুষ্ঠিত জিএসটি কাউন্সিল বৈঠকে পঞ্চদশ ফিনান্স কমিশন (15th Finance Commission) প্রস্তাব দেয় যে ২০২২ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের নির্ধারিত সময়সীমার যে তিন বছর অবশিষ্ট আছে, সেই তিন বছরে ১৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেওয়া হোক আইনত প্রতিশ্রুত বৃদ্ধির হার। কমিশনের বক্তব্য ছিল, এই হার নির্ধারণ করা হয় প্রাক-জিএসটি হারের ভিত্তিতে, যে হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি একাধিক রাজ্য। তাদের বক্তব্য, কাউন্সিলের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জিএসটি-র হার এবং কাঠামো নিশ্চিত করা, সেগুলিকে ক্রমাগত বদলানো নয়।
গত কয়েকমাস ধরে সমানে পড়ছে জিএসটি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব, যার ফলে উদ্বেগ বাড়ছে কেন্দ্র এবং রাজ্য স্তরে। নভেম্বর বাদ দিলে তার আগের দুমাসে এতটাই কমেছে জিএসটি আদায়ের হার যে সময়মত ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায় নি রাজ্যগুলিকে। এর প্রতিষেধক হিসেবে জিএসটি-র হার বাড়ানোর পরামর্শ দেয় অফিসারস কমিটি, কিন্তু তাদের সাম্প্রতিক বৈঠকে এই পরামর্শ খারিজ করে দেয় জিএসটি কাউন্সিল। আপাতত লক্ষ্য, তড়িঘড়ি হার না বাড়িয়ে বরং কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতার মোকাবিলা করা, এবং আইনের সম্ভাব্য ফাঁকফোকর ভরাট করা।