ভারতীয় ইঞ্জিনিয়রদের মধ্যে কেউ কেউ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাবান সিইও হয়েছেন বটে, কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিটেক ও বিই ডিগ্রিধারীরা ঔজ্জল্য হারিয়েছেন। একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৮০ শতাংশ ভারতীয় এঞ্জিনয়র শিক্ষা অর্থনীতিতে চাকরি যোগ্য নন। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের আইশি ২০১৯ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম প্রকল্প। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩৮.৫২ লক্ষ ছাত্রছাত্রী।
তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের বাড়বাড়ন্তের সময়ে সারা দেশে মাশরুমের মত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পাঠক্রম আপডেটেড ছিল না এবং ছাত্র-শিক্ষত অনুপাত ছিল খবই খারাপ। আইআইটি, কয়েকটি এনআইটি এবং কয়েকটি বেসরকারি ইঞ্জিনায়ারিং কলেজ ছাড়া প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানই ছাত্রছাত্রীদের চাকরির জন্য প্রস্তুত করার ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছে। একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে যেসব গ্রুপ ডি চাকরিতে ক্লাস টুয়েলভ পাশ যোগ্যতা প্রয়োজন সেখানেও আবেদন করেছেন ইঞ্জিনিয়ররা।
২০১৭-১৮ সালে এআইসিটিই অনুমোদিত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের ৫০ শতাংশেরও কম ছাত্র ছাত্রী চাকরি পেয়েছেন। যে ৭.৯২ লক্ষ ছাত্রছাত্রী স্নাতক হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৩.৫৯ লক্ষ ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টের মাধ্যমে চাকরি পয়েছেন। এবছর লোকসভায় মানবসম্পদোন্নয়ন মন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল এই তথ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে যাঁরা ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টের বাইরে চাকরি পয়েছেন, যাঁরা স্বরোজগার করছেন, ও যাঁরা উচ্চতর শিক্ষায় গিয়েছেন, তাঁদের হিসেব ধরা নেই।
ডিগ্রির অবমূল্যায়ন
২০১৭ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল গত এক দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলি এলোমেলো ভাবে বেড়ে ওঠার ফলে ডিগ্রির অবমূল্যায়ন ঘটেছে।
২০১৬-১৭ সালে ৩২৯১টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ১৫.৫ লক্ষ আসন, প্রায় ৫১ শতাংশ ফাঁকা ছিল বলে জানিয়েছে অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই)। দেশে প্রযুক্তিগত শিক্ষার শীর্ষ পরিচালক এই কাউন্সিল। এ বছরও ১৪.৯ লক্ষ আসনের মধ্যে ১০ লক্ষের মত আসন ভর্তি হয়েছে। ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যগুলিতে ৫০ শতাংশের কম ছাত্র ভর্তি হচ্ছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এআইসিটিই চেয়ারম্যান অনিল সহস্রবুদ্ধে বলেন, সমস্যার মূল হল, বড় সংখ্যক বেসরকারি ও ডিমড বিশ্ববিদ্যালয় এআইসিটিই-র আওতায় আসে না।
অসফল প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে
২০১১ থেকে ১৫ সালের মধ্যে ৪৫১টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩১টিতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্স করানো হত। কিন্তু ২০১৬ সালে এর মধ্যে অনেকগুলিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনে জানিয়েছেন, সারা দেশে ১২৮টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে এআইসিটিই। বছরওয়ারি হিসেবে, ২০১৮-১৯ সালে মোট ২৬টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বন্ধ করা হয়েছে, ২০১৬-১৭ সালে বন্ধ করা হয়েছে ৫৫টি, ২০১৭-১৮ সালে বন্ধ হয়েছে ৪৭টি।
২০১৭ সালে, এআইসিটিই ঘোষণা করেছিল যেসব কলেজে গত পাঁচ বছরে ৩০ শতাংশের বেশি আসন পূর্ণ হয়নি, সেগুলি বন্ধ করে গেওয়া হবে। জানুয়ারি মাসে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্টে জানা যায় নতুন কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর খোলেনি। হায়দরাবাদ আইআইটি চেয়ারম্যান বিভিআর মোহন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন এক কমিটির সুপারিশ অনুসারে, এআইসিটিই অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলিই নতুন প্রযুক্তির কর্মসূচি হাতে নিতে পারবে বা পুরনো ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সগুলিকে আধুনিকতম প্রযুক্তির কোর্সে রূপান্তরিত করতে পারবে।
ব্যাঙের ছাতার মত এত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কেন?
২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দেশে আইটি বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এ সময়ে প্রয়োজনের তাগিদেই বহু প্রতিষ্ঠান চালু হয়। ভারত পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় প্রযুক্তিকর্মী পাঠিয়ে তার ফায়দাও তোলে। কিন্তু ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা এবং এই ক্ষেত্রে ব্যাপক অটোমেশনের কুপ্রভাব পড়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর।
মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রাক্তন সচিব অশোক ঠাকুর বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার এআইসিটিই-তে বিতর্ক হয়েছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আইনগত ভাবে ঠিক নয় বলে সহমতেও পৌঁছানো গিয়েছিল।
২০০৩ সালে, ইউআর রাও কমিটি প্রস্তাব দেয়, যেসব রাজ্যে প্রতি দশ লক্ষে ১৫০-র বেশি ছাত্র ভর্তি হচ্ছে, সেখানে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের জন্য নতুন প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি পাঁচ বছরের জন্য স্থগিত রাখা হোক। তবে সরকার এ সুপারিশ মানেনি।
বিভিন্ন সেক্টরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কতজন কাজের সুযোগ পেয়েছেন, তার কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকায় পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। অশোক ঠাকুরের কথায়, এমনকী ন্যাসকম, যারা আইটি সেক্টরের প্রাথমিক দেখভাল করত, তারাও এই ইন্ডাস্ট্রির ম্যাপিং করেনি, সম্ভাব্য বৃদ্ধিরও হিসেব করেনি। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রের উদ্যোগপতিরা বিষয়টির সুযোগ নিয়েছেন। এর ফলে কিছু সেক্টরে অতিরিক্ত জোগান ঘটেছে, কিছু সেক্টরে প্রয়োজনের তুলনায় কম জোগান ঘটেছে।
আরও আসন, আরও কম চাকরি- সমাধান কোথায়?
আইআইটি-র মত শীর্ষস্থানীয় কলেজগুলির কথা ছেড়ে দিলে, বাকিগুলি প্লেসমেন্ট দিতে অসমর্থ হয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষা-শেখার পদ্ধতি প্রাথমিক ভাবে থিওরেটিক্যাল স্তরে থেকে গিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন অনুসারে কোর্স স্থির করা হয়নি।
সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে কেবলমাত্র ৪০ শতাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েটরা ইন্টার্নশিপ শেষ করছেন এবং ৩৬ শতাংশ তাঁদের কোর্সের বাইরের যে কোনও প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছেন।
ভাল মানের ইঞ্জিনিয়র তৈরির জন্য ফান্ডের প্রতুলতার প্রয়োজন। কেন্দ্র সব সময়েই আইআইটিগুলিকে অন্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। অশোক ঠাকুরের কথায়, প্রতি বছর হাজার খানেক ইঞ্জিনিয়ার তৈরির জন্য ৫০০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়ে থাকে আইআইটি গুলিকে। রাজ্য স্তরে একটি প্রতিষ্ঠান বড় জোর ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা পায়। কয়েকটি হাতে গোনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিছু বিনিয়োগ করলেও তা আইআইটি গুলির তুলনায় কিছুই নয়।
সরকার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং মানোন্নয়ন ঘটাতে পারে?
এ বছর প্রথম আইআইটিগুলিতে স্নাতকস্তরে বিই ও বিটেকের সমস্ত আসন ভর্তি হয়ে গিয়েছে। অন্য কলেজ ছাত্ররাও যাতে জায়গা পান, সে কারণে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে ছাত্রছাত্রীদের ইন্টার্নশিপ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আধুনিক ল্যাব বানানো যায়, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদি সুনিশ্চিত হয়।