Advertisment

ইংরেজি বিভাগে আমরা

এ দেশে নিম্নবর্গের রাজনীতিতে ফুলে-আম্বেদকারের সময় থেকেই জাতীয়তাবাদী তর্জন-গর্জন উপেক্ষা করে বার বার ইংরেজি ভাষা ও ম্যাকলে প্রচারিত ইংরেজি মডেলে শিক্ষার সমর্থন উচ্চারিত হয়েছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
English Language Teaching

অলংকরণ- অরিত্র দে

ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগগুলির কিছু বিচিত্র সমস্যা আছে। বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্মের এই দেশ। উত্তর ঔপনিবেশিক যুগের অনিবার্য নিয়মেই যেন বয়ে বেড়াতে হয় ইতিহাসের বোঝা, মাথায় রাখতে হয় টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলের উত্তরাধিকার আর ইংরেজি বিভাগের উত্থানের ইতিহাস। তেজস্বিনী নিরঞ্জনা, হয়তো কিছুটা ব্যঙ্গের ছলেই, একে বলেছেন "ইংরেজি শিক্ষকের angst"। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে কাঠফাটা রোদ্দুরের দুপুরে “shall I compare thee to a summer’s day” ও ড্যাফোডিলসের কাহিনী শুনিয়ে যেতে বাধ্য অসহায় ইংরেজি শিক্ষক শাপমোচনের সন্ধানে ইতিহাস চর্চা করেন, ক্যালিবানের ন্যায় সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর ভাষাতেই প্রভুকে অভিসম্পাত করায় ব্রতী হন। অপর দিকে রয়েছে ভবিষ্যতের তাড়না, সফট স্কিলস আর কমিউনিকেশন স্ট্র্যাটেজিতে উজ্জ্বল প্রগতির স্বপ্ন। ইংরেজি শিক্ষক সেখানে আলাদিনের দৈত্য, তিনি টেকনিকাল রাইটিং আর কমিউনিকেশন স্কিলসের মন্ত্রবলে শয়ে শয়ে বাজার যোগ্য কর্মীর জোগান দিয়ে যাবেন, তাঁর হাত ধরে ভারত আবার জগত সভার শ্রেষ্ঠ আসন লবে। ইতিহাস ও ভবিষ্যতের এই টানাপোরেনের মাঝে ইংরেজি শিক্ষক তখন দ্বিধাবিভক্ত, সন্ত্রস্ত, হয়তো বা মাঝে মাঝে স্বগতোক্তি করে ওঠেন, “No! I am not Prince Hamlet, nor was meant to be”।

Advertisment

আরও পড়ুন, খোকা ৪২০-এর বদান্যতা শেষ হবে কবে?

উগ্র জাতীয়তাবাদের যুগে ভারতবর্ষের শিক্ষা জগতে অসহায়তা - ইংরেজি শিক্ষকের ভাষায় বললে - একটি জনপ্রিয় 'ট্রোপ'। শত-সহস্র অস্থায়ী শিক্ষকের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আর বেসরকারি শিক্ষার দাপটে সার্বজনিক শিক্ষা ব্যবস্থার নাভিশ্বাসের তাড়নাকেও ছাপিয়ে শিক্ষাকর্মীর অসহায়তা আজ যেন অদ্ভুত এক করুণ রসে ভেজানো। শ্লেষ-ব্যঙ্গ-আত্মগ্লানি ও দম বন্ধ করা এক প্রকারের অস্বস্তি মিশ্রিত এই কণ্ঠস্বর এখন ভারতবর্ষের উচ্চ শিক্ষা জগতের কোনায় কোনায় কান পাতলেই শোনা যায়। ভুয়ো তথ্য দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিক আর গো মূত্রে স্বর্ণ সন্ধানের দায়িত্বে থাকা অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিক আর্কাইভ আর ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে হাত মেলান মাঝে মাঝে, কলাবিদ্যা ও সমাজ বিজ্ঞানের অতি প্রাসঙ্গিকতা বোঝাতে কলম ধরেন বিশেষজ্ঞরা। উচ্চশিক্ষিত বিশেষাধিকার প্রাপ্ত শিক্ষাকর্মী সমাজের এ হেন নান্দনিক অসহায়তার মাঝে ইংরেজি শিক্ষকই বা পিছিয়ে থাকেন কেমন করে? তাঁর কলমের টানে ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধী দর্শন থেকে সলমান রুশদির কালাপাহাড়ি লেখনীর মর্ম নতুন করে পড়বার আবশ্যকতা। শিক্ষা সংস্কৃতির নবজাগরণের কামনায় ব্যাকুল শিক্ষাকর্মীবৃন্দের সাথে সামিল হন তিনিও, বাগদেবী সরস্বতীর ইন্টারনাল কমপ্লেন্টস কমিটিতে অভিযোগের খাতাটা ভরে ওঠে নানা অনুযোগ-অভিযোগে।



এ কথা অবশ্যই সত্য নয় যে angst ও অসহায়তার ট্রোপের বাইরে ইংরেজি শিক্ষকের কোনদিন কোন রাজনৈতিক চিন্তা ছিলনা, বা উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতে ভাষার রাজনীতি সম্পর্কে ইংরেজি বিভাগগুলি সম্পূর্ণ অসচেতন। দ্রাবিড় আন্দোলন আর বরাকের ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী কণ্ঠের দেশ ভারতবর্ষ, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের সর্বগ্রাসী লালসার দেশও ভারতবর্ষ। এ হেন দেশে প্রাক্তন শাসকদের রেখে যাওয়া ইংরেজি ভাষার ক্ষমতা অনস্বীকার্য। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে লেখা একটি বইয়ে তাই স্বাতী জোশী লিখেছিলেন, "ভারতবর্ষের মতন দেশে পুঁজির বিকাশ অসমান, এবং দেশের নানান অংশে ভাষাগত ও সামাজিক গোষ্ঠীবদ্ধতাও একেবারে আলাদা। ক্ষমতা ও শাসনের ভাষা হিসেবে ইংরেজির এ দেশে অবস্থান অতএব খুবই জটিল, এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধিতায় ভর্তি।" সেই সময় থেকেই (যা প্রসঙ্গত উদারীকরণের প্রথম যুগ) ইংরেজি বিভাগগুলি তাই ইংরেজি বনাম 'ভাষার' (অর্থাৎ, নানান আধুনিক ভারতীয় মাতৃভাষা) এই দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণে মনোযোগ দিয়েছে। কমনওয়েলথ-পোস্টকলোনিয়াল-ডায়াস্পোরা-সাউথ এশিয়া চর্চার ফাঁকে ফাঁকে স্নাতক স্তরে শেক্সপিয়র ও এলিয়টের পাশে স্থান করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ আর মুক্তিবোধ, এডওয়ার্ড সাইদ ও গায়ত্রী স্পিভাক হয়ে উঠেছেন অবশ্যপাঠ্য, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে কেনিয়ার উপনিবেশ উত্তর সাহিত্য পঠনপাঠনে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে প্রথম থেকেই। শকুন্তলা-মহাভারত-মৃচ্ছকটিকমের মতন কুলীন সংস্কৃত সাহিত্যের পাশে স্থান হয়েছে তামিল সিলাপতিকরমের। চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেমের হযবরলর আমলেও ক্রমপরিবর্তমান পাঠ্যক্রমে সসম্মানে জায়গা দখল করেছেন ভীমরাও আম্বেদকার।

ইংরেজি এবং আধুনিক ভারতীয় মাতৃভাষাগুলির চাপান-উতোরের মাঝেও এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে স্বাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজি শুধু ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও শাসনের ভাষা নয় — আরও নানা সামাজিক উপাদানের সাথে অর্থনৈতিক অবস্থানের নির্মাণও করে থাকে ইংরেজি ভাষা দক্ষতা। ২০০৮ সালে প্রকাশিত একটি স্টাডিতে আজম, চিন আর প্রকাশ দেখাচ্ছেন যে এ দেশে ইংরেজি ভাষার উপর দখলের সাথে উপার্জন ক্ষমতার সরাসরি যোগাযোগ আছে — মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্কুল পাশ করলে একজন মানুষের যতটা উপার্জন ক্ষমতা হতে পারে, ঠিক ততটাই উপার্জন ক্ষমতা দিতে পারে স্রেফ ইংরেজি ভাষা দক্ষতা। এ ছাড়াও তাঁদের তথ্য জানাচ্ছে যে উচ্চ শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষা দক্ষতার সমন্বয়ে উপার্জন ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। এ দেশে নিম্নবর্গের রাজনীতিতে তাই ফুলে-আম্বেদকারের সময় থেকেই জাতীয়তাবাদী তর্জন-গর্জন উপেক্ষা করে বার বার ইংরেজি ভাষা ও ম্যাকলে প্রচারিত ইংরেজি মডেলে শিক্ষার সমর্থন উচ্চারিত হয়েছে। দলিত ক্ষমতায়নের আন্দোলনে ইংরেজি শিক্ষার স্থান নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এক জায়গায় কাঞ্চা ইলাইয়া লিখছেন, ২০১১ সালে,

"বহু শতক ধরে শিক্ষার তথাকথিত দেবী দলিতদের যে কোন ভাষা শেখা, পড়া বা লেখারই বিরোধী ছিলেন। তিনি কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের শিক্ষার দেবী ছিলেন - মূলত ব্রাহ্মণ ও বানিয়াদের। নিম্নবর্ণের মানুষজন, যাঁদের শিক্ষায় কোন অধিকার ছিলনা, তাঁরা শিক্ষার দেবীকে ভয়াবহ এক ডাইনি হিসেবেই ভেবে এসেছেন। তাঁদের সন্তানরা পাঠশালায় গেলে দেবীরুপী এই ডাইনির হাতে মৃত্যু তাদের অবধারিত, তাঁরা এটাই মনে করতেন।

উনি আমাদের মেরে ফেলেন, এই বিশ্বাস আমার ঠাকুমার মনের এতটাই গভীরে ঢুকে গিয়েছিল যে আমাদের মা যখন আমাকে আর আমার ভাইকে - বোনেদের না, অবশ্যই - স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন, তখন ঠাকুমা রীতিমত মায়ের সাথে ঝগড়া করেন। তিনি পোচাম্মা দেবীর - আমাদের গ্রামের দেবী - কাছে প্রার্থনা করতেন, যাতে তিনি আমাদের সরস্বতীর নজর থেকে আড়াল করে রাখেন। আমরা স্কুলে যাওয়া শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি দেহ রাখেন, হয়তো আমরা বেশিদিন বাঁচবো না এই চিন্তাতেই।"



প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি শেখানোর কেন্দ্রীয় সরকারি সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে ইলাইয়া বলছেন, "<স্বাধীন ভারতবর্ষে> ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষেরা পূরাকল্পীয় সরস্বতী দেবীর ছত্রছায়ায় কিছুটা আসতে পারার সাথে সাথেই সরস্বতী দেবী স্বয়ং তাঁর বোন লক্ষ্মীর সাথে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়লেন, বসতি করলেন ঔপনিবেশিক ইংরেজির জগতে। ভারতবর্ষের পিছিয়ে থাকে মানুষজনের সেখানে এখনো অবধি কোন স্থান নেই।" ইলাইয়া আশা করছেন যে প্রাথমিকে ইংরেজি শিক্ষা শুরু হলে এই বিভেদ একটু হলেও মেটা শুরু হবে। আম্বেদকার মনে করতেন ব্রাহ্মণ্যবাদের শেকল ভাঙার একমাত্র উপায় ইংরেজি শিক্ষা। আজকেও চন্দ্র ভান প্রসাদের মতন দলিত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরা লর্ড ম্যাকলের জন্মদিন পালন করেন, তরুণ কবি মীনা কণ্ডস্বামী লেখেন, "আমি এমন এক ইংরেজির  স্বপ্ন দেখি যা সাদা মানুষের জিভকেও ক্লান্ত করে ছাড়বে।"

আরও পড়ুন, শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর সন্ধানে

ইংরেজি ভাষা চর্চা ও ইংরেজি শিক্ষার সমর্থন কী কেবলই দলিত রাজনীতিতে? ২০১৮ সালের 'আচ্ছে দিনের' স্বপ্ন দেখা ভারতবর্ষে, 'জবলেস গ্রোথ' আর কর্মহীনতার হাহাকারে জর্জরিত ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষার আকুতি তো নতুন কিছু নয়! নিম্ন মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের আকাঙ্ক্ষার জগতে ইংরেজি শিক্ষার যে বিশেষ স্থান থাকবে, এ আর আশ্চর্য কী? এই ২০১৮ সালেই ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রটেকশন অফ চাইল্ড রাইটসের (এনসিপিসিআর) প্রকাশিত একটি সার্ভে দেখিয়েছে যে দিল্লিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বর্গের শিশুদের স্কুলছুট হওয়ার একটা কারণ যদি পুরোপুরি অর্থনৈতিক হয়, তাহলে আরেকটা অবশ্যই প্রাথমিকে ইংরেজি। ২০১১র ২৬% থেকে সেটা ২০১৪তে কমে ১০% হলেও সংখ্যাটা খুব একটা কম নয়। নিম্নবর্গ ও শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা তাতে কম হয়নি।

এ কথা মনে রাখা দরকার যে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ফিরিয়ে আনবার পিছনে অধিকতর সমর্থন ছিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বর্ণের মানুষজনের, এবং এর কারণ এই নয় যে তাঁরা কেবলই সার্বজনিক শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য নিয়ে ব্যাথিত হয়েছিলেন। ইংরেজি নিয়ে চাপান উতোর যে আসলে ভারতবর্ষের স্বল্প জনসম্পদ ও পুঁজি দখলের টানাপোরেন, তা তো এই শ্রেণির মানুষজনের অজানা নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থার উপর তাঁদের একচেটিয়া দখল, এবং নব্য উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক মুনাফা পুরোটাই টেনে নিয়েছেন তাঁরা। ইংরেজি নামক সম্পদটি যে আসলে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পুঁজির উৎস হতে পারে, সেটা জেনেই তাঁদের ইংরেজি মাধ্যম-ইংরেজি শিক্ষা-কমিউনিকেশন অ্যান্ড সফট স্কিলসের উপর মৌরসি পাট্টা বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা। সার্বজনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নিম্নবর্গের ও নিম্নবর্ণের প্রবেশ যাতে না ঘটে তার আপ্রাণ চেষ্টা তাঁদের পক্ষ থেকে আজও চালানো হয়েই চলেছে, আর সেই সঙ্গে বেজে চলেছে বিপুল মূল্যে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসার রণদামামা, বিপদজনক ভাবে বেড়ে চলেছে শিক্ষা ঋণের বোঝা।

বেজার মুখে 'কম্পালসরি' ইংরেজি আর রেমেডিয়াল ক্লাস নিতে যেতে হয় যে ইংরেজি শিক্ষককে, তাঁর এই বিপুল বৈষম্যের কথা অজানা নয়। অজানা তাঁর এটাও নয় যে কলমের জোরে যখন তিনি সাহিত্য ও সাহিত্য পাঠের পুনঃমুল্যায়নের চাহিদা তোলেন, তখন তাঁর নিজস্ব শ্রেণিগত অবস্থান বা সামাজিক পুঁজির সম্বল বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়না। দায় কি তাহলে এতটুকুই? উদারবাদের অনিবার্য নিয়মে কমিউনিকেশনস-সফট স্কিলসের স্রোতে ভেসে যাওয়ার আগে মৃদু আপত্তি জানানো ছাড়া কি কোন রাস্তাই খোলা নেই ইংরেজি বিভাগগুলির সামনে? সেটা অবশ্যই সত্য নয়। ইংরেজি ও ভারতীয় মাতৃভাষার বিবাদ চর্চার সাথে সাথে এটা মনে রাখা দরকার যে ভারতবর্ষে টেকনিকাল এডুকেশন-প্রীতি ও মধ্যবিত্তের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা এমবিএ-বিবিএ-ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠের বাজারগুলির দৌলতে, কোটার মতন শহরে তৈরি হয়ে ওঠা সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার জোয়ারে, যা হয়েছে তাকে বলা যায় ভাষা শিক্ষা ও ভাষা চর্চার সার্বিক অবনতি ও অবমূল্যায়ন। ভাষা শিক্ষা কেবলই একটা 'সফট স্কিল' নয় —  শিক্ষার ভিত্তি ভাষা, উপলব্ধি এবং সমালোচনার মূলে রয়েছে ভাষা। আইআইটি প্রবেশিকায় ভাষাজ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হয়না অতএব ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন শুধুই কর্পোরেট জগতে কমিউনিকেশনের জন্য, বাজারের এই সুচতুর প্রচলনের ফলে এক অভূতপূর্ব অসাম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ভাষা শিক্ষার অবমূল্যায়নের পরিণতি হিসেবে তাই কয়েক প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রী আজ দামী ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও ভাষাহীন। ফেক নিউজের বন্যা বইয়ে দিয়ে তাঁদের সহজেই বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে নেহেরু, জিন্না ও শেখ আবদুল্লা একই পরিবারের সন্তান ছিলেন, হাতে একটা স্মার্টফোন থাকা সত্ত্বেও অল্টনিউজ বা বুমলাইভে গিয়ে তথ্য যাচাই করবার প্রয়োজন তাঁদের মনে আসেনা। নতুন দু হাজার টাকার নোটে ন্যানো জিপিএস চিপ যে থাকতে পারে, ভারতীয় অর্থনীতির এই ভয়াবহ দুর্দিনেও যে আচ্ছে দিন আসতে পারে, এই প্রসঙ্গে তাঁদের কোন মনে কোন দ্বিধা জন্মায় না। ভাষা শিক্ষার অবমূল্যায়নের অমোঘ পরিণতি অরাজনীতি ও অসাম্যের চাষ, তা সে ইংরেজি শিক্ষক যতই ক্লাসরুমে ক্যালিবানের ন্যায় সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর ভাষাতেই প্রভুকে অভিসম্পাত করায় ব্রতী হন না কেন।

১৯৭২ সালে নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তিনজন অধ্যাপক — জেমস গুগি (পরে ইনিই গুগি ওয়া থিওঙ্গো নামে খ্যাত হবেন), হেনরি ওউর-আনিয়ুম্বা, এবং টাবান লো লিয়ং — একটা লেখা প্রকাশ করেন যার শিরোনাম, "ইংরেজি বিভাগ বাতিলের প্রসঙ্গে"। সেই সময়ে তাঁরা বলেছিলেন, ইংরেজি বিভাগের থাকবার প্রয়োজন নেই, তার বদলে তৈরি হোক আফ্রিকান সাহিত্য ও ভাষা চর্চার বিভাগ। গুগিদের তোলা প্রশ্নগুলি সেই সময়ে অন্যান্য উপনিবেশ উত্তর দেশের মতন ভারতবর্ষের শিক্ষা জগতেও ছাপ ফেলে যায়, যেই কারণে হয়তো আজ ইংরেজি বিভাগের পাঠ্যক্রম ব্রিটিশ সাহিত্যের তথাকথিত 'ক্যাননের' বাইরে বেরিয়ে অন্যান্য ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের ধারার সাথে কথোপকথন করতে সক্ষম হয়েছে। নব্য উদারবাদের কানাগলিতে দাঁড়িয়ে ভাষা শিক্ষার এই ঘোর দুর্দিনে হয়তো ভারতবর্ষের ইংরেজি বিভাগগুলিতে আমাদের আবার প্রশ্ন করতে হবে, ইংরেজি বিভাগের থাকবার প্রয়োজন আছে কি? এবং যদি থেকেই থাকে, তা কেমন ইংরেজি বিভাগ? দিনের পর দিন সংস্কৃত/আরবি/ফার্সি ও আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগগুলি বাজারের চাহিদা মেনে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পথে এগোলে ইংরেজি শিক্ষক কি ক্ষমতার ভাষা আঁকড়ে বালিতে মুখ গুঁজে দিবারাত্র যাপন করবেন নাকি ভাষা চর্চার অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে জনমত তৈরি করবেন? ভারতবর্ষের ন্যায় বহুভাষী দেশের নতুন শিক্ষা নীতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভাষা চর্চার ভিত্তিপ্রস্তর গাঁথার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কি বলবে ইংরেজি বিভাগ? ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং (ইএলটি) প্রশিক্ষিত শিক্ষকের স্থায়ী নিয়োগের দাবী তোলা হবে, নাকি অস্থায়ী শিক্ষকের অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে তাঁকে বলা হবে যে ভাবে হোক সামাল দিতে, যেমনটা সাধারণত হয়ে থাকে? সাবভারশান — আবারও ইংরেজি শিক্ষকের পরিচিত ভাষায় বললে — তো কেবলমাত্র ভাষার অলঙ্কার, কেবলমাত্র ক্লাসরুমের চার দেওয়ালের মধ্যে করা এক ধরণের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-পদ্ধতি নয়, হতে পারেনা। ভারতবর্ষের ভাষা রাজনীতি ও ইংরেজি বনাম আধুনিক ভারতীয় ভাষার চলতে থাকা বিবাদ-বিতণ্ডা পাঠের সাথে সাথে যদি আজকের দিনে ভাষা শিক্ষার মূলে নেমে আসা আঘাতকে প্রতিহত করা সম্ভব না হয়, তাহলে কিন্তু হাতে পেনসিলটুকুই পড়ে থাকবে।

(লেখিকা ইংরেজি ভাষার অধ্য়াপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment