গেল বছর এরকম সময়েই এক সকালে টিভি, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে গিয়েছিল নামটায়। গ্রন্থন সেনগুপ্ত। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া একটা নাম। কলা বিভাগের ছাত্র হয়ে রেকর্ড নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ২০১৮-য় প্রথম হয়েছিল গ্রন্থন। গুচ্ছ গুচ্ছ সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানায়, সে ইতিহাস নিয়ে পড়তে চায়। উৎসাহী দর্শক-পাঠক জানলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি নাটক, গান, গিটার নিয়ে মেতে থাকে ছেলেটা। নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী বলেই বাঙালি তাকে মনে রেখেছে একটা বছর পরেও। এহেন 'ব্যতিক্রমী' যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রের সঙ্গে খানিক সময় কাটাল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।
উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়ার বিড়ম্বনা কতটা?
প্রথম হলেই একটা বাড়তি চাপ চলে আসে, সেটা সাংঘাতিক ব্যাপার। উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়ার পর আমি বুঝেছিলাম, সাফল্যটা যদি মাধ্যমিকে আসত, আমার কাছ থেকে আশেপাশের সব্বার প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যেত। সমাজ ভাবে যে একবার প্রথম হয়ে গেল, সে সারা জীবন প্রথমই হবে। এটা তো হয় না, হতেই পারে না। কিন্তু তাও মানুষের প্রত্যাশা আছে জেনেই একটা চাপ চলে আসে। এটাই বিড়ম্বনা। বাকিটা আমার কাছে প্রাপ্তি। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একজন ছাত্রের কাছে এটা খুব বড় পাওয়া। তাছাড়া ওই চাপটা কোথাও না কোথাও থাকে। বাবা মায়ের কাছ থেকে চাপটা কোনোদিন আসেনি। কিন্তু সমাজের প্রত্যাশা থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করি যতটা পারা যায়। মানুষকে এটার জন্য দোষও দেওয়া যায় না। কারণ এত মানুষ আমায় ভালবাসল, এটুকু যদি প্রত্যাশা তৈরি হয়, কীই বা বলব?
আরও পড়ুন: সাত রাজার ধন ‘দুই’ মানিক
পাবলিক ফিগার হওয়ার বোঝা বয়ে বেড়াতে কষ্ট হচ্ছে?
লোকে আমায় দেখছে, আমার ওপর স্পট লাইট আছে, এই ভাবনাটা আসার মতো ততটা পরিণত নই এখনও। কিন্তু হ্যাঁ, এটা বুঝি, ইলেভেন-টুয়েলভের কিংবা ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলে অনেক কিছু করতে পারে, আমায় দু'বার ভাবতে হয়। পাড়ায় কারোর সঙ্গে আগে দেখা হলে খুব বেশি কথা যে বলতে হবে অনিচ্ছে সত্ত্বেও, সেরকম বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু এখন সাইকেল থেকে নেমে একটু কুশল বিনিময় করতেই হয়, মন মেজাজ ভালো থাকুক চাই না থাকুক। কারণ শেষ এক বছরে এটা আমাকে বুঝিয়েই দেওয়া হয়েছে, সবার সাথে ঠিকঠাক কথা না বললে পরবর্তীকালে লোকজন বলবে, "ফার্স্ট হয়ে খুব অহঙ্কার হয়ে গেছে।" এই বিষয়গুলো ফার্স্ট না হলে আসতই না।
তবে খুব সচেতন আমি থাকি না। দেখো, অসামাজিক কোনও কাজ তো, যার ওপর স্পটলাইট আছে, এবং যার ওপর নেই, দুজনের কেউই করতে পারে না। করাটা কাম্য না। তাই সেদিকটা আলাদা করে ভাবতে হয় না। আর আমি যেটা বললাম, আমি খুব সচেতন থাকতেই পারি না। যদি থাকতাম, তাহলে হয়তো বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কোন পোশাক পরছি, কীভাবে চুল আঁচড়াচ্ছি, সেটাও আলাদা করে ভেবে বেরোতে হত।
পড়াশোনার পাশাপাশি নাটক, গান, বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছ তুমি। এই নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে, ছাত্রজীবনে এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকলে পড়াশোনা ব্যহত হয়। কী মত তোমার?
এটা খুব বহুমুখী প্রশ্ন। অনেকগুলো দিক আছে প্রশ্নটার। এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেই যে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হবে, তেমন কিন্তু না। হ্যাঁ অনেকেই নানা কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকলে পড়াশুনোয় একটু পিছিয়ে পড়েছে, সেটাও সত্যি। পাঠক্রমের বাইরে বিভিন্ন কাজ, ভালোবাসার, পছন্দের নানা বিষয় থাকা যে বাধ্যতামূলক সেটা আমি বলছি না। তবে কী হয়, মা বাবা বাড়তি কিছু চাপিয়ে দিলে মানসিক বিকাশে কোথাও একটা বাধা পড়ে। মানবিক গণ্ডী ছোট হলে পৃথিবীকে চেনা যায় না। নিজে কিছু ভাবতে যে পারে না, তাকে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে মা বাবা ভাবিয়ে দেবে। পরবর্তীকালে কিন্তু বিশাল সমস্যা হবে।
আমার ক্ষেত্রে আমার বাবা মা যে কোথাওই মানা করেনি, তা নয়। যেখানে মনে হয়েছে আমায় একটু নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে এক্ষেত্রে খুব দরকার সংযম। আমি যদি আমার পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে অথবা এক দিন আগে পড়াশোনা ছাড়া আমার পছন্দের আর যে জায়গাগুলো রয়েছে, সেগুলোর পেছনে সময় দিই, সেখানে আমার রেজাল্ট সাফার করবেই। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। সংযম হারিয়ে পরীক্ষা খারাপ হলে বাবা মায়েরা আশঙ্কা তো করবেই।
আরও পড়ুন: থিয়েটারে মুক্তধারা…রবীন্দ্র ঠাকুর!
তোমার সাফল্য আর পাঁচটা অভিভাবকের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে পেরেছে বলে মনে কর? মাধ্যমিকে মোটামুটি ভালো ফল করলেই বিজ্ঞান নিয়েই পড়তে হবে এই প্রবণতার কথা বলছি।
আমাদের সমাজে অভিভাবকদের দিক থেকে এই চাপটা থাকে, যে সায়েন্স নিয়েই পড়তে হবে। আমার রেজাল্ট যদি বাবা মায়েদের এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়, খুব খুশি হব। গত এক বছরে সেরকম খবর পাই নি। সমাজ তো একটা স্রোতে চলে, এখানে ব্যতিক্রম দুটো একটা আসতে পারে, কিন্তু স্রোতটাকে বদলানো খুব কঠিন। একে একে অনেক পাথর পুঞ্জীভূত না হলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয় না। আমার মতো একটা কাদা পাথর নদীর জলে ভেসে চলে যাবে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নদীর গতিপথটা বদলে দেওয়া। আমি কাউকে এগিয়ে বা পিছিয়ে রাখছি না, তবে এটা সত্যি, যারা তুলনামূলক কম নম্বর পায়, তারা কলা বিভাগে পড়ে। এটা নিয়ম হয়ে গেছে। এই ভালো নম্বর পেলে বিজ্ঞান, মোটামুটি নম্বর পেলে বাণিজ্য শাখা, আর একদম কম নম্বর পেলে কলা বিভাগেই পড়তে হবে, এই চিরাচরিত ধারাটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এবার কেউ যদি ডিলেমার মধ্যে থাকে, 'ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব, না ইতিহাস পড়ব?' তার মানে সে নিজে তার পছন্দের বিষয়ের প্রতি সৎ থাকতে পারছে না। পছন্দের বিষয়ের প্রতি সৎ থাকলে তা নিয়ে পড়া তো গণতান্ত্রিক অধিকার।
মেধার সঙ্গে আকাডেমিক রেজাল্টের সরাসরি কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে কর?
মেধা নির্ণয়ের পরিমাপটা ঠিক কী? তুমি কাকে এগিয়ে রাখবে, রবীন্দ্রনাথ না সত্যেন বোস? মেধা নির্ণায়ক মাপকাঠিটা সম্পর্কে আমার কাছে কোনও উত্তর নেই। আমার তো রবীন্দ্রনাথের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বলে তাঁকে কম মেধাবী মনে হয়নি কোনোদিন। আবার খুব ভালো নম্বর পেয়েছে, অথচ নিজের সম্পর্কে লিখতে বললে পাঁচ লাইন লিখতে পারে না, তাকে আমার মেধাবী মনেই হয় না। আর কীভাবে বুঝব আমরা কে মেধাবী আর কে না? ক্রিকেট কে ভাল খেলে, রান দেখে বোঝা যায়। কে ভালো ফুটবল খেলে, গোল দেখে বোঝা যায়, তাই আমরা ঠিক করে নিয়েছি নম্বর বেশি পেলে সে মেধাবী। গ্রেডিং ব্যবস্থায় আবার আরও মজার ব্যাপার। এত থেকে এতর মধ্যে পেলে গুড, কেউ এক্সেলেন্ট, কেউ আউটস্ট্যান্ডিং। এই যে আমরা ভেবে নিলাম অমুক এক্সেলেন্ট, তমুক গুড, তিরিশ বছর পরে হিসেবটা কি একই থাকবে?
মার্কশিট কতটা পরবর্তীকালে মেধা নির্ণয়ে কাজে লাগে সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। কিন্তু দিনের শেষে সমাজ ওই নম্বরটাই দেখা হয় বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায়।
স্কুল জীবন পেরিয়ে একটা নামি প্রতিষ্ঠানে পড়ার কী সুযোগ সুবিধে থাকে বলে তোমার মনে হয়?
আমার যেটা মনে হয়, ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়লে চোখটা খুলে যায়। স্কুলজীবনে ছোট্ট পরিসরে পড়াশোনা করে নিজেকে অনুধাবন করা যেত না এতদিন। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে কী হয়, ভালো লাইব্রেরি, ভালো ফ্যাকাল্টি আমাদের নিজেদের যাচাই করার সুযোগটা দেয়। তাতে, যে কিছু জানে না, তারও বেশি জানার আগ্রহ জন্মায়। যে বেশি জানে, তার আরও বেশি জানার খিদে তৈরি হয়। যাদবপুরে আসার আগে আমার ধারণা ছিল না, পড়াশোনার পরিবেশ কতটা স্বাধীন হতে পারে। এখানে কিন্তু শুধু নম্বর দেখা হয় না। প্রবেশিকা পরীক্ষায় যাচাই করে নেওয়া হয় ছাত্রছাত্রী তার পছন্দের বিষয় নিয়ে নিজের মতো করে ভাবতে পারে কি না। ভবিষ্যতে ওই নিজের মতো করে ভাবতে পারাটাই সবচেয়ে কাজে লাগে।
আরও পড়ুন: পকেটমারের কিসসা
রাজনীতি নিয়ে কী ভাবনা রয়েছে? ছাত্র রাজনীতি নিয়ে? বর্তমান সময় নিয়ে কী ভাবনা?
রাজনীতি একটা অনেক বড় শব্দ। আমাদের সমাজের চিরাচরিত একটা ধারণা আছে, রাজনীতি করলে কেরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আসলে এর পেছনে নেতিবাচক ধারণাই কাজ করে। একটা ছেলে বা মেয়ে রাজনীতি করলেই সমাজ ধরে নেয়, দুদিন পর ছেলেটা মার খাবে, তারপর জেল খাটবে, বড়জোর নেতা হয়ে গিয়ে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়বে। আসলে একটা নেতা যে মানুষের জন্য কাজ করবে বলে জনপ্রতিনিধি হয়েছে, এটা ভাবার আগেই মানুষ ভেবে নেয়, নেতা তো ঘুষ খায়।
আমি যেটা বুঝেছি, এই মুহূর্তে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে দাঁড়িয়ে, ছাত্ররা যদি আওয়াজ না তোলে তাহলে ভবিষ্যতে তাদেরই বিপদ। ছাত্র আন্দোলন নিয়ে সবাই যে নাক সিটকোয়, ইতিহাসে দেখলে দেখা যাবে, পৃথিবীর অনেক বড় বড় আন্দোলন ছাত্র আন্দোলন হিসেবেই শুরু হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলন আজকে নতুন হচ্ছে না। আবার ছাত্ররা আন্দোলন করলে তাদের টুঁটি চেপে ধরার প্রবণতাও আজকের নয়। তাই বলে কি ছাত্ররা আন্দোলন করা বন্ধ করে দেবে? অরাজকতা চলতে থাকলে কাউকে তো প্রতিবাদ করতেই হবে।
সোশাল মিডিয়া ব্যক্তিগতভাবে তোমায় বিপুল পরিচিতি দিয়েছে। কিন্তু মানুষকে সংগঠিত করতে, প্রতিবাদ গড়ে তুলতে সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা কী?
যখন আমরা সংগঠিত হয়ে কোনও কাজ করতে চাই, তখন জনসংযোগ রক্ষা করা খুব দরকার। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়া শুধু ডিপি পালটানো আর 'ফিলিং অসাম' স্ট্যাটাস দেওয়ার চেয়ে অনেক বড় কিছু করতে পারে। জলপাইগুড়ির একটা ছেলে বা মেয়ে মালদার ছেলেমেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে, আবার মালদার একজন কেউ খুব সহজে দিল্লির কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিবাদ সংগঠিত করা অনেক সহজ। তাছাড়া নাটকের প্রচার, মিছিলের প্রচার, সবই তো এখন সোশ্যাল মিডিয়া মারফত হচ্ছে। আমি বলছি না মানুষকে সংগঠিত করার একমাত্র হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া। তার জন্য লিফলেট, পত্রিকা, প্রচার অনেক কিছুই রয়েছে।
স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে এবার যারা বাইরের দুনিয়াটা দেখবে, তাদের কী পরামর্শ দেবে?
স্কুলের মধ্যে আমরা তো অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকি। যারা স্কুলজীবনে হস্টেলে থাকি না, তারা বাবা মায়ের সান্নিধ্যে থাকি। নিজের শহরে, পরিচিত মহলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরার সুযোগ পাই। পকেটও খুব বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করে না। ঠিক সময়ে শাসন করার মতো মানুষগুলো খুব কাছাকাছি থাকে। নিজের শহরের (যারা ছোট শহর বা মফঃস্বল থেকে বড় শহরে পড়তে আসে), নিজের স্কুলের একটা উষ্ণতা থাকে। সব মিলিয়ে একটা সুরক্ষার আবরণ থাকে। সেসব ছাড়িয়ে বাইরে এলে প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে সমস্যা হবে। আমারও হয়। সেটা খুব স্বাভাবিক। তো এই যে একটা শূন্যস্থান তৈরি হলো, সেই জায়গায় কলেজ জীবনে এসে একটা নিজের মনের মতো, পছন্দের বন্ধুর সঙ্গ বেছে নিতে হবে। যাদের সঙ্গে ওয়েভলেংথ মিলবে। আর নিজের কাজের প্রতি ফোকাস নষ্ট করা চলবে না।