কথায় বলে, অঙ্ক জটিল। তার চেয়েও ঢের জটিল রাজনীতির অঙ্ক। বিগত প্রায় দু'দশক ধরে ডানপন্থী রাজনীতির আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত মুর্শিদাবাদের 'মুখ' হয়ে উঠেছেন বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে এই রাজ্যই নয়, সম্ভবত সারা দেশে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পরেই, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে জয়ী অধীর তৃণমূল প্রার্থী ইন্দ্রনীল সেনকে সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেন। শুধু তাই নয়, ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে গেলেও তার ছাপ কার্যত পড়ে নি এই জেলায়।
তার পর থেকেই মুর্শিদাবাদ জয়ে তৃণমূলের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ান অধীর। এবার এই কাঁটা তুলতে কোমর বেঁধে নেমেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এর আগেই জেলায় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয় তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতা তথা রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে। ফলও মেলে হাতেনাতে। এক এক করে জেলার আটটি পুরসভা সহ অধীরের খাস তালুক বহরমপুর পুরসভা পর্যন্ত 'হাত' ছাড়া হয়। এতেও যেন সম্পূর্ণ হচ্ছিল না জয়, তাই তৃণমূলের পরবর্তী লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ান অধীরের তৈরি করা বিশ্বস্ত সেনাপতিরা। এবং সেখানেই মেলে সাফল্য।
এক এক করে জেলার উত্তর থেকে দক্ষিণে বহু বিধায়ক, মায় জেলা কংগ্রেস সভাপতি ও নওদার বিধায়ক আবু তাহের খান পর্যন্ত, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে যোগ দেন তৃণমূলে। এই ব্যাপারে অবশ্য তাঁর যুক্তি, "এলাকার মানুষ আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন উন্নয়নের জন্য, তাঁদের কথা মেনেই বৃহত্তর উন্নয়নের লক্ষ্যেই তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গী হয়েছি আমরা।"
অধীরের গড়ে রাজনৈতিক সমীকরণ বরাবরই একটু চমকপ্রদ। ১৯৫২ সালের সাধারণ লোকসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে পর পর ছ'বার বহরমপুর কেন্দ্রে জেতেন বাম শরিক আরএসপি-র প্রয়াত নেতা ত্রিদিব চৌধুরী। সেই সময় "মুর্শিদাবাদ মানেই আরএসপি, আরএসপি মানেই ত্রিদিব চৌধুরী," এই কথা প্রচলিত ছিল সকলের মুখে মুখে। সেই সময় বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকলেও সিপিএম-এর এই জেলায় প্রভাব ছিল আরএসপি-র তুলনায় নগণ্য।১৯৮৪-র লোকসভা ভোটে আরএসপি-র পরাজয় ঘটে, ঘুরে যায় মোড়। তবে তা সামলে, ফের ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত তিন বার বহরমপুর লোকসভা আসনে পর পর জিতে হ্যাট-ট্রিক করে ফেলেন আরএসপি-র প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু তার পর থেকেই রকেটের গতিতে মুর্শিদাবাদের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে উত্থান ঘটতে থাকে আজকের অধীর চৌধুরীর। ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু হয় জয়যাত্রা। এক সময়ের বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অধীর হয়ে ওঠেন এই জেলার কংগ্রেসের মুকুটহীন সম্রাট। টানা চারবার লোকসভা ভোটে জয়ী অধীরকে পরাস্ত করতে এযাবত বাম থেকে তৃণমূল, সকলেই ২০১৪-র নির্বাচন পর্যন্ত নিস্ফল হয়। আর সেখান থেকেই অধীর 'মিথ' এবারের লোকসভা নির্বাচনে হিমঘরে পাঠাতে পাখির চোখের চ্যালেঞ্জ নিয়েছে তৃণমূল।
মাইক্রো লেভেল থেকে ভিত তৈরি করেই ঘুঁটি সাজাতে মরিয়া তৃণমূল। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলার ৭০টি জেলা পরিষদের মধ্যে ৬৯টি গিয়েছে শাসকদলের দখলে। এবার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে অধীরের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ এবং বর্তমানে তৃণমূলের নবনিযুক্ত জেলা সভাধিপতি মোশারাফ হোসেন মধু। ভগবানগোলার বিভিন্ন গ্রামে লোকসভা নির্বাচনের জন্য দলের কর্মীদের তৈরী হওয়ার নির্দেশও দিচ্ছেন। জানান, "সামনেই লোকসভা নির্বাচনের মহারণ, তাই এখন থেকেই তৃণমূল স্তরে ভিত পোক্ত করাই আমাদের লক্ষ্য। এই জেলায় একটি নয়, তিনটি আসনই দখল করবে তৃণমূল বলে আমাদের বিশ্বাস।"
যাঁকে নিয়ে এত জল্পনা, সেই অধীর রঞ্জন চৌধুরীর সাফ কথা, "এই জেলা কংগ্রেসের ছিল, আজও আছে, আগামী দিনেও থাকবে। রাজনৈতিক লড়াইকে অধীর চৌধুরী কোনওদিন ভয় পায় নি, আজও পায় না, বাকিটা সময় বলবে। মানুষ তাঁদের সঠিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলে তবেই তো ভোট, নাহলে সেটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।"