সে এক দিন ছিল। খবরের কাগজগুলোর প্রায় সমস্ত অংশ জুড়ে থাকত কেবল শহর কলকাতার খবর। কলকাতার বাইরেও যে এক বৃহৎ বঙ্গ আছে তা কাগজওয়ালারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনতেন না। সব দেখেশুনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার সখেদে মন্তব্য করেছিলেন যে মফস্সলে বড় ধরণের মৃত্যুসংবাদই একমাত্র কাগজে স্থান পাওয়ার যোগ্য। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, কাগজগুলোতে নিয়ম করে জেলার জন্য পাতা বরাদ্দ হয়েছে আলাদা করে কিন্তু উত্তরবঙ্গের দশা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে এতদিন পরেও। সম্প্রতি ইসলামপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা অনেকদিন পর কাগজের শিরোনামে উঠে এসেছে, এসেছে দুঃখজনক মৃত্যুর বিনিময়েই।
কী কারণে কাগজের শিরোনাম হল ইসলামপুর? উত্তর দিনাজপুরের মহকুমা শহর ইসলামপুর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে এক মাঝারি মাপের গঞ্জ দাড়িভিট। সেখানকার কোএড উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় দু’হাজার। সেই স্কুলেই উর্দু এবং সংস্কৃত শিক্ষকের যোগদান নিয়ে গণ্ডগোল, স্কুল ভাঙচুর এবং শেষে গুলিতে রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মণ নামে দুই প্রাক্তন ছাত্রের মৃত্যুতে তোলপাড় গোটা রাজ্য। তাৎক্ষণিকতার এই সর্বনাশা যুগে সবাই নিজের নিজের মতো করে ঘটনার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। বলা বাহুল্য, রাজনীতিও জুড়ে গেছে ফেউয়ের মতো।
এখন প্রশ্ন উঠবে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হলে তো ছাত্রছাত্রীদের আনন্দিত হওয়ার কথা, অথচ তারা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করল কেন? বিভিন্ন কাগজের খবর পড়ে যা জানা যাচ্ছে তা সংক্ষপে এই - স্কুলটি বাংলা মাধ্যম ও উর্দু মাধ্যমের বিদ্যালয় হিসাবে সরকারিভাবে নথিভুক্ত থাকলেও বর্তমানে উর্দুভাষী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে জনা কুড়িতে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ওই স্কুলে মাধ্যমিকস্তরে উর্দু ও সংস্কৃতের দু’টি শূন্য পদ ছিল যদিও ওই স্কুলের উচ্চ মাধ্যমিকস্তরে এমন কোনও পদ ছিল না, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উর্দু বা সংস্কৃত পড়ানোও হত না। স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক নুরুল হুদাকে বার বার অনুরোধ করেছিল, উর্দুর বদলে বাংলা, ইতিহাস বা অন্য কোনও বিষয়ের শিক্ষকের জন্য। কিন্তু সেই অনুরোধ না মেনে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য উর্দু এবং সংস্কৃতের শিক্ষক স্কুলে যোগ দিতে গেলে গোটা স্কুল চত্বর রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। প্রচুর বহিরাগত মানুষ স্কুলে ঢুকে যথেচ্ছ ভাঙচুর শুরু করেন, ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুলিশ প্রবেশ করে, তারপর গুলি এবং মৃত্যু।
এই গোটা ঘটনা আমাদের সামনে একাধিক প্রশ্ন তুলে ধরে। প্রথমত যেখানে এখনও ওয়েবসাইটে নির্দিষ্টভাবে পাশ কোর্সের পদ হিসাবে উর্দু শিক্ষকের শূন্যপদটি দেখানো হচ্ছে সেখানে সেই পদে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষক নিয়োগপত্র হাতে পান কী করে? আসলে প্রথম যেদিন (১৮ সেপ্টেম্বর) শিক্ষকেরা স্কুল দেখতে এসেছিলেন সেদিনই তাঁরা যে উচ্চ মাধ্যমিকস্তরের শিক্ষক তা জানা গিয়েছিল। তাই নিয়ে গোলমাল হওয়ার পর জেলা প্রশাসন আপাতত শিক্ষক নিয়োগ স্থগিত রাখতে বলে। অথচ প্রশাসনকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে পরিচালন সমিতি পরের দিন ফের বৈঠকে বসে এবং মাধ্যমিকস্তরে শূন্য পদ দু’টি উচ্চমাধ্যমিকস্তরে পরিবর্তন করে দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু কোনও শূন্যপদের কনভার্সন (সে বিষয় পরিবর্তনই হোক বা স্তর পরিবর্তন) অত দ্রুত সম্ভব নয়। অথচ এই প্রস্তাব অনুযায়ী স্কুল পরির্দশকও রাতারাতি নির্দেশিকা বার করেন। ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ওই দুই শিক্ষককে ফের স্কুলে যোগ দিতে পাঠানো হয়। এই ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার যে গোটা বিষয়টায় প্রধান শিক্ষক, পরিচালন সমিতির সদস্যবৃন্দ এবং স্কুল পরির্দশক তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু তার থেকেও যেটা বড় প্রশ্ন সেটা হল কার বা কাদের নির্দেশে তড়িঘড়ি এই হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হল?
দ্বিতীয়ত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এতদিন ছাত্ররা অন্ধকারে ছিল কেন? সরকারি সাইট অনুযায়ী এই শূন্যপদ দু’টি সৃষ্টি হয়েছে ২০১৬ সালের আগেই, সেই অনুযায়ী উক্ত পদদুটিতে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকদের যোগদান করার কথা। কিন্তু ছাত্ররা হঠাৎ উর্দুর বদলে বাংলা বা অন্য শিক্ষকের দাবি জানাল কেন? বিদ্যালয়টি এখনও যখন উর্দু মাধ্যম (বাংলা মাধ্যমের সঙ্গে) এবং সেখানে এখনও যখন উর্দু পড়ুয়া আছে সেক্ষেত্রে তাদের বঞ্চিত করার অধিকার কারও থাকে কি? এই সূত্রেই সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিতে নেমে পড়েছে কিছু রাজনৈতিক দল এবং বাংলাপ্রেমী কিছু মানুষজন একে ‘ভাষা আন্দোলন’ হিসাবে চিহ্নিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এই উর্দু ‘বনাম’ বাংলার লড়াইয়ে সুকৌশলে আড়াল করা হচ্ছে সংস্কৃত পদে যোগদানকারী শিক্ষকের বিষয়টিকে। এই বছর উর্দু মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতে উর্দুর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পদে তালিকাভুক্ত হয়েছেন সাকুল্যে দশজন হবু শিক্ষকশিক্ষিকা (দাড়িভিট স্কুলে যোগদান করা মহম্মদ সানাউল্লা রহমানি আছেন তালিকার ছ’নম্বরে)। তাঁদের অপরাধটা কোথায়? তাঁরা সংখ্যালঘু বলে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলে ঘোলা জলে মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোনও সার্থকতা আছে কি? ওই স্কুলেই যোগদান করা সংস্কৃতের শিক্ষক তোরাঙ্গ মল্লিক (তালিকায় ২৩ নম্বরে আছেন) তফসিলি জাতিভুক্ত। ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর অন্যায় অভিযোগের পাশাপাশি অভিযোগকারীদের ‘দলিত বিরোধী’ অবস্থানটাও কি কারও চোখে পড়ছে না?
তৃতীয়ত কনভার্সনের প্রক্রিয়াটি অতি দ্রুত হলেও নিশ্চিতভাবেই ওই স্কুলের ১০০ পয়েন্ট রোস্টারের খাতাটিতে সেই অনুযায়ী পরিবর্তন না করা ইস্তক নবনিযুক্ত শিক্ষকদ্বয়ের যোগদানের বিষয়টি মঞ্জুর (অ্যাপ্রুভড) না হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্ট। সেই আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হলে তাঁরা প্রাপ্য বেতনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবেন। কতিপয় মানুষের তুঘলকি কারবারের জন্য এঁরা শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন কেন তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? আর যে ছাত্রছাত্রীরা তাদের স্কুলের পঠনপাঠনের উন্নতির জন্য আন্দোলন করছে তারাই আবার স্কুলের আসবাব ভাঙছে, নথিপত্র জ্বালিয়ে দিচ্ছে? সবকিছুই জলের মতন সোজা?
যথানিয়মে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল আসর গরম করতে নেমে পড়েছে। মৃত রাজেশ সরকারকে এবিভিপি-র সহ সম্পাদক এবং তাপস বর্মণকে সমর্থক বলে, বাংলার প্রথম দুই ‘ভাষা শহিদ’-এর মর্যাদা দিয়ে সরকারপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার সুযোগ তারা ছাড়তে চাইছে না। অন্যদিকে এদেরকে আরএসএস-এর লোক বলে সরকারও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। আর এত কিছুর মাঝে চাপা পড়ে যাচ্ছে মূল প্রসঙ্গ - শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুলিশের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশ এবং গুলিচালনায় অকালমৃত্যুর দুঃখজনক অধ্যায়।
আসুন সম্মিলিত প্রতিবাদ করি এই অন্যায়ের, পুলিশের গুলিচালনার, প্রশাসনিক অপদার্থতার। তার প্রতিকার না হওয়া পর্যন্ত অন্য প্রসঙ্গগুলো না হয় কিছুদিন অনুচ্চারিতই থাকুক।