Advertisment

ইহুদি স্কুলে পড়ছে মুসলিম পড়ুয়ারা, কলকাতার দুই জিইউশ শিক্ষাঙ্গনে সম্প্রীতির সহাবস্থান

দুটো স্কুলেরই কর্তৃপক্ষের দাবি, স্কুল ইহুদিদের হলেও এখানে বেশিরভাগ পড়ুয়াই কিন্তু মুসলিম।

author-image
suman Pal
New Update
Kolkata Jews school, kolkata, west bengal schools, Jews, Muslim students, কলকাতার ইহুদি স্কুল, ইহুদি স্কুলে মুসলিম পড়ুয়া

কলকাতায় ইহুদীদের সংখ্যা কমতে থাকায় প্রভাব পড়েছে স্কুলেও।

কলকাতা শহরে এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দু-দুটো ইহুদি স্কুল। একদিকে পার্ক স্ট্রিটে ইহুদি মেয়েদের বিদ্যালয় বা ‘জিইউশ গার্লস স্কুল’ আর অন্যদিকে বউবাজারে ছেলেদের বিদ্যালয় ‘ইলিয়াস মেয়ার ফ্রি স্কুল তালমাড অ্যান্ড তোরাহ্‌’। এই দুটো স্কুলেরই কর্তৃপক্ষের দাবি, স্কুল ইহুদিদের হলেও এখানে বেশিরভাগ পড়ুয়াই কিন্তু মুসলিম। এবং তাদের এই নিয়ে কোনওদিন কোনওরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাঝেমধ্যেই ইহুদি-মুসলিম সংঘর্ষের কথা উঠে আসে খবরের শিরোনামে। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের সংঘাতের কথা কে না জানে! কিন্তু সেখানে এই কলকাতাতেই, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ঠিক বিপরীত এবং এক বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান চোখে পড়ে।

Advertisment

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা পৌঁছে গিয়েছিল বউবাজারে ইহুদি ছেলেদের স্কুল ‘ইলিয়াস মেয়ার ফ্রি স্কুল তালমাড অ্যান্ড তোরাহ্‌’-তে। সেখানে স্কুলের পরিচালক রুবেন অ্যারনের সঙ্গে কথাবার্তায় উঠে এল নানা তথ্য। তিনি জানান প্রথমে এই স্কুলটার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৮১ সালে, বাগড়ি মার্কেটে ফায়ার টেম্পলের কাছে। পরে ১৯২৫-এ এই বউবাজারে স্কুলের ঠিকানা পরিবর্তিত হয়। তাঁর কথায়, “একদম প্রথম থেকে এই স্কুল ইহুদি ছেলেদের জন্যই উন্মুক্ত ছিল।” কিন্তু কবে থেকে এখানে অন্য সম্প্রদায়ের ছেলেরাও ভর্তির সুযোগ পেল? এর উত্তরে রুবেন বলেন, “প্রায় শেষ ৪০-৫০ বছর ধরে আমরা সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের ছেলেদেরকেই ভর্তি করছি।”

এমন সিদ্ধান্তের পিছনে কারণ বলতে গিয়ে রুবেন বলেন, “প্রথমত ইহুদি ছেলেদের সংখ্যা কমে আসছিল। এই স্কুলে এবং কলকাতা শহরেও। পড়ুয়া না পেয়ে একটা স্কুল উঠে যাবে এটা তো ঠিক নয়। তাই আমাদের এত পুরনো একটা স্কুলকে চালানোর জন্য পরিচালন সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় যে অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের ছেলেদেরও আমরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেব।”

এইভাবে ইহুদিদের এই স্কুল একটা অন্য উপায়ে বেঁচে গেল। কিন্তু স্কুলের কর্তৃপক্ষের কথা মতো, কলকাতায় ইহুদীদের সংখ্যা কমতে থাকায় প্রভাব পড়েছে স্কুলেও। রুবেন জানান, ১৯৯১ সালের পর থেকে এই স্কুলে আর কোনও ইহুদি ছেলে ভর্তি হয়নি। স্কুলের বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “এই স্কুলে এখন ৪৮০-৫০০ জন ছাত্র পড়ে এবং অধ্যক্ষকে নিয়ে মোট ৩৩ জন শিক্ষক আছেন। প্রত্যেক বছরই এই স্কুল থেকে বোর্ডের পরীক্ষায় ভাল ফল হয়। এখান থেকে পড়ে অনেকে আইনজীবী হয়েছে, আইপিএস. হয়েছে। মার্বেল প্যালেস মল্লিকবাড়ির ছেলে, শোভাবাজার রাজবাড়ি অর্থাৎ দেববাড়ির ছেলে এখান থেকে পড়াশোনা করেছেন।”

আরও পড়ুন পোশাকের মান নিয়ে অসন্তুষ্ট শিক্ষকরা, বিতর্কে স্কুলের নীল-সাদা ইউনিফর্ম

ধর্মীয় ভেদাভেদের কারণে কোনও সমস্যা হয় না? তার উত্তরে রুবেন বলেন, “এর কোনও প্রভাবই আমাদের ওপর এসে পড়েনি। সেরকম কোনও অসুবিধা হয়নি। স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রই মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও।” উল্টে তিনি স্কুলের একটা সুন্দর ঘটনার কথা তুলে ধরেন। কী সেই ঘটনা? রুবেন বলেন, “২০১৭ -র ডিসেম্বরে সিনাগগে আমাদের রিরেডিকেশান হল। সেখানে আমাদের বয়েজ স্কুল থেকে আমরা আমাদের ছাত্রদের দুটো ব্যাচ পাঠিয়েছিলাম ওই অনুষ্ঠানে ইহুদি গান গাওয়ার জন্য। সেই ব্যাচে মুসলিম ছেলেরাও ছিল, খুব কম সংখ্যায় কিছু হিন্দু ছেলেরাও ছিল। তারা সেখানে খুব আনন্দের সঙ্গে ইহুদি গান গেয়েছিল।”

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা কথা বলেছিল একজন অভিভাবকের সঙ্গে, নাম মুসার্‌রত্‌ পারভিন। তিনি বলেন, “স্কুলটা খুব ভালও, এখানে পড়াশোনা খুব ভাল হয়। পড়াশোনার কথা ভেবেই আমার ছেলেদের আমি এখানে ভর্তি করিয়েছি। অন্য কোনও ব্যাপারের কথা চিন্তা করিনি। আমার একটা ছেলে ক্লাস টুয়েলভ পাশ করে বেরিয়েছে, একজন ইলেভেনে আছে আর একজন ক্লাস ফাইভে এখানে পড়ছে।”

সবশেষে পার্ক স্ট্রিটের ‘জিউইশ গার্লস স্কুল’-এর কোষাধ্যক্ষ ব্রায়ান অকল্যান্ডের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সেই স্কুল এবং বউবাজারের ছেলেদের স্কুল উভয়ের সম্পর্কেই কিছু কিছু তথ্য দিলেন। ব্রায়ান জানান, মেয়েদের স্কুলটা আগে ছিল পোলক স্ট্রিটে, পরে পার্ক স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে এখন কোনও ইহুদি ছাত্রী বা শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই। বউবাজারের স্কুলের মতো সেখানেও বেশিরভাগটাই মুসলিম পড়ুয়া।

আরও পড়ুন করোনাকালে যাদবপুরে নম্বর বাড়িয়ে পাশ? বিরাট বিতর্কে বিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে

সেখানের পড়াশোনা ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ব্রায়ান বলেন, “বর্তমানে এখন সেখানে প্রায় ১৫০০ জন ছাত্রী এবং ৩৫-৪০ জন ফ্যাকাল্টি আছেন। আমাদের দুটো স্কুলই ICSE বোর্ডের সিলেবাস ও নিয়ম অনুসরণ করে। তাই দুটো স্কুলের পড়ুয়াদের আলাদা করে জুডাইজম পড়ানো বা সেরকম প্রভাব ফেলে এমন কোনও কার্যকলাপ করা হয় না। স্কুলে পড়ুয়াদের মধ্যে ব্যর্থতা নেই এবং শুধু মুসলিম নয়, হিন্দু, খ্রিস্টান-সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা আমাদের এই দুটো স্কুলে পড়াশোনা করে। এবং এখনও যদি কোনও ইহুদি ছেলে বা মেয়ে আমাদের এই স্কুলগুলোতে পড়তে আসে তাহলে তার জন্য আমরা বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারি।”

West Bengal school Communal Harmony Jews School
Advertisment