Advertisment

বেশিরভাগ ক্লাসই হয় ইংরাজিতে, যাদবপুর ছেড়েছেন অনেক পড়ুয়াই, এখন কী অবস্থা?

এখনও কি পড়ুয়ারা সেখানে ভাষাগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, নাকি এই অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। আসুন দেখে নেওয়া যাক এর হাল হকিকত।

author-image
suman Pal
New Update
Jadavpur University, Jadavpur, Education, College, Regional language, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর ছাড়ছেন পড়ুয়ারা, কলকাতা, শিক্ষা, পশ্চিমঙ্গ

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক স্তরে বেশিরভাগ ক্লাসই নাকি হয় ইংরাজি মাধ্যমে। গ্রাফিক্স- কাঞ্চন ঘোষ

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক স্তরে বেশিরভাগ ক্লাসই নাকি হয় ইংরাজি মাধ্যমে। যার ফলে কিছু ক্লাস করার পরেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে পড়ুয়ারা। পড়ুয়াদের মতে ঠিক কী হয়েছিল? এই ঘটনার পরে ওই বিভাগের পরিস্থিতি কেমন? এখনও কি পড়ুয়ারা সেখানে ভাষাগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, নাকি এই অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। আসুন দেখে নেওয়া যাক এর হাল হকিকত।

Advertisment

গত বছরেও আমাদের জীবন কেটেছে কোভিডের মধ্যে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ক্লাস ফ্রম হোম ইত্যাদি মাধ্যমেই চালিত হয়েছে আমাদের জীবন। এইভাবেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক স্তরে ভর্তি প্রক্রিয়া আর ক্লাস হয়েছিল অনলাইনেই। কিন্তু কাঁটা হল ইংরাজি মাধ্যমে পড়ানো। কিছু বাংলা মাধ্যম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের ইংরাজি ভাষা বুঝতে অসুবিধা হওয়াতে তারা একটা সেমেস্টার পড়ার পরেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়। চলে যায় অন্য বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে, অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে।

Jadavpur University, Jadavpur, Education, College, Regional language, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর ছাড়ছেন পড়ুয়ারা, কলকাতা, শিক্ষা, পশ্চিমঙ্গ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ছবি: ঔদার্য্য প্রামাণিক

এমনই কিছু পড়ুয়াদের মধ্যে একজন হলেন সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের কুমিরমারী গ্রামের প্রসেনজিৎ বিশ্বাস। প্রসেনজিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সে জানায় তার অভিজ্ঞতার কথা- “আমি যখন প্রথম ভর্তি হই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ঠিক জানতাম না যে সেখানে পড়ানোর সিস্টেম কী? এবারে ভালো নম্বর পেয়েছি, স্বাভাবিকভাবেই ইচ্ছা থাকে যে একটা ভালো জায়গায় পড়তে যাব। একটা ভালো জায়গায় ভর্তিও হয়ে গেলাম। সবকিছু ঠিক ছিল, কিন্তু তারপরে যখন ক্লাস শুরু হল, আমার মানে- প্রথম দিন যে ক্লাসটা করলাম সেটা করে আমি কিছু বুঝতেই পারিনি। ইংরাজিতে এতটাই আমি উইক, উইক বলতে আমার বুঝতে খুবই অসুবিধা হয়। প্রথমদিক থেকে গ্রামেই পড়াশুনা করে মানুষ তো, তাই যে সমস্যাটা হয় আরকি। সেই তুলনায় ওখানে পড়তে ঢুকে আমার খুবই সমস্যা হয়। দুজন ম্যাম ক্লাস নিচ্ছিলেন পুরো ইংরাজিতে। ম্যামদের দুটো বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করলাম পড়ব বলে তাঁরা ইংরাজি বইয়ের নাম বললেন। বললেন বাংলায় বই তো খুবই কম আছে আর যেগুলো তোমরা স্কুলে পড়ে এসেছ সেগুলো এখানে চলে না। দেখলাম, সবটাই ইংরাজিতে করতে হবে? ক্লাস ইংরাজিতে, নোট দিচ্ছে সেও ইংরাজিতে আবার কথা বলতে গেলেও ইংরাজিতে হলে ভাল হয়। বাংলায় কিছু জিজ্ঞেস করলে উনি শুনছেন কিন্তু ঠিক করে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আমি তাও দেখছিলাম, আশা ছিল হয়তো সমস্যার সমাধান হবে। এই ভেবে একদিন এক ম্যামকে জিজ্ঞেস করলাম যে এই অবস্থার থেকে কি কোনও উন্নতি হবে বা কোনও সুবিধা হবে? তো উনি বললেন- ‘খোকা তোমার যদি খুব অসুবিধা হয় তাহলে তুমি ছেড়ে দিতে পারো। তোমাকে তো আমি জোর করে বলতে পারি না যে তুমি থাকো, কেন না এখানে সবাই ইংরাজিতে ক্লাস নেয়।' তারপর আর কী করব অবশেষে ইতিহাস ছেড়ে বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশনে বাংলায় ভর্তি হলাম।"

আরও পড়ুন করোনা কালে বিরাট কাজ, সাফল্যের মুকুটে নয়া পালক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের

এমনই কিছু কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন ওই বিভাগ ছেড়ে বেরিয়ে আসা আরেক পড়ুয়া আলি হোসেন। জঙ্গিপুরের বাসিন্দা আলির বক্তব্য, “বাংলা মাধ্যম থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ফার্স্ট ইয়ারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অ্যাডমিশন নেওয়ার পর থেকেই আমি সেখানে একটা ভাষাগত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কোভিড পরিস্থিতির জন্য আমাদের অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে দেখি আমাদের বেশিরভাগ ক্লাসই নেওয়া হচ্ছে ইংরাজিতে আর আমাদের যে পিডিএফ মেটিরিয়াল দেওয়া হচ্ছে সেটাও ইংরাজিতে লেখা। আমি এবং আমার মতো আরও কয়েকজন একসঙ্গে রিকোয়েস্ট করেছিলাম যে আমাদের বাংলা ভাষায় কিছু মেটিরিয়াল দিন যাতে করে আমরা পড়তে পারি। কিন্তু তাতে কোনো সুরাহা হয়নি। ড. তিলোত্তমা মুখার্জি আমাদের মধ্যযুগের ইতিহাস পড়ানো শুরু করেছিলেন। ওনার লেকচারগুলো আমার বেশ শক্ত লাগত। যে ভাষা ব্যবহার করতেন তা খুবই কঠিন। আমি ম্যাডামকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম যে বাংলা ভাষায় একটু বলার বা পড়ার জিনিসপত্রগুলো দেওয়ার কিন্তু উনি কেমব্রিজ, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশ হওয়া বই আমাদের পড়াতেন বা পিডিএফ দিতেন। ইতিহাস বিভাগের সিট সংখ্যা ৭২, আমরা বেরিয়ে আসার পরে এখন তা ৪২-এ এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ওই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছি।”

এই বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসার সংগঠক আকাশ গুপ্ত অবগত ছিলেন। এইসব পড়ুয়ারা তাঁদের এই অসুবিধায় তাঁদের সাহায্য চান এবং তিনি তাঁর সংগঠন নিয়ে এদের পাশে দাঁড়ান। আকাশের বক্তব্য, “এটা প্যান্ডেমিকের সময়ে অর্থাৎ ২০২০-২১ এর ঘটনা। আমাদের কাছে এমন একটা খবর আসে যে, ইতিহাস বিভাগের স্নাতকে প্রথম সেমেস্টার থেকেই ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে থেকে ক্লাস করতে হচ্ছে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক একটা ক্লাস ইংরাজিতে হচ্ছে। পিডিএফের পর পিডিএফ এবং নোটস্‌ও যা আসছে সবই ইংরিজিতে আসছে। এর ফলে যাঁরা বাংলা মাধ্যম থেকে পড়াশুনা করে এখানে পড়তে এসেছে তাঁদের খুবই অসুবিধা হচ্ছে। তাঁরা প্রফেসরদের সঙ্গে বা সি.আর. দের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কিছুই রেসপন্স পাননি। তাঁরা সাহায্য চেয়ে আমাদের কাছে আসলে আমরাও তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছি। তাঁদের হয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউই খুব একটা তোয়াক্কা করেননি। আমরা পরবর্তীকালে এই বিষয়টা নিয়ে ডেপুটেশনও দিই যে, একটা ল্যাঙ্গুয়েজ সেল খোলা হোক। তাতে বাংলা এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় যাঁরা পড়তে চায় তাঁরা উপকৃত হবে। কিন্তু সেই নিয়েও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ইতিহাসের পাশাপাশি দর্শন বিভাগেও এই একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। আমরা জোর দিয়ে কয়েকটা বিভাগে ‘রেমেডিয়াল ক্লাস’ও চালু করিয়েছিলাম কিন্তু ইতিহাসে সেটাও হয়নি।”

এ প্রসঙ্গে বলা ভাল, শুধু ইতিহাস বিভাগেই নয় কলা বিভাগে অন্যান্য বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও প্রায় প্রত্যেকবছর এমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। ইতিহাস ছাড়া অন্য দুটো বিভাগের পড়ুয়াদের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কথা- “শুধু ইতিহাস বিভাগে নয় আমাদের এবং অন্যান্য বিভাগেও আমরা দেখেছি যে বিভাগীয় লাইব্রেরিগুলোতে ইংরাজি বইয়ের তুলনায় বাংলা বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। নতুন বাংলা বই নেই বললেই চলে যেগুলো আছে সেগুলো উনিশ বা বিশ শতকের পুরনো লেখকদের লেখা বই। উপরন্তু কয়েকজন প্রফেসর ছাড়া বাকিরা ইংরাজি মাধ্যমেই পড়িয়ে চলেছেন দিনের পর দিন।” দ্বিতীয় জন- “আসলে আমরা তো যাঁরা একেবারে বাংলা মিডিয়াম থেকে পড়তে আসি তাঁরা খুব একটা ভাল ইংরাজি জানি না ফলে ইংরাজিতে যে ক্লাসগুলো হয় সেগুলো বুঝতে সমস্যা হবেই। অনেকটাই অসুবিধা হয়, তবুও বাংলা ভাষায় কিছু মেটিরিয়ালস আছে যেগুলো একটু সুবিধা করে দেয়।”

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের এই ভাষাগত সমস্যার সম্মুখীন হওয়া, ইতিহাস বিভাগের পড়ুয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছাত্র-সংগঠনের সম্মিলিত দাবীদাওয়া এবং ওই বিভাগ থেকে কয়েকজন পড়ুয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার পরে এখন বিভাগের অবস্থান কী? সে বিষয়ে বিভাগীয় প্রধান ড. কৌশিক রায়ের বক্তব্য, “কোনও এক বাংলা খবরের কাগজ প্রথমে দাবি করেছে যে তারা তাদের সূত্র মারফত এই অভিযোগটির খবর পেয়েছে, অথচ আমাদের কাছে এমন কোনও ঘটনার মৌখিক বা লিখিত অভিযোগ আসেনি। যদি এমনই কোনও ঘটনা ঘটে থাকত তাহলে যাঁরা এই অভিযোগ তুলছে তাঁদের উচিত ছিল আগে বিভাগের কাছে আসা। তারপরে কোনও সুরাহা না হলে উচ্চতর পর্যায়ে বা সংবাদমাধ্যমে জানানো। এখানে আমার স্পষ্টভাবে দুটো জিনিস বলার আছে। প্রথমত, মৌখিক বা লিখিত কোনও মাধ্যমেই আমি ছাত্রদের কাছ থেকে এমন কোনও অভিযোগ পাইনি। দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে সত্যিই বাংলা বা হিন্দি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের এরকম কোনো সমস্যা হচ্ছে তাহলে তার জন্য আমাদের বিভাগে ‘রেমেডিয়াল ক্লাস’-এর ব্যবস্থা আছে। তাছাড়াও যখনই দেখা যায় যে ক্লাসরুমে বাংলামাধ্যম থেকে আসা পড়ুয়াদের সংখ্যা বেশি তখন আমি বা আমাদের বিভাগের অন্যান্য প্রফেসররাও ইংরাজির পাশাপাশি বাংলাতেও পড়ান। এছাড়াও যদি কখনও এমন কোনও অভিযোগ আমাদের কাছে আসে তাহলে সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য স্পেশাল ক্লাসের ব্যবস্থাও আমাদের আছে।”

Education Jadavpur University West Bengal
Advertisment