দেশের অর্থনৈতিকভাবে অভিজাত শ্রেণির অতি মাত্রায় ইংরেজি প্রীতির জন্যই সমাজের একটা বড় অংশ (ইংরেজিতে দক্ষ না হওয়ায়) ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ছে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একথাই জানানো হয়েছে ২০১৮ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতির খসড়ায়। তাই এর প্রতিশেধক হিসাবে ইংরেজির সঙ্গে বাধ্যতামুলকভাবে হিন্দি এবং অন্যান্য ভারতীয় (আঞ্চলিক) ভাষা পড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছিল প্রাথমিক খসড়ায়। কিন্তু, এই খসড়া আদপে 'হিন্দি চাপানোর গাজোয়ারি' এবং 'শিক্ষায় গৈরিকীকরণে'র প্রয়াস বলে সরব হয় দেশের শিক্ষা ও রাজনৈতিক মহলের একাংশ। এরপরই খসড়া সংশোধন করে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যে হিন্দিকে ঐচ্ছিক করা হয় এবং পড়ুয়াদের ভাষা বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তবে এই সংশোধনও আবার সর্বসম্মত নয় বলে সরব হয়েছেন শিক্ষানীতি প্রস্তুতকারী কে কস্তুরীরঙ্গন কমিটির অন্যতম দুই সদস্য শংকর কুরেল এবং কে এম ত্রিপাঠী। সামগ্রিকভাবে বিষয়টি নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষা মহলে। কিন্তু, এ বিষয়ে কী ভাবছে বাংলার শিক্ষা মহল? খোঁজ নিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-
অমল মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, প্রেসিডেন্সি কলেজ
"ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক। মনের ভাব বোঝানোর জন্য আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বারে ইংরেজিই একমাত্র ভাষা। যেহুতু উচ্চশিক্ষায় পৌঁছে, ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াশুনা করতে হয়, তাই পড়াশোনার প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজির ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত।
শিক্ষানীতির যে খসড়া প্রথমে পেশ করা হয়েছিল, তা মানতে নারাজ আমি। কারণ, এক্ষেত্রে হিন্দি ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার ভাবনাচিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে দেখা যায়, সরকার হিন্দি ভাষাকে ঐচ্ছিক করে দেয়। কিন্তু আমি মনে করি, প্রত্যেকেরই দু'টিভাষা অবশ্যিকভাবে জানা উচিত। এক নিজের মাতৃভাষা, দ্বিতীয় ইংরেজি ভাষা। হিন্দি ভাষা শিখবে কি না তার স্বাধীনতা ছাত্রছাত্রীদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত"।
কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, প্রেসিডেন্ট, অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (এবিটিএ)
মাতৃভাষার বিকল্প হয় না। মাতৃভাষায় আমি যা শিখছি তা বাড়ানো ও সমৃদ্ধ করার জন্যই মূলত ইংরেজি শিখে থাকি। উচ্চশিক্ষাতে প্রয়োজন ইংরেজি ভাষা, কারণ সেসময় ইংরেজি ছাড়া ভালো বই পাওয়া যায় না। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো আমাদের দেশের নিজস্ব ভাষা নেই, সেক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের ভাষা ইংরেজির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছি। তবে আমি মনে করি না ইংরেজি শেখা মানেই সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হবে। ইংরেজি একটা পড়াশোনার বিষয়। নিজের জ্ঞানকে সকলের সামনে তুলে ধরার মাধ্যম হল ইংরেজি। এমন বহু ছাত্রছাত্রী আছে যারা বাংলা মিডিয়াম থেকে পাশ করে আন্তর্জাতিক স্তরে সফল।
মাতৃভাষার ওপর জোর করে কোনো ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হলে তা অন্যায় করা হবে। ইংরেজি ভাষা বিভাজনের সৃষ্টি করেছে বলে যে সমস্যার কথা শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সমস্যা ত্রিভাষা তত্ত্বে বরং আরও বাড়বে, কমবে না।
শিক্ষাক্ষেত্রে গৈরিকীকরণের প্রচেষ্টা বহু দিন ধরে চলছে। শিক্ষায় স্বাধীন স্বত্বা থাকবে, ধর্মের শিক্ষার মধ্যে ঢুকে পড়া গুরুতর অন্যায়। কখনই মেনে নেওয়া যায় না। এই ভাবধারা কোনও জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
মনোজিৎ মন্ডল, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ইংরেজি ভাষা সমাজে প্রান্তীকিকরণের সৃষ্টি করে এবিষয়টি খানিক সত্য হলেও, একটা কথা বলতে পারি, চাইলেই ইংরেজি শেখা যায়। এটা একটা ভাষা মাত্র। আমি জঙ্গলমহলের বাসিন্দা, সেখানেই বড় হয়ে ওঠা। ক্লাস সিক্স থেকে ইংরেজি পড়া শুরু করি। তাই আমি মানতে নারাজ যে এটি সমাজে বিভাজন তৈরি করে। তবে ইংরেজি শিক্ষার বাড় বাড়ন্ত সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। প্রান্তিক মানুষের কাছে ইংরেজি পৌঁছে দিতে একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই পারবে। কিন্তু সেই পরিকাঠামো সরকার তৈরি করতে পারেনি। সম্পূর্ণটা রাজ্য সরকারের ওপর চাপালে চলবে না। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থা সংবিধানের যুগ্মতালিকায় রয়েছে। সেখানে ৫০ শতাংশ দায়ভার কেন্দ্রীয় সরকারের। ইংরেজি ভাষা শেখা আবশ্যক, কারণ এটি বিশ্বের ভাষা। সে জন্যই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভূত দায়িত্ব নিতে হবে।
কোনও ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। মাতৃভাষা শেখা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি কাজকর্ম, নিজের কাজের বিষয় ও পড়াশোনার ক্ষেত্রে শুরু থেকে ইংরেজি শেখায় মনোযোগ দেওয়া উচিত। হিন্দি শেখার ইচ্ছা থাকলে ভালো, কিন্তু শিখতেই হবে এই নিয়ম চালু করা উচিত হবে না। কারণ, হিন্দি ভাষার পরিবর্তে মানুষের অন্য কোনো ভাষা শেখার ইচ্ছা হতেই পারে। মাতৃভাষাকে পিছিয়ে দেওয়া, এটা মানুষ কোনো ভাবে মেনে নেবে না।
শিক্ষাক্ষেত্রে গত পাঁচ বছর ধরে গৈরিকীকরণ চলছে। যেকোনো ছাত্র-ছাত্রীর গবেষণার বিষয়কে জাতীয়তাবাদের বেড়াজালে আটকে দিয়েছে বর্তমান সরকার। অর্থাত্ৎ গবেষণার বিষয় হতে হবে তথাকথিত বেদ, মহাভারত, বেদান্ত অর্থাৎ ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কিত। তা না হলে গবেষণার বিষয়য়কে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ছেলে মেয়েদের গবেষণার ফেলোশিপও আটকে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আমরা আরও ভয় পাচ্ছি কারণ, আগামী দিনে এই সমস্যা আরও বেশি করে ঘণীভূত হতে পারে বলে মনে হচ্ছে।