বাংলা মাধ্যমের শিক্ষক নিয়োগের দাবিকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র হয়ে উঠল উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের দ্বারিভিটা উচ্চ বিদ্যালয় চত্বর। বৃহস্পতিবার আন্দোলনের নামে দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ হল ছাত্র-ছাত্রীদের।পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাতে হয় পুলিশকে। ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্রের। মৃতের নাম রাজেশ সরকার (২৭)।
অন্যদিকে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অপর এক ব্যক্তিকে তড়িঘড়ি নিয়ে আসা হয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রাতে সেখানে অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। তাঁর শরীরে গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে বলে জানা গিয়েছে। রাতেই আহতকে দেখতে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে যান বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁরা আহত যুবকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন। শুক্রবার সকালে আহত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
এই গুলি চালানোর বিষয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেছে পুলিশ। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন চারজন পুলিশকর্মী সহ মোট ১০ জন।
জানা গিয়েছে, ইসলামপুর ব্লকের দ্বারিভিটা উচ্চ বিদ্যালয়ে উর্দু মাধ্যমের কোনও ছাত্রছাত্রী না থাকলেও সম্প্রতি বিদ্যালয়ে দুজন উর্দু মাধ্যমের শিক্ষক ও একজন সংস্কৃত শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়। অথচ বিদ্যালয়ে প্রয়োজন রয়েছে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষকের। সম্প্রতি তার প্রতিবাদে এবং বাংলা মাধ্যমের শিক্ষকের দাবিতে পথ অবরোধও করেছিল স্কুলের পড়ুয়ারা। অভিযোগ, সেইসময়ে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে আপাতত স্কুলে উর্দু শিক্ষক আনা হবে না। এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে ওই উর্দু শিক্ষকদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্যে বিদ্যালয়ে আসতে বলেন কর্তৃপক্ষ। সেইমতো শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে আসেন।
এই ঘটনার প্রতিবাদেই স্কুল লাগোয়া রাজ্য সড়ক অবরোধ করে ফের বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে স্কুলের পড়ুয়ারা সহ স্কুলের প্রাক্তনীরা। ঘটনার খবর পেয়েই আইসির নেতৃত্বে ইসলামপুর থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের অবরোধ তুলে নেওয়ার আবেদন জানান। কিন্তু তারা অবরোধ তোলেনি। দীর্ঘক্ষণ রাজ্য সড়ক বন্ধ থাকায় ব্যাপক যানজট তৈরি হয়। এরই মাঝে পুলিশ জোর করে অবরোধ তুলতে গেলেই বাঁধে বিপত্তি। পুলিশকে লক্ষ্য করেই ইট বৃষ্টি শুরু হয় বলে জানা গেছে।
এরপরেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। কিন্তু তাতে অবস্থা আয়ত্তে আসার বদলে আরো ভয়ানক হতে শুরু করে। এরপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায়। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় রাবার বুলেট ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। এরপরে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় গোটা এলাকা। পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া শুরু হয়। ঘটনায় গুরুতর জখম হন চার পুলিশকর্মী। তাঁদের মধ্যে একজন মহিলা কর্মীও রয়েছেন। এরপরেই রাজেশ সরকারের গুলিবিদ্ধ দেহ উদ্ধার হয়। অভিযোগ, পুলিশের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর, যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করা হয়েছে।
ইসলামপুর ব্লকের দ্বারিভিটা উচ্চ বিদ্যালয়ের কাণ্ড নিয়ে কি বললেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়? pic.twitter.com/u2m4yZaZd9
— IE Bangla (@ieBangla) September 21, 2018
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, "এই ঘটনায় ডিআইকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বিজেপি ও আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। দোষী প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি হবে।" পার্থবাবুর দাবি, এই ঘটনার পিছনে ইন্ধন রয়েছে আরএসএসের। তিনি বলেন, "শিক্ষকদের আটকানোর অধিকার কারও নেই। ১৮ তারিখ থেকে যখন ঘটনার সূত্রপাত তখন স্কুল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের উচিত ছিল বিষয়টি আমাদের জানানো। পুলিশ-প্রশাসন বা ওই বিদ্য়ালয়ের প্রধান শিক্ষক কারও সঙ্গে আরএসএসের যোগাযোগ আছে কী না সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করব। মুখ্যমন্ত্রী বিদেশ থেকে নির্দেশ দিয়েছেন দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার। আমি কথা বলে যা বুঝেছি, হঠাৎ শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। আপাতত আমরা ডিআই প্রাইমারিকে দায়িত্ব দিচ্ছি।"
এ ঘটনার জেরে শুক্রবার জেলা জুড়ে ১২ ঘন্টার বন্ধের ডাক দিয়েছে বিজেপি। প্রতিবাদে ২২ তারিখ শনিবার রাজ্য জুড়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এসএফআই। ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে বিভিন্ন সংগঠন। গোটা ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছে সিপি আই (এম এল) লিবারেশন। সংগঠনের রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে অভিজিৎ মজুমদার বলেন, ‘‘ইসলামপুরে ন্যায়সংগত দাবিতে আন্দোলনরত স্কুলছাত্রদের উপর রাজ্য পুলিশের গুলি চালিয়ে ছাত্র হত্যার তীব্র নিন্দা করছি।’’
উত্তর দিনাজপুর জেলা বিজেপির সভাপতি শংকর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। এর বিরোধিতা করে আগামীকাল জেলা জুড়ে ১২ ঘন্টার বন্ধ পালন হবে।’’ এসইউসিআই-এর ছাত্র সংগঠন ডিএসও শুক্রবার এ ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে কালা দিবসের ডাক দিয়েছে। শুক্রবার বেলা ১২টায় মৌলালি থেকে মিছিলেরও ডাক দিয়েছে তারা। ঘটনা নিয়ে পুলিশ কিংবা স্কুল কর্তৃপক্ষ, কেউই মুখ খুলতে চাননি।