Advertisment

উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম কলাবিভাগের ছাত্র: বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় পশ্চিমবঙ্গ কোন অবস্থায়?

উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছে আর্টসের গ্রন্থন সেনগুপ্ত। বিজ্ঞানবিভাগের জয়জয়কার যখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে তখন এই ফল চমকে দেওয়ার মত। এই প্রেক্ষিতেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার খামতি নিয়ে আলোচনা করলেন সুইটজারল্যান্ডের লসনে ডিফারেনশিয়াল ইক্যুয়েশন নিয়ে গবেষণারত স্বর্ণেন্দু শীল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
science in bengali

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে লাগে কারণ বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা বলেই কিছু নেই।

উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম কলাবিভাগের ছাত্র

Advertisment

পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতেই গত কুড়ি বছরে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। শুধু ২০০৩-০৪ থেকে ২০১৩-১৪, এই দশ বছরেই এই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। শহর কলকাতা তো বটেই, পশ্চিমবাংলার ছোট-বড় নানান শহরে ব্যাঙের ছাতার মতই গজিয়ে উঠছে বেসরকারি ইংরেজি স্কুল, অন্যদিকে সরকারি বাংলা স্কুলগুলো ধুঁকছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনাই একরকম পাগলামির শামিল, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা তো দূর অস্ত। কিন্তু শেষ কয়েক দশকের এই ক্রমবর্ধমান ঝোঁক তথ্যে যত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, তার ছিটেফোঁটারও আভাস মেলে না এই সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা লেখালিখি তর্ক-বিতর্কে। এই ঝোঁক কতদূর নিছক সহজ বাস্তববুদ্ধির পরিচয় নাকি আসলে আত্মঘাতী প্রবণতা তা আলোচিত হওয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই জরুরি।

বিষয়টার একটা সমস্যা এর বহুস্তরীয় চরিত্র। একটা স্তরে এই আলোচনা শুধুই স্কুলস্তরের শিক্ষার মাধ্যমের প্রশ্ন, অন্য একটি স্তরে তা গণিত ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত সাধারণ মানুষের বোধগম্য ও পাঠযোগ্য লেখালিখি, অনুবাদ ইত্যাদির প্রশ্ন, আবার আরও একটি স্তরে তা পুরোদস্তুর বাংলায় বিজ্ঞান গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার প্রশ্ন। নিঃসন্দেহে এই তিনটে প্রশ্নই আলাদা আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। আবার প্রায়শই এগুলোর যেকোনটার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় অন্যগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাব। তাই তিনটে প্রশ্নকে মিলিয়ে সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও ভাষার প্রশ্নটার খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, তাদের আলাদা চরিত্রের কথা মাথায় রেখেই।

এর মধ্যে সবচেয়ে বুনিয়াদি প্রশ্ন অবশ্যই বাংলায় স্কুলস্তরে অঙ্ক-বিজ্ঞান শিক্ষার প্রশ্ন, বস্তুত স্কুলস্তরে যেকোন শিক্ষার প্রশ্নটাই। আজও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীর স্কুল শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, অথচ বাংলা মাধ্যম স্কুলের বেহাল দশা, কত স্কুলে শিক্ষকপদ ফাঁকা পড়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই, বাংলা পাঠ্যবই-এর দশা করুণের চেয়েও খারাপ। সবচেয়ে ভাল মানের বাংলা বইগুলোও বস্তুত ইংরেজি পাঠ্যবই-এর জঘন্য অনুবাদ। এই যেখানে বাস্তব পরিস্থিতি সেখানে সচ্ছল শহুরে অভিভাবকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দিকে ঝুঁকলে তাঁদের দোষ দেওয়া শক্ত।

কিন্তু তবু কিছু কথা থেকে যায়। প্রথমত, হাতে গোনা স্কুল বাদে এমনকি শহর কলকাতারও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পরিকাঠামোর অবস্থা একই রকম শোচনীয়, যা আছে তা চকচকে খোলস, তকতকে স্কুল বাড়ি, ওপরের চেকনাই। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষায় উন্নতি কতদূর সে নিয়ে সন্দেহের প্রবল অবকাশ আছে। দ্বিতীয়ত, শিশুকে তার মাতৃভাষায় শিক্ষার থেকে বঞ্চিত করা অন্তত একুশ শতকের পৃথিবীতে অপরাধের পর্যায়ে গণ্য হওয়া উচিৎ। ‘‘কিন্তু দিব্য তো ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীরা করে খাচ্ছে’’-এহেন যুক্তির মুশকিল হল যেহেতু কোন শিশু কী হতে পারত তার কোন নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি সম্ভব নয়, তাই এইরকম ব্যক্তিগত অ্যানেকডোট কিছুই দেখায় না। সারা পৃথিবীতে ভাষাশিক্ষার মাধ্যম নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে সবেরই সিদ্ধান্ত একই- মাতৃভাষার চেয়ে স্কুলশিক্ষার ভাল মাধ্যম আর নেই। এ বিষয়ে আফ্রিকা মহাদেশের অভিজ্ঞতা সম্ভবত সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক, কারণ আফ্রিকার বহু দেশে দীর্ঘদিন ধরে স্কুলশিক্ষা হয় ইংরেজি অথবা ফরাসিতে চলেছে, স্থানীয় ভাষাগুলোকে চরমভাবে অবহেলা করে। গোটা নব্বইয়ের দশক জুড়ে ও নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকে আফ্রিকার একাধিক দেশে একাধিক সমীক্ষা চলে, স্থানীয় আফ্রিকান ভাষাগুলোর বুনিয়াদি শিক্ষা ও স্কুলশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। সমীক্ষাগুলোর ফল এতই চমকপ্রদ যে ১৯৯৭-এ জিম্বাবোয়ের হারারে শহরে বহু আফ্রিকান দেশের নেতারা আলোচনায় বসে এক যৌথ প্রস্তাব গ্রহণ করেন যার মূল বক্তব্য যে তাঁদের দেশে এর পর থেকে স্থানীয় ভাষাতেই স্কুলশিক্ষা চলবে। ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের পাঠক্রমের সাথে যোগাযোগ গড়ে না-ওঠা ও তার ফলশ্রুতিতে বিপুল পরিমাণ স্কুল ড্রপ-আউট, তার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় বিদেশি ভাষামাধ্যমে শিক্ষা। বিশ্ব শিক্ষা মানচিত্রে তলানিতে পড়ে থাকা আফ্রিকার শিক্ষাব্যবস্থা তার পরের দুই দশকে প্রভূত উন্নতি করেছে, শুধু ভাষাই নয়, নানানরকম পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে কীভাবে শিক্ষার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সংযোগ আরও বাড়ানো যায়, তাই নিয়ে দেশগুলো গত দুদশক জুড়েই পথ দেখিয়ে আসছে। এই ঐতিহাসিক হারারে কনফারেন্সের দলিল আমাদের মত দেশের কাছে অমূল্য হতে পারত, কিন্তু চোখ-কান বন্ধ রাখলে কিছুই শেখা যায়না।

বিজ্ঞান ও গণিতশিক্ষায় ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাষামাধ্যম? TIMSS ও PISA, বিশ্বজুড়ে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের গণিত ও বিজ্ঞানে পারদর্শিতা মাপতে এই দুই সমীক্ষা চলে আসছে দীর্ঘদিন, তাতে ধারাবাহিকভাবে প্রথম সারিতে থেকে যাওয়া দেশগুলোর প্রায় সবকটাতেই, যেমন হংকং, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, স্কুলশিক্ষা হয়ে থাকে স্থানীয় ভাষায়। একমাত্র ব্যতিক্রম সিঙ্গাপুর, যার বুনিয়াদি শিক্ষার মাধ্যম স্থানীয় ভাষাগুলোই, কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিত ইংরেজিতে পড়ানো হয়। প্রসঙ্গত ভারত এই সমীক্ষাগুলোতে যোগ দেয়না, কেন্দ্রীয় সরকারের রঙ নির্বিশেষে, নিজেদের শিক্ষার বেহাল অবস্থা ঢাকতে। ২০০৯-এ শুধু তামিলনাড়ু ও হিমাচল প্রদেশ এই দুটো রাজ্য যোগ দেয় PISA র সমীক্ষায়, ফলাফল শিউরে ওঠার মত। ভারত ৭৪ টি দেশের মধ্যে শেষ থেকে দ্বিতীয় স্থানে ছিল।

বাংলায় স্কুলস্তরের শিক্ষার হাল ফেরানোই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন কাজ, কিন্তু এটাই আশু কর্তব্যও। ছাত্রছাত্রীদের গরিষ্ঠ অধিকাংশ স্কুলশিক্ষার গণ্ডি পেরোবে না অথচ গণিত ও বিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথম সারির দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখা মূর্খামি মাত্র।

বাংলায় পপুলার সায়েন্স এই প্রশ্ন মূলত সাধারণ বিজ্ঞানমনস্কতা ও ক্রিটিকাল চিন্তার বিকাশের পরিমণ্ডলের প্রশ্ন। বাংলাদেশে একটা পরিমাণে ব্যাপকহারে বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখালিখি চললেও পশ্চিমবঙ্গে এই ধারা অবলুপ্তির মুখে। ছোট ছোট পত্র-পত্রিকা যে একদম নেই তা নয়, কিন্তু তাতে গণিত বলতে কিছু ধাঁধা আর বিজ্ঞান বলতে কিছু সহজ এক্সপেরিমেন্টের চেয়ে বেশি কিছু প্রায় প্রকাশিতই হয় না। উচ্চতর গণিত বা বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখা হয় অনুপস্থিত অথবা ভুল বা অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যাসহ উপস্থিত, যা উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে কিনা বলা শক্ত। বিশ্বমানের পড়াশোনা ও গবেষণার জগত সম্পর্কে ধারণা আছে এমন লেখক- লেখিকারা নিজেদের বিষয় সহজ করে লিখছেন এমন প্রকাশনা বিরল। সম্প্রতি ইন্টারনেটের কল্যাণে কিছু ভাল মানের পপুলার সায়েন্সের পত্রিকা উঠে এসেছে, বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখালিখির ভাল বাংলা অনুবাদও কিছু প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু ছাপার অক্ষরে উপস্থিতি আজও প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। গড়পড়তা খবরের কাগজে বিজ্ঞান রিপোর্টিংয়ের বদলে রং চড়ানো গালগল্প লেখাই নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে। অথচ বাংলায় সহজ করে বিজ্ঞান লিখতে উৎসাহী ও বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালী ছাত্র-ছাত্রী-গবেষকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সামান্য উদ্যোগ ও আন্তরিক সদিচ্ছায় এই চিত্র অনেকটা পালটে ফেলা এখনি সম্ভব।

বাংলায় বিজ্ঞান গবেষণা ও গবেষণাধর্মী চর্চা গণিত ও বিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় সারা বিশ্বেই ইংরেজিই প্রধান ভাষামাধ্যম তা নিয়ে তর্কের অবকাশ আদৌ নেই, এমনকি ক্রমশ তা একমাত্র ভাষামাধ্যম হয়ে ওঠার পথেই এগোচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়। তাই বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে আদৌ কেন ভাবব - এই প্রশ্ন স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যিই কি বিষয়টা এতই সরল? পৃথিবীজুড়ে গবেষণা ইংরেজিতেই হচ্ছে প্রধানত, একথা ঠিক, কিন্তু কেন?

সেই কেনর উত্তরেই সম্ভবত লুকিয়ে এই যুক্তির ভ্রান্তিটা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনসংখ্যার বিচারের পৃথিবীর পাঁচ শতাংশ মাত্র, কিন্তু সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞান গবেষণার ৩৫ থেকে ৭৫ শতাংশ উৎপাদন হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (২০১২-র পরিসংখ্যান), যেখানে ইংরেজি একমাত্র ভাষা। এছাড়াও আছে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের উৎপাদন, যারও পরিমাণ আদৌ কম নয়। তাই গবেষণার সিংহভাগ যারা উৎপাদন করে, তাদের ভাষাই পৃথিবীতে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রধান ভাষা, নাকি ইংরেজি প্রধান ভাষা, তাই ইংরেজিভাষী দেশগুলো গবেষণার ক্ষেত্রে এগিয়ে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সামগ্রিকভাবে আমাদের বিজ্ঞানচর্চার ভবিষ্যতের স্বার্থে ভীষণই জরুরি।

দ্বিতীয়টা হলে ইংরেজি আপন করে নেওয়াই শ্রেয়, শুধু এখনকার স্বার্থে নয়, দূরের স্বার্থের কথা ভেবেও। আর প্রথমটা হলে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ভবিষ্যৎ নেইটা অত সহজে আর বলা যায় না। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে লাগে কারণ বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা বলেই কিছু নেই, বিজ্ঞান চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে পারলেই ভবিষ্যত্ও যে থাকতে পারে এ সম্ভাবনা তখন আর নাকচ করা যায়না। দ্বিতীয়টা যে নয়, অন্তত অনেকটাই নয় তার কিছু আভাস কিন্তু আছে। আমরা এখানে তার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট কয়েকটা বিষয় নিয়ে একটু ভেবে দেখব, যদিও বিষয়টা এর চেয়ে বৃহত্তর ও ব্যাপকতর আলোচনার দাবি রাখে।

আশির দশক পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্ব গবেষণা-মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য স্থানে ছিল, নব্বইয়ের দশক থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে, নানান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ মিলিয়েই। রাশিয়ান ভাষা ও সিরিলিক লিপিতে প্রকাশিত হওয়া গবেষণাপত্র ও গবেষণাপত্রিকা বা জার্নালের সংখ্যাও দ্রুতগতিতে কমে আসতে থাকে। সুনির্দিষ্ট তথ্য ও বিশ্লেষণের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও যে চিত্রটা পরিষ্কার, তা হল জনসংখ্যার বিচারে রাশিয়ান ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা বেশ কম হলেও সে ভাষায় বহুল পরিমাণে গবেষণাপত্র, গবেষণাপত্রিকা, উচ্চস্তরের বই প্রকাশিত হত। এ ব্যাপারে রাশিয়া ততদিনই উল্লেখযোগ্য স্থানে ছিল যতদিন বিজ্ঞান গবেষণার উৎপাদনেও তা প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে ছিল। বিজ্ঞান গবেষণাপত্রের এক তথ্যভাণ্ডার ওয়েব অফ সায়েন্সের নথিভুক্ত পত্রিকাগুলোর মধ্যে ১৯৪৫ থেকে ২০১৫-র মধ্যে রাশিয়ান ভাষায় প্রকাশিত গণিতের গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৭৩৯৮, ১৯৮৫ থেকে ২০১৫ র মধ্যে সেই সংখ্যা ৩৫৮১ আর ২০০৫ থেকে ২০১৫ র মধ্যে তা কমে ৩৩ টিতে ঠেকেছে। হ্যাঁ, ওয়েব অফ সায়েন্স এধরনের গবেষণাপত্রের একমাত্র তথ্যভাণ্ডার নয়, এমনকি গণিতের গবেষণাপত্রের জন্য সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য তথ্যভাণ্ডারও নয়, কারণ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার তুলনায় গণিতের গবেষণাপত্রের নথিভুক্তিকরণ বেশ কম এখানে, এমনকি সেই নথিভুক্তিকরণ বেশ কিছুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দিকে পক্ষপাতী এমন অভিযোগও আছে। তবুও এই সংখ্যাগুলো থেকে উঠে আসা ছবি সাধারণভাবেই প্রযোজ্য। একই তথ্যে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত গণিতের গবেষণাপত্রের সংখ্যাগুলি যথাক্রমে ২১৬৩৫, ১৫৪৪৫ ও ২২৯৪।

বিজ্ঞান গবেষণায় ভাষা যে বাধা নয়, বরং গবেষণার মানোন্নয়নে মন দিলে সংশ্লিষ্ট ভাষা বিশ্ব গবেষণা-মানচিত্রে ক্রমশ জায়গা করে নিতে থাকে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ চিন। গণিতের সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য তথ্যভাণ্ডার অ্যামেরিকান ম্যাথেমেটিকাল সোসাইটি পরিচালিত ম্যাথসাইনেট। তাতে নথিভুক্ত তথ্যের হিসেবে ২০০০ থেকে ২০১৫এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রের ভাষা ভিত্তিক মোটামুটি হিসেব (ইংরেজি বাদে): ম্যান্ডারিন (চিনা ভাষা) ৭০০০০, রাশিয়ান ৬৬০০০, ফরাসী ২১০০০, জাপানি ও স্প্যানিশে ৫০০০ করে, জার্মান ও ইতালিয়ানে ৪০০০ করে, পর্তুগিজে ১০০০। অথচ ভাষাভাষীর সংখ্যায় পৃথিবীতে সপ্তম ভাষাটিতে প্রকাশিত গবেষণা পত্রিকার সংখ্যা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়, বিশ্বমানের গবেষণা পত্রিকার সংখ্যা নিছক শূন্য। কেন?

এ কেন-র উত্তর পেতে সংখ্যার কচকচিতে না গেলেও চলে। মূল ভূখণ্ডের পশ্চিম ইউরোপের কোনও দেশে এমন একটাও বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে স্থানীয় ভাষায় গণিত বা বিজ্ঞানে ডক্টরেট থিসিস লিখে জমা দেওয়া যায় না, আর পশ্চিমবাংলায় এমন একটিও বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে এই বিষয়গুলোয় বাংলায় ডক্টরেট থিসিস লেখা যায়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যে ভাষাভাষী মানুষের লড়াইয়ের সম্মানে, এ তথ্য সেই ভাষাভাষী মানুষের জাতীয় লজ্জা। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে বাংলায় পড়ার ও পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। অথচ পশ্চিমবাংলার সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারাই প্রায় বাঙালি, বাংলা ভাষা বোঝেন না এমন শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন বা বহু সম্ভাবনাময় অবাঙালি গবেষক শিক্ষক-শিক্ষিকা পদের আবেদন করছেন, বাংলা ভাষায় থিসিস লিখতে দিলে তাঁরা আর আসতে নাও চাইতে পারেন, এমন পরিস্থিতি আজও নেই, অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার অবস্থাতেও নেই। বস্তুত এমনকি পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাঙালি শিক্ষক-শিক্ষিকা-গবেষকরাই রয়েছেন মূলত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় থিসিস লেখার সুযোগ দিতে শুধুই সদিচ্ছা বাদে আর কিছুরই প্রয়োজন নেই। তার বদলে কী পাচ্ছি আমরা? খাতায়-কলমে স্বীকার না করলেও প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিসের নানা অংশে ইংরেজি ভাষা প্যারাগ্রাফের পর প্যারাগ্রাফ হুবহু বিদেশি বই বা গবেষণাপত্র থেকে টুকে লেখা নেহাত জলভাত ব্যাপার। শিক্ষক-শিক্ষিকারা এব্যাপারে জেনেও গবেষণার মূল কাজটা টুকে না হলেই হল ভেবে চোখ বুজে থাকেন, কারণ জানেন যে ওইটুকু নিজের ভাষায় ইংরেজিতে লেখা ছাত্র-ছাত্রীদের সাধ্যের বাইরে। অথচ বাংলায় থিসিস লেখা চলবে না। দিনের পর দিন এই সংস্কৃতি চলে আসায় ঠিক কার লাভ, মা সরস্বতীই জানেন। ছোটখাটো ক্লাবে যেমন এক-দুজন সম্ভাবনাময় উঠতি ফুটবলার থাকলেও সবাই জানে যে তারা অচিরেই বড় ক্লাবে খেলতে চলে যাবে আর তারা ভবিষ্যতে ভাল খেলোয়াড় হলে ছোট ক্লাবের পড়ে থাকবে শুধু “জানিস অমুক আমাদের ক্লাবে প্রথম খেলতে শুরু করেছিল”-র করুণ আত্মশ্লাঘা - তেমনি যতদিন এই মানসিকতা চলতেই থাকবে, ততদিন বাঙালি হিসেবে আমরা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জোগাড়ে হয়েই থেকে যাব, আর বিদেশের নানান নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কত কত কৃতি বাঙালী আছেন এই ভেবেই আত্মপ্রসাদ লাভ করে যাব। বাংলায় বসে বাঙালির বিশ্বমানের গবেষণা আকাশকুসুম কল্পনাই থেকে যাবে।

তথ্যসূত্র:
১) ভারতে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রী সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের সূত্র: District Information System for Education (DISE) of the National University of Education Planning and Administration under the human resource development ministry.
২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণার পরিসংখ্যানসূত্র Xie Y, Killewald A. Is American Science in Decline? Cambridge, MA: Harvard Univ Press; 2012.
৩) ওয়েব অফ সায়েন্স ও ম্যাথসাইনেট-এ ভাষাভিত্তিক পরিসংখ্যানের মূলঃ https://mathoverflow.net/questions/219118/amount-of-math-research-published-in-other-languages

science
Advertisment