Advertisment

করোনাকালে যাদবপুরে নম্বর বাড়িয়ে পাশ? বিরাট বিতর্কে বিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে

সেসব পড়ুয়ারা নাকি পাশ করার পরে চাকরিও পেয়ে গেছেন!

author-image
suman Pal
New Update
students protest infront of bengal governor cv ananda bosein at jadavpur university, তাল কাটল যাদবপুরের সমাবর্তনে, রাজ্যপালের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ, হুলস্থূলকাণ্ড

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

সম্প্রতি বিভিন্ন সমাজ ও সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে একটা বিতর্ক। যেখানে বলা হচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কয়েকজন পড়ুয়াকে গ্রেস দিয়ে নম্বর বাড়িয়ে পাশ করানো হয়েছে। কোথাও এমনও কথা শোনা যাচ্ছে যে সেসব পড়ুয়ারা নাকি পাশ করার পরে চাকরিও পেয়ে গেছেন! আবার উল্টোদিকে ওই বিভাগের কিছু পড়ুয়ারা বলছেন যে এসব ভুয়ো খবর। যদিও সেসব পড়ুয়ারা এই বিষয়ে এর থেকে বেশি কিছু জানাতে সোজাসুজি অস্বীকার করে দেন। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কোনও দিক থেকেই তো কিছু শক্তপোক্ত কথা উঠে আসছে না, তাহলে ঘটনাটা আসলে কী? সরেজমিনে খোঁজখবর শুরু করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।

Advertisment

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. তরুণকান্তি নস্কর এমনই কিছু দাবি করছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে কিছু পড়ুয়াকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে তিনি বলেছেন, “প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় বহুক্ষেত্রেই পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা আরবিট্রারিলি ডিসিশন নিয়েছে। তারপরে যেটা সেশানাল আমরা বলি বা প্রাক্টিক্যাল/ ল্যাবরেটরি তা পাশ করতেই হয় এবং যদি কেউ ফেল করে বা অ্যাবসেন্ট হয় তাহলে সে পরের বছরে প্রমোশন পেতে যোগ্য নয়। এমন কিছু পড়ুয়াকে ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়েছে এবং আরবিট্রারিলি প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। আর তারপর বলা হয়েছে, ঐ সেশানালে পাশ না করিয়ে দিলে অনেকগুলো বছর নষ্ট হবে। এটা আমার সঙ্গে হওয়া একা একটা স্বতন্ত্র কেস নয় এরকম আরও ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে।”

এরপর অধ্য়াপক তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে এনে সাম্প্রতিক বিতর্কের দিকে আলোকপাত করেছেন, তিনি বলেন, “আমার ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে সেটা হল ছাত্রটি একদিনও ক্লাস করেনি, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ত কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ফলে তাকে আমি অ্যাবসেন্ট করে দিয়েছি। ফলে পাশ ফেলের বিষয় নেই, সে অ্যাবসেন্ট। সেই হিসাবে তাঁর ক্লাসে ওঠার কথা নয়। তার উপর ফোন কলের মাধ্যমে সে আমাকে হুমকি দিয়েছে। আমি সেটা ইউনিভার্সিটিকে লিখিতভাবে জানাই ২০২০-র ডিসেম্বরে। ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সঙ্গে সে ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের মিটিং করে তাকে শোকজ করে। সে ইউনিভার্সিটিকে যে উত্তর দিয়েছে তা আমার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। কারণ সে স্বীকার করেনি যে সে ভুল করেছে। ঘটনাটা ঘটেছিল ২০১৯ যখন সে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। তারপর তাকে চূড়ান্ত বর্ষ পর্যন্ত প্রমোশন দেওয়া হয়। যে ছাত্র কোনও ক্লাস করল না তাকে প্রমোশন দেওয়া হয় কী করে? উল্লেখ্য ওই বছর কিন্তু করোনা অতিমারি শুরু হয়নি।”

এ তো গেল অধ্যাপক নস্করের অভিযোগ। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ সেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনা নিয়ে কী বলছে? এ বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা কথা বলেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বর্তমান সহ-উপাচার্য চিরঞ্জিব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি এই বিতর্কে যাওয়ার আগে প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পরীক্ষা এবং উত্তীর্ণ হওয়ার পদ্ধতি নিয়ে বলেন, “আমাদের যেটা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং বা টেকনোলজি যেটাকে বলা হয় তাতে আমাদের যেটা সিস্টেম রয়েছে বিশেষ করে স্নাতকে, আমাদের দুটো ডিভিশন রয়েছে। একটা হচ্ছে প্রাক্টিক্যাল বা সেশানাল, আরেকটা হচ্ছে থিওরি পেপার। এবার থিওরি পেপারে আমাদের হচ্ছে পাশ মার্কস ৪০ শতাংশ। তাতে যদি কেউ কোনও একটা, ধরুন দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমেস্টারের কোনও একটি থিওরিতে পাশ করতে পারল না, তাহলে সে তখন কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সেমেস্টারের রেজাল্ট বেরোনোর পর একটা সাপ্লিমেন্টারি সুযোগ পাবে। তাতেও যদি পাশ না করতে পারে তাহলেও তার ২.২ মানে দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমেস্টার থেকে আবার তৃতীয় বর্ষের তৃতীয় সেমেস্টারে সে কিন্তু উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। মানে প্রমোশন কিন্তু আটকায় না। আবার তৃতীয় বর্ষের প্রথম সেমেস্টারে যখন পরীক্ষা হবে মানে যখন যে পঞ্চম সেমেস্টারের পরীক্ষা দিচ্ছে তখনও আবার ওই থার্ড সেমেস্টারের পরীক্ষাটা আবার দেওয়ার সুযোগ পাবে। তখনও যদি পাশ না করতে পারে তাহলে সে যখন সপ্তম সেমেস্টারে পড়বে তখন আবার ওই তৃতীয় সেমেস্টারের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে। মানে এইভাবে সেই পড়ুয়াটি কিন্তু লাগাতার সুযোগ পেতে থাকবে। এটা গেল থিওরির ক্ষেত্রে। তাই থিওরিতে যদি কেউ সাপ্লিমেন্টারি পায় তাহলে তার কিন্তু প্রমোশন আটকায় না।”

আরও পড়ুন বেশিরভাগ ক্লাসই হয় ইংরাজিতে, যাদবপুর ছেড়েছেন অনেক পড়ুয়াই, এখন কী অবস্থা?

বেশ এ তো গেল থিওরির কথা। কিন্তু এর সঙ্গে তো প্রাক্টিক্যালও আছে। ড. ভট্টাচার্য বলেন, “কিন্তু প্রাক্টিক্যাল বা যেটাকে আমরা সেশানাল বলি, সেশানালের ক্ষেত্রে পাশ মার্কস হচ্ছে কিন্তু ৫০ শতাংশ। এবার সেক্ষেত্রে ওখানে যদি কেউ ফেল করে, ধরুন কেউ দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমেস্টারে কোনও একটি প্রাক্টিক্যাল পেপার মানে সেশানাল পেপারে ফেল করল। তাহলে কিন্তু সে আর দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষে প্রোমোটেড হবে না। তাকে আবার দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে এসে সমস্ত কিছু আবার শুরু করতে হবে। একই নিয়ম একই বছরের দ্বিতীয় সেমেস্টারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাকেও আবার এক বছর রিপিট করে দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমেস্টার থেকে সবকিছু শুরু করতে হবে। এই সিস্টেমটা আমাদের রয়েছে।”

এরপরে তিনি আসেন এই বিতর্কটির ব্যাপারে। তিনি বলেন, “এইবার এই যে ছেলেটিকে নিয়ে একটা বিতর্ক হয়েছে, বলা যায় একটি বিশেষ কেসকে নিয়ে যে এই ছেলেটি সে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র এবং কম্পিউটার এইডেড ড্রাফটিং –এ আদতে কোনও ক্লাস করেনি এবং যথারীতি ফেল করেছিল। কিন্তু সে তখন দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমেস্টারে ছিল। ২০১৯-এ তখন হয়েছিল; ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে যখন তার সেই সেমেস্টারের ক্লাসটা হয়েছিল তখন সে সময়টা ছিল নন-কোভিড পিরিয়ড। এবারে যখন সে দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমেস্টারে তখন কিন্তু কোভিড এসে গেছে। এবার কোভিড এসে যাওয়াতে সেই দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমেস্টারের রেজাল্ট বেরিয়েছে অক্টোবর মাসে; অক্টোবর, ২০২০ তে। ইতিমধ্যে ইউজিসি-র একটা নোটিফিকেশন ছিল যে যেহেতু এরকমভাবে কোভিড মহামারী হয়েছে তাই অটো-প্রোমোশন চালু থাকবে। ইউজিসি-র এই অটো-প্রোমোশন এবং সময়সীমা সংক্রান্ত কিছু বিশেষ ছাড় চালু ছিল স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এম.ফিল., পি.এইচ.ডির জন্য। তো সেগুলো আমরা চাহিদা অনুযায়ী তাদেরকে সেই সুযোগগুলো দিয়েছি।”

এই অটো-প্রমোশনের ফল কী হল? ড. ভট্টাচার্য বলেন, “তো সে যাই হোক এই অটো-প্রোমোশন চালু থাকাতে সেই নিয়ম অনুযায়ী সে দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় বর্ষে অটো-প্রোমোটেড হয়ে গেল। ২০১৯-২০ -র দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ২০২০-২১ এর তৃতীয় বর্ষে সে প্রোমোটেড হয়ে গেল। কোভিড মহামারীর সময়ে ইউজিসি –র এই নিয়ম চালু থাকাতে এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ এও সে অটো-প্রমোটেড হল চতুর্থ বর্ষে। এবার ও কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সেমেস্টারে ওই একটা পেপারে পাশ করতে পারেনি, যেটা ছিল সেশানাল পেপার। যে হিসাবে ওর চতুর্থ বর্ষে ওঠারই কথা নয়। ওর আবার তখনই দ্বিতীয় বর্ষে ফেরত যাওয়ার কথা। কিন্তু ২০২২-এ ও পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় এসে গেছে, আউটগোয়িং স্টুডেন্ট। তখন এখানে একটা ‘Gross Departure from the rule’ হয়ে গেল। আর রুলটা হল কোভিডের জন্য। ফলে কোভিডের জন্য যেহেতু একটা এমন গ্রস ডিপার্চার হল তখন অবস্থাটা দাঁড়ালো যে সে যদি একশোতে কুড়ি পেয়ে থাকে, পাশ মার্কস পাওয়ার জন্য তার যা দরকার সেটাকে আমরা তখন দিয়ে দেওয়া হবে।

তবে এটা নাকি শুধু ওই একজনই নয়, আরও অনেক পড়ুয়াই এর ফলভোগ করেছে। ড. চিরঞ্জিব ভট্টাচার্যের কথায়, “এটা শুধু ওই পড়ুয়া নয়, মোট ১৪ জন পড়ুয়া ছিল এরকম। তাঁদেরকে আমরা সবাইকে যারা সেশানালে ফেল করেছিল আমরা ফ্ল্যাট, অর্থাৎ পাশ মার্কস পাওয়ার জন্য যাদের যা দরকার সেই অনুসারে নম্বর দিয়ে তাদের ৫০ শতাংশ নম্বর করা হয়েছিল।”

সবশেষে তিনি বলেছেন, “এটাই বলতে হয় পডুয়ার স্বার্থে, পড়ুয়ার ভালর জন্য এবারে আমরা ওকে একটা বছর নষ্ট করালাম না উল্টে আমরা ওকে পাশ করিয়ে দিলাম। নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও এরকম ছিল, কেউ যদি ৪০ পায় তাকে অতিরিক্তি ১০ নম্বর দেওয়া হয়েছে, কেউ যদি ২০ পায় তাকে ৩০ নম্বর দেওয়া হয়েছে। কারণ দেখুন ২০২০ বা ২০২১-এ যাঁরা পাশ করছে তাঁদের তো পরীক্ষা অনলাইনে নিতে হয়েছে। ফলে রেগুলার পেপারগুলোই শুধু নেওয়া গেছে, সাপ্লিমেন্টারি তো আমরা নিতেই পারলাম না। আগের রেজাল্ট দেরিতে বেরোনোর পর দেখা গেল অনেক সাপ্লি আছে, এত পরীক্ষা ওই কোভিড পিরিয়ডে কখন নেব? অনেক পড়ুয়ার যোগাযোগের সমস্যা আছে, অনেকের স্মার্টফোন নেই, অনেকের কাছে নেট ভরানোর পয়সা ছিল না। আমরা যতটা পেরেছি এসবের বন্দোবস্ত করে, পড়ুয়াদের হাতে এসব সুযোগ তুলে দিয়ে তাদের এই অতি প্রয়োজনীয়তার দিক বজায় রেখেছি।”

এ বিষয়ে ছাত্র সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন ‘ফেটসু’ (F.E.T.S.U.) কে যোগাযোগ করা হলে সংগঠনের চেয়ারপার্সন অরিত্র মজুমদার বলেন, “পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হবে তা ঠিক করার দায়িত্ব থাকে শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে সে বিষয়ে ইউনিয়ন অবগত নয়। তাই এ বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারব না।”

coronavirus Jadavpur University
Advertisment