Advertisment

এখানে এবারের ভোট জলের জন্য

এখানে মূলত আহিরওয়ারদের বাস। এঁদের ঝোঁক গেরুয়ার দিকে। ২০১৪ সালে বিজেপি এখানে জিতেছিল ২.১ লক্ষ ভোটে। 

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Water Crisis Heartland India

গুড়িয়াদের বাড়ির নিকটতম জলের কল ২ কিলোমিটার দূরে

ভয়ানক রোদ্দুর থেকে বাঁচাতে দুপাট্টায় নিজের মুখ আড়াল করে নেয় গুড়িয়া। গুড়িয়া আহিরওয়ার। বাড়ি থেকে দু কিলোমিটার দূরে তাদের নিকটতম জলের কল। সারাদিনে অনেকবার যেতে হয় জল ভরে আনতে। ১৮ বছরের গুড়িয়া ক্লাস টেন অবধি পড়াশোনা করেছেন। আরও পড়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর মা দিল্লি চলে গেছেন নির্মাণকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য। পড়া আর চালানো হয়নি গুড়িয়ার।

Advertisment

এখন তিনি জল আনেন, রান্না করেন এবং বাসন ধোয়ার কাজ করেন। তাঁর দুই ভাই কলেজ যায়। গত ৬ মে তিনি ভোট দিয়েছেন। এ ভোটের মাধ্যমে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে চান তিনি। তাঁর ভোট মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড এলাকায়, টিকরমগড় লোকসভা কেন্দ্রে। এখানে জল জীবন নির্মাণ করে।

"আমি চাই সরকার আরও ভাল কলেজ বানাক আর জল সমস্যার সমাধান করুক। আমি আরও পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখানে ছেলেরা জল আনে না। তাই আমাকে পড়া ছাড়তে হয়েছে।" কাছেই শিবরাজপুরা এলাকায় তাঁদের পরিবারের এক একর জমি আছে। এখানে একদা গম চাষ হত। এ জমি এখন খালি পড়ে আছে, ফুটিফাটা। টিকরমগড়ের খরা প্রবণ এলাকায় প্রকৃ্তির সঙ্গে লড়াই চালাতে হয় নিয়ত। গুড়িয়া বলছিলেন, তাঁর মাকে কাজের জন্য এলাকা ছাড়তে হয়েছে। "দিল্লিতে মা ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন। এখানে দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা।"

Water Crisis in India Hearland, Election 2019 ভোর চারটে থেকে শুরু হয় জলের জন্য লাইন। জল নিয়ে মারপিট এখানে স্বাভাবিক ঘটনা (ছবি- প্রতিবেদক)

গুড়িয়ার প্রতিবেশী সোনম যাদবের ভাগ্য গুড়িয়ার চেয়ে ভাল। গ্রামের মোট ১৫০০ বাসিন্দার মধ্যে তিনি একমাত্র মহিলা যিনি ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পৌঁছেছেন। "আমি নার্সিং পড়তে চাই, কিন্তু এখানে কোনও ভাল কলেজ নেই।" তিনি বলছিলেন, ছেলেদের যেমন এখানে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে, মেয়েদের তা নেই। উদাহরণ, সোনমেরই বন্ধু রিনা যাদব। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন রিনা, এ মাসেই তাঁর বিয়ে। রিনা বললেন, "বিয়ের পরেও আমায় একই কাজ করে যেতে হবে। সেই জল আনা, সেই সংসারের কাজ।"

২০০৯ সাল থেকে টিকরমগড় লোকসভা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে মূলত আহিরওয়ারদের বাস। এঁদের ঝোঁক গেরুয়ার দিকে। ২০১৪ সালে বিজেপি এখানে জিতেছিল ২.১ লক্ষ ভোটে।

Tikramgarh Rahul Gandhi রাহুল গান্ধীর টিকরমগড়ের সভা

নির্জলা বিকাশ

গুড়িয়ার পরিবারের সঙ্গে টিকরমগড় শহরের একটু তুলনা করা যাক। টিকরমগড় শহরে দু লক্ষ ভোটার রয়েছে। বিকাশ অর্থাৎ উন্নয়ন যে এখানে দ্রুত তাঁর ছোঁয়া দিয়ে গেছে, তা চোখ বোলালেই স্পষ্ট। ইটের বাড়ি, প্রাইভেট স্কুল, রেল স্টেশন সব রয়েছে এখানে। মধ্য প্রদেশের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা জিতু পুরী প্রচারে বেরিয়েছিলেন। "অল্পবয়সীরা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, প্রথমে শিক্ষার জন্য় তার পর কাজের জন্য়। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।" মেনেই নিলেন তিনি। রয়ে যাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। আর রয়ে যাচ্ছে গবাদি পশু।

এখানকার বাসিন্দারা বলছেন, জলাভাবই এ সমস্যার মূল। পাথুরে টিকরমগড়ে জলের মাত্রা ২০০৭ সাল থেকে নিম্নমুখী। ২০০৯ সালে ইউপিএ সরকার একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছিল, সে প্রকল্প এখনও বকেয়া। এলাকাবাসীরা বলছেন, একটা মেডিক্যাল কলেজের দাবিও ছিল এলাকায়। বকেয়া রয়েছে সেটিও।

টিকরমগড় জেলার মোট ৪০০টিরও বেশি গ্রামের জন্য রয়েছে ১২টি কলেজ। এর মধ্যে কেবল একটিতেই পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে। কলেজের প্রশাসক রবীশ আহিরওয়ার বলছিলেন, "৪৫০০ ছাত্রের মধ্যে ৪০ শতাংশ মেয়ে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাইনাল ইয়ারে উঠে পড়া ছেড়ে দেয়। হয় সংসারের কাজ নয়তো বিয়ের জন্য।"

পড়ুয়াদের অভিযোগ পড়াশোনার মান ভাল নয়, ফ্যাকাল্টিও স্থায়ী নয়। কিন্তু পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের পার্কিং লটে দাঁড়ানো বিকমের ছাত্র অখিলেশ যাদবের নির্বাচন সম্পর্কিত মতামত স্পষ্ট। "এখন আমি পড়ার জন্য ৪৫ কিলোমিটার যাতায়াত করি। আমার পরিকল্পনা এমবিএ করার, তার জন্য আমাকে সাগোর, ভোপাল বা ইন্দোর যেতে হবে। কিন্তু আমার প্রথম ভোট বিজেপিকেই। ওরা ক্ষমতায় আসার পর আমাদের গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইন-টেন হয়েছে।"

এবারে টিকরমগড়ে বিজেপির ৬ বারের বিধায়ক বীরেন্দ্র কুমার খটিকের সঙ্গে লড়াই হবে কিরণ আহিরওয়ারের। কিরণ কংগ্রেসের নবাগত প্রার্থী। রাজ্য়ে তিন দফায় শিবরাজ সিং চৌহানের নেতৃত্বে বিজেপি শাসনের পর এবার ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। লোকসভা ভোটের প্রচার চলছে নরেন্দ্র মোদী ও রাহুল গান্ধীর প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে।

ছাত্রছাত্রীরা বললেন, তাঁরা খবর দেখেন টিভি চ্যানেলে, 'যখন বিদ্যুৎ থাকে', এবং হোয়াটসঅ্যাপে। বিএসসি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী দীক্ষা জৈন বললেন, "আমি শুধু নরেন্দ্র মোদী আর রাহুল গান্ধীর কথা শুনেছি। মোদী অনেক শহরে এইমস এনেছেন। এখানেও যদি আনেন, তাহলে টিকরমগড়ের উন্নতি হবে।"

কলেজের বাইরে ভোপাল থেকে মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের মনোনয়ন কোনও ইস্যু নয়। কিন্তু ইস্যু হল গরু। দারিদ্র্যের বোঝা সয়েও অনেক কৃষকই তাঁদের গবাদি পশু ছাড়তে চান না। শহরে, কালেক্টরের অফিসের কাছে এক সেনার মূর্তির পাশেই স্থাপিত হয়েছে একটি গরুর স্ট্যাচু।

 উজ্জলা প্রকল্প আছে, গ্যাস ভরার টাকা নেই

শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে মাচি গ্রাম। সেখানে অর্ধেক বানানো বাড়িতে বাস কিরণ আদিবাসীর। তাঁর ঘরের কোণে গ্যাস সিলিন্ডারে ধুলো জমছে। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। উজ্জলা প্রকল্পের আওতায় গ্যাস পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গ্যাস কেনার টাকা নেই। কিরণ বলছিলেন, "প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি বানানোর জন্য আমি মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছি।"

সরকারি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় অন্তর্ভুক্তির যোগ্যতা রয়েছে  ৫১ হাজার মানুষের। টিকরমগড়ে বাড়ি বানানোর জন্য তাঁদের আড়াই লাখ করে টাকা পাওয়ার কথা। এর মধ্যে ২৯ হাজার ২০০ জন টাকা পেয়েছেন। কিরণের অভিযোগ, এ প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করতে স্থানীয় আধিকারিকদের "৩০০০০ টাকা কমিশন" দিতে হয়েছে।

কিন্তু তাঁর কাছেও ২০১৯-এর ভোট জলের ভোট।

বিজেপি প্রার্থী খটিকের বক্তব্য সুজারা বাঁধ প্রকল্প ৬০০ গ্রামে জল সমস্যা সমাধান করবে। তার মধ্যে পড়বে টিকরমগড়ও। তাঁর মেয়ে নিবেদিতার কথায়, "আমরা মানুষকে বলছি মোদীকে ভোট দিতে, উন্নয়নের লক্ষ্যে।"

কিরণ অবশ্য অনড়। "আমার স্বামী বিয়ের পর কাজের জন্য দিল্লি চলে গেছে। আমার সঙ্গে ওঁর বছরে একবার দেখা হয়। যদি এ গ্রামে জল থাকত, তাহলে এখানে উনি কৃষিকাজ করতে পারতেন, আমাদের তিন ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করতে পারতেন। সারা জীবন আমি জল সংকট নিয়ে বেঁচেছি। ২০১৪ সালে স্লোগান ছিল আব কি বার মোদী সরকার। এবার আমরা অন্য পার্টিকে সুযোগ দিতে চাইব।"

General Election 2019
Advertisment