নির্বাচনের সুর রবিবার কতটা সপ্তমে চড়ে সেই নিয়ে আলোচনা সর্বত্র। রবিবার ভোট কলকাতা এবং শহর সংলগ্ন দুই জেলার নয়টি আসনে। ১৯ মে সপ্তম দফায় ভোটগ্রহণ হবে দমদম, বারাসত, বসিরহাট, জয়নগর, মথুরাপুর, ডায়মন্ড হারবার, যাদবপুর, কলকাতা দক্ষিণ, কলকাতা উত্তরে। এই পর্বের নির্বাচনে সব ইস্যুকে ছাড়িয়ে সামনে চলে এসেছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা।
কিছুটা রাজনৈতিক স্বার্থেই অন্যান্য মনীষীদের স্মরণ করা হলেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বিশতবর্ষে সরকার বা বিরোধীপক্ষ, কারোই তেমন ভ্রূক্ষেপ ছিল না। নির্বাচনের শেষ দিন আসন বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় কী ঘটবে, সেই আশঙ্কায় রাজ্যবাসী। এই দফায় তিন জেলায় নটি আসনে শান্তিতে ভোট করানোই বড় চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কর্মীরাও পৌঁছে গিয়েছেন বুথে বুথে।
কলকাতা উত্তর
এই কেন্দ্রের প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে রোজ ভ্যালি কাণ্ডে গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। গ্রেপ্তারের পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অভিজ্ঞ এই রাজনীতিককে বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিনহা কতটা বেগ দিতে পারেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। তবে রাজনৈতিক মহলের ধারণা, কলকাতা দক্ষিণের চেয়ে উত্তরেই লড়াইয়ের ময়দানে তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে পদ্ম শিবির। এখানে সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা ঘোষও টানা প্রচারের মধ্যেই ছিলেন। তৃতীয় হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন তিনি। কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থী সৈয়দ শাহিদ ইমাম যত ভোট টানবেন তত লাভ হবে বিজেপির। এই লোকসভা কেন্দ্রের একটা বড় অংশে বাস অবাঙালী ভোটারদের। ওই অংশের ভোট পেতে মরিয়া বিজেপি। সারা রাজ্যে একমাত্র কলকাতা উত্তরে রোড শো করেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, বিদ্যাসাগরের মূর্তিও ভেঙেছে এই কেন্দ্রেই।
কলকাতা দক্ষিণ
রাজ্যের মধ্যে হাই প্রোফাইল কেন্দ্র। কিন্তু প্রার্থীর বিচারে অনেকটা প্রচারের আলো থেকে দূরেই ছিল কলকাতা দক্ষিণ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, দুই প্রার্থী তৃণমূল কংগ্রেসের মালা রায়, বিজেপির চন্দ্র বোস এই কেন্দ্রের ভোটার। মালা রায় কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন। ২০১৪-র নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের পরিবারের সদস্য চন্দ্র বোস। লড়াই এখানেও তৃণমূল বিজেপির মধ্যে। সিপিএম কলকাতা দক্ষিণে প্রার্থী করেছে নন্দিনী মুখোপাধ্যায়কে। মিতা চক্রবর্তী কংগ্রেসের প্রার্থী। গতবার কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে মালা রায় পেয়েছিলেন মাত্র ৯.৭১ শতাংশ ভোট।
দমদম
এই লোকসভা কেন্দ্রে ঘোর বাম জমানায় পর পর দুবার জয় পেয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী তপন সিকদার। পদ্ম শিবিরের সেই জয় নিয়ে সিপিএমে জোরদার বিতর্ক হয়েছিল। এবার ফের তৃণমূল জমানায় সেই পরিস্থিতি ফিরবে বলে আশা করছে গেরুয়া শিবির। দমদম লোকসভা কেন্দ্রে একাধিক বন্ধ কারখানা রয়েছে। সেই সব কারখানার শ্রমিকদের পরিবারের ভোট কোন দিকে যায় সেটা একটা বড় ফ্যাক্টর। গত দুবারের জয়ী তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায় এবারও লড়াইয়ের ময়দানে। বিপক্ষে বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য। বলিয়ে-কইয়ে হিসেবে শমীকবাবুরও যথেষ্ট নামডাক রয়েছে। সিপিএমের একসময়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্যও এই কেন্দ্রে প্রার্থী। তিনিও তৃণমূল এবং বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী সৌরভ সাহা। সিপিএম পুরোনো ঘোড়া নিয়ে আশার আলো দেখতে চাইছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, লড়াই এখানেও তৃণমূল বনাম বিজেপির।
বসিরহাট
বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী টলি অভিনেত্রী নুসরৎ জাহান, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে যাঁর নাম জড়িয়েছিল। ২০১৪-তে জয়ী ইদ্রিশ আলিকে এবার প্রার্থী করে নি তৃণমূল। তারকা প্রার্থীর বিপক্ষে বিজেপি প্রার্থী দলের সাধারন সম্পাদক সায়ন্তন বসু। বিরুদ্ধে অভিনেত্রী প্রার্থী হলেও লড়াইয়ের ময়দানে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ পদ্ম শিবির। ওদিকে বিশ্বের বহু দেশ ঘুরে বেড়ানো পল্লব সেনগুপ্তকে সিপিআই প্রার্থী করলেও বামেদের লড়াই এখানেও তৃতীয় স্থানের জন্য। গতবারও এই কেন্দ্রে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল বামেরা। সীমান্তের চোরাচালান এখানকার একটা বড় ইস্যু। পাশাপাশি সংখ্যালঘু ভোটও বড় ফ্যাক্টর। এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী কাজী আব্দুর রহমান।
যাদবপুর
সিপিএমের 'ভাল ফলের' তালিকায় রয়েছে যাদবপুর। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য দিনরাত এক করে প্রচার করছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। বোলপুরের বিদায়ী তৃণমূল সাংসদ অনুপম হাজরাকে যাদবপুরে প্রার্থী করেছে বিজেপি। প্রচারে তৃণমূল ও বিজেপি কেউই পিছিয়ে নেই। তবে লড়াই এখানে অনেকটাই ত্রিমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কংগ্রেস এই কেন্দ্রে কোনও প্রার্থী দেয় নি। গত নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের প্রার্থী হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুগত বসু।
ডায়মন্ড হারবার
সপ্তম দফার নির্বাচনে সকলের নজর এই কেন্দ্রে। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবারও ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী। বিজেপির পালে হাওয়া টানতে ডায়মন্ড হারবারে জনসভা করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গতবার এই কেন্দ্রে ৬০ হাজারের কিছু বেশি ভোটে জয় পেয়েছেন অভিষেক। এবার কিন্তু লড়াইটা একটু হলেও কঠিন। বিজেপির প্রার্থী নীলাঞ্জন রায়। প্রয়াত প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের পুত্র ফুয়াদ হালিমকে প্রার্থী করেছে সিপিএম। রাজনৈতিক মহলের মতে, মুসলিম ভোটের একটা অংশ ফুয়াদের ভাগে পড়তে পারে। কংগ্রেসের প্রার্থী সৌম্য আইচ রায়।
বারাসত
এই কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত বিধাননগর এবং রাজারহাট নিউটাউন বিধানসভা কেন্দ্র। দীর্ঘদিন ধরেই বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে দলে প্রশ্ন উঠেছে। তাঁর কিছু মন্তব্য বিতর্ক আরও বাড়িয়েছে। যদিও নির্বাচন প্রক্রিয়ার শেষ পর্বে অনেকটাই নীরব থেকেছেন তিনি। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বারাসত কেন্দ্রের জয়-পরাজয় এই দুই বিধানসভার লিডের ওপর অনেকটাই নির্ভর করতে পারে। সেই লিড কে পাবেন সেটাই মূল প্রশ্ন। তাছাড়া দলীয় অন্তর্কলহে অন্য ক্ষেত্রগুলোতে কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছেন বারাসত কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী কাকলি ঘোষদস্তিদার। বিজেপির স্থানীয় প্রার্থী মৃণালকান্তি দেবনাথ প্রচারে কোনও খামতি রাখছেন না। গতবারে এই কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লক। এবার ওই কেন্দ্রের বামপ্রার্থী হরিপদ বিশ্বাস কত ভোট পান সেটাই দেখার। এখানে কংগ্রেসের প্রার্থী সুব্রত দত্ত।
জয়নগর
তৃণমূলের সঙ্গে জোটে থেকে এখানে ২০০৯ সালে সাংসদ পেয়েছিল এসইউসি। এখন তাদের ভাঁড়ারে একজন বিধায়কও নেই। তবে এখানে প্রায় ১০ শতাংশ ভোট রয়েছে এসইউসির। গতবারের জয়ী প্রার্থী প্রতিমা মন্ডলকে এবারও প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। আরএসপি প্রার্থী সুভাষ নস্কর। বিজেপির অশোক কান্ডারী। কংগ্রেসের তপন মন্ডল। এসইউসিআইয়ের প্রার্থী জয়কৃষ্ণ হালদার। লড়াইয়ে এগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস।
মথুরাপুর
প্রবীণ রাজনীতিক চৌধুরী মোহন জাটুয়াকে এবারও প্রার্থী করেছে তৃণমূল। এই অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এখনও খামতি রয়েছে। জলের সমস্যাও রয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানোই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে রাজনীতির অভিজ্ঞতায় এগিয়ে জাটুয়া। একবার কেন্দ্রে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। প্রচারে খামতি রাখেন নি বিজেপির শ্যামাপ্রসাদ হালদার। সিপিএমের প্রার্থী শরৎচন্দ্র হালদার। কংগ্রেসের কীর্তিবাস সরদার।