দেশের গোবলয়ের তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে গেরুয়া ঝড়ের জেরে তাঁর দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। রবিবার এই তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল আসলে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলেরই ইঙ্গিত। কেন্দ্রে বিজেপির সরকারের হ্যাটট্রিকেরই ইঙ্গিত। রবিবার বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার পর দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতর থেকে বিরোধীদের এমনই বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
দায়িত্ব বেড়ে গেল
দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরে মোদী বলেন, 'আজকের বিজয় অভূতপূর্ব। আজ সবকা সাথ সবকা বিকাশের জয় হয়েছে। শিক্ষিত ভারত, আত্মনির্ভর ভারতের সংকল্প জয়ী হয়েছে। বঞ্চিতদের জয় হয়েছে। ভারতের বিকাশের জন্য রাজ্যের বিকাশ জরুরি, এই ভাবনার জয় হয়েছে। আজ সততা, সুশাসনের জয় হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের জনতা বিজেপির প্রতি তাঁদের স্নেহবর্ষণ করেছেন। তেলেঙ্গানাতেও বিজেপি সমর্থকের সংখ্যা বাড়ছে। আমার মনে হল, আমার দায়িত্ব যেন বেড়ে গেল।'
জাতিবাদের বিরুদ্ধে চার জাতি
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'মা, বোন, যুবক ভাইদের কাছে, কৃষক, শ্রমিকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাই। এই নির্বাচনে দেশকে জাতিবাদে বণ্টনের চেষ্টা হয়েছিল। আমার কাছে দেশে চারটি জাতি আছে। তা হল, নারীশক্তি, যুবশক্তি, কৃষক এবং গরিব পরিবার। এদের শক্তিশালী করা হলেই দেশ শক্তিশালী হতে পারে। আমাদের ওবিসি, আদিবাসী সঙ্গীরাও এই চার জাতির মধ্যে পড়ে। নির্বাচনে এই চার জাতি বিজেপির সম্পর্কে উৎসাহ দেখিয়েছে। আজ প্রত্যেক গরিব বলছে, সে জিতেছে। আর প্রত্যেক বঞ্চিত বলছে, সে জয়ী হয়েছে। আজ প্রত্যেক কৃষক বলছে, সে জয়ী হয়েছে। আজ প্রত্যেক আদিবাসী বলছেন, তিনি জয়ী হয়েছেন। আজ প্রত্যেক প্রথমবারের ভোটার বলছেন, তিনি যাঁকে ভোট দিয়েছেন, তিনিই জয়ী হয়েছেন। যাঁরা ২০৪৭ সালে দেশকে বিকশিত দেখতে চান, তাঁরা আজ খুশি।'
দেশের নারীশক্তি
মোদী বলেন, 'দেশের নারীশক্তি সুরক্ষা কবচ হয়ে উঠলে, কেউ সেই সুরক্ষা ভাঙতে পারে না। দেশের মা-বোন-কন্যারা আজ মনে করছেন, বিজেপিই নারীসম্মানের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি। তাঁরা দেখেছেন, গত ১০ বছরে বিজেপি পানীয় জল, নিকাশি, গ্যাস থেকে যাবতীয় ক্ষেত্রে লাগাতার কাজ করেছে। নারীশক্তির আর্থিক বিকাশে বিজেপির সরকার কাজ করেছে। নারীশক্তির বিকাশে বিজেপি কাজ করে চলেছে। সেই সব কারণে, নারীশক্তি এই নির্বাচনে বিজেপিকে আশীর্বাদ করেছেন। আমি দেশের নারীশক্তিকে বলব, আমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা পূরণ করেছি। এটা মোদীর গ্যারান্টি। অর্থাৎ, গ্যারান্টি পালন করার গ্যারান্টি।'
যুবশ্রেণি সম্পর্কে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'দেশের যুবশ্রেণি স্রেফ বিকাশ চায়। রাজস্থান, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানার সরকার যুবশ্রেণির বিরুদ্ধে কাজ করেছে। নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে। তার ফলে, এই তিন (বিরোধী) সরকারেরই পতন ঘটেছে। দেশের যুবশ্রেণি বুঝতে পেরেছে, বিজেপির সরকার মানেই যুবহিতৈষী। এই সরকার যুবকদের জন্য নতুন রাস্তা খুলে দেয়। আজ দেশের আদিবাসী সমাজ নিজেদের কথা বলতে পারে। এই আদিবাসী সমাজকে কংগ্রেস সরকার সাত দশক ধরে পিছিয়ে রেখেছিল। আজ দেশের আদিবাসী সমাজের সংখ্যা ১০ কোটি। আমি গুজরাতেও দেখেছি যে, আদিবাসী সমাজ গুজরাতে কংগ্রেসকে সাফ করে দিয়েছে। একইভাবে রাজস্থানেও তারা কংগ্রেসকে সাফ করে দিল। আদিবাসী সমাজ বিকাশ চায়। তারা মনে করছে, একমাত্র বিজেপিই তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে।'
বিজেপি কর্মীদের প্রশংসা
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বিজেপি কর্মীদের আমি প্রশংসা করব। বিজেপি কর্মীরাই প্রতিটি পরিবারের কাছে সরকারের কাজের সুফল পৌঁছে দিয়েছেন। আমি নাড্ডাজিরও প্রশংসা করব। নির্বাচন চলাকালীন তাঁর পরিবারে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। তার পরও তিনি দলের সাধারণ কর্মীর মত কাজ করে গিয়েছেন। আমি বিজেপি কর্মীদের বলব, নমো অ্যাপে গিয়ে অন্তত ১০ জনকে বিকশিত ভারতের সঙ্গে যুক্ত করুন। বিজেপি কর্মীদের দায়িত্ব বেড়েছে। কারণ, নেতিবাচক শক্তিগুলো একজোট হয়েছে। তাদের মোকাবিলা করতে হবে। তাদের নেতিবাচক শক্তির জবাব দিতে হবে। জনতার বিশ্বাস বজায় রাখতে হবে। যাঁদের এখনও আমাদের প্রতি সন্দেহ আছে, তাঁদের কাছে পৌঁছতে হবে।'
সাইক্লোন সম্পর্কে বার্তা
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমি আজ টিভির পর্দায় বেশি নজর দিতে পারিনি। বরং, বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত সাইক্লোনের প্রভাব সম্পর্কেই জানতেই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। বিজেপি কর্মীরা এই সাইক্লোনের পরিস্থিতিতে নাগরিকদের পাশে থাকুন। প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। সেটাই একজন সংগঠনের কর্মীর প্রধান কাজ।'
রাজ্যগুলো সম্পর্কে
যে তিন রাজ্যে বিজেপি জিতেছে সেই সব রাজ্যগুলোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমি আমার এত বছরের রাজনৈতিক জীবনে কখনও ভবিষ্যবাণী করি না। কিন্তু, এবার রাজস্থানে গিয়ে আমি বলেছিলাম যে বিজেপিই জিতছে। মধ্যপ্রদেশের জনতাকে অভিনন্দন জানাই। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বিজেপি ক্ষমতায় আছে। তারপরও বিজেপি জিতছে। আমি ছত্তিশগড়ে গিয়ে প্রথম সভাতেই বলেছিলাম, জয়ের জন্য অভিনন্দন। ছত্তিশগড়বাসী সেই কথা রেখেছেন। তেলেঙ্গানাবাসীকে ধন্যবাদ। লাগাতার তেলেঙ্গানায় বিজেপির প্রতি সমর্থন বাড়ছে। আমি তেলেঙ্গানার উন্নয়নেও আগামিদিনে জোর দেব।'
বিশ্বকে বার্তা
মোদী বলেন, 'এই নির্বাচনের ফলাফল বিশ্ববাসীর কাছে বার্তা। বিশ্ববাসী দেখছেন যে ভারতে স্থায়ী সরকার রয়েছে। দেশবাসী সেই স্থায়ী সরকারের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। আমাদের মূল মন্ত্রই হল- দেশের স্বার্থে নীতি ও নির্ণয়।'
বিরোধীদের আক্রমণ
বিরোধীদের আক্রমণ করে মোদী বলেন, 'লোভ লালসা দেশবাসী পছন্দ করেন না। তাঁরা বিশ্বস্ত কাউকে চান। দেশের জনতা জানেন, রাজ্যের অগ্রগতি ঘটলে দেশেরও অগ্রগতি ঘটে। দেশবাসী বাতাসে কথা ভাসিয়ে দেওয়ায় বিশ্বাস করেন না। অনেকে তো বলছেন, আজকের ফলাফল ২০২৪ সালের ইঙ্গিত। দেশবাসী দুর্নীতি, পরিবারবাদের চূড়ান্ত বিরোধী। যাঁর এইসব দুর্নীতিবাজ এবং পরিবারবাদের সমর্থক, তাঁদের প্রতিও বার্তা পাঠাল দেশবাসী। এই নির্বাচনী ফলাফল বুঝিয়ে দিল, পরিবারবাদ করে দেশের মন জেতা যায় না। দেশের মন জিততে হলে দেশবাসীর সেবা করতে হয়। নেতিবাচকতা, অহংকারী মনোভাব সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে আসতে পারে। কিন্তু, দেশবাসীর মন জিততে পারে না। আমি দেশের গরিব মানুষের উন্নয়ন করলে, দেশের উন্নয়ন করলে কংগ্রেস ও তাদের সঙ্গীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। আজকের ফলাফল এই সব দলগুলোর প্রতি বার্তা। যা বলতে চেয়েছে, কেন্দ্রের পাঠানো তহবিল আর জনতার মধ্যে বিভাজন হয়ে উঠবেন না। বিভাজন হয়ে উঠলে, জনতাই সেই বিভাজন দূর করে দেবে।'
আরও পড়ুন- Assembly Elections Results 2023: ‘শুধরে যান, নাহলে বেছে বেছে সাফ…!’, কংগ্রেসকে হুঁশিয়ারি মোদীর
দেশের আর্থিক পরিস্থিতি
মোদী বলেন, 'আজ দেশের আর্থিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটছে। কিছু লোক বলছেন, বিশ্বের মন্দার প্রভাব পড়বে ভারতে। কিন্তু, ভারত বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অর্থব্যবস্থা। দেশের আর্থিক বিকাশ আজ অভূতপূর্ব। কৃষিতে ভারত রেকর্ড তৈরি করছে। শেয়ার মার্কেটে ভারত রেকর্ড করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে কোম্পানিগুলো আজ ভারতে আসছে। চারপাশে এক্সপ্রেসওয়ে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর। নতুন রেলওয়ে স্টেশন, ট্র্যাক, ট্রেন তৈরি হচ্ছে। দেশের উন্নয়নের ট্র্যাক রেকর্ড অব্যাহত রয়েছে। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আপনার স্বপ্নই আমার সংকল্প, আমার সাধনা, আমার তপস্যা। আজ দেশের প্রতিটি গ্রামে অপটিক্যাল ফাইবার পৌঁছচ্ছে। প্রতিটি গরিব পরিবার পাকা ছাদ পাচ্ছেন। বিনামূল্যে রেশন আগামী পাঁচ বছর পাবেন। দেশে রেকর্ড গতিতে নতুন হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। ভারত ও তার নাগরিক এগিয়ে চলেছেন। ভারতের নাগরিক এই পরিস্থিতি বজায় রাখতেন। দেশবাসী পিছু হঠতে চান না। আর, পিছে হঠে যেতে মোদীও জানে না।'