শিলচরের তপোবন নগরে অনিল দাসের দোকান। সে দোকানের রাস্তায় খন্দগুলো এত গভীর যে গরমকালের সন্ধেয় বাচ্চারা তার মধ্যে ঢুকে খেলতে পারে। বর্ষাকালে অবশ্য রাস্তাটারই হদিশ পাওয়া যায় না।
তা সত্ত্বেও অনিল দাসের ভোট বিজেপিকেই। কারণ, “মোদী কত নতুন রাস্তা বানিয়েছেন।“ ৩২ বছর বয়সী এই দোকানি বললেন, “এ রাস্তাটা বানানো হয়নি তবে আমরা শুনেছি শিলচরের অন্য জায়গায় উনি বড় বড় রাস্তা বানিয়েছেন।“ অনিলের বাবা মা ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্বের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে এ দেশে এসেছিলেন। অনিলের কাকা, ৫৯ বছরের সুখলালও একমত, ”মোদী কাজ করেন। উনি তো বিয়ে করেননি, বাচ্চাকাচ্চাও নেই। সে জন্য ইনি গোটা জীবন দেশের জন্য দিয়ে দিয়েছেন।”
গোটা তপোবন নগর জুড়েই শোনা গেল বিজেপির প্রতি সমর্থনের কথা। তপোবন নগর শিলচরের শহরতলিতে অবস্থিত, ১৯৯০ সালের পর জেলে কলোনি হিসেবে তৈরি হয়ে উঠেছে এই জায়গা। কেন্দ্রের প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, যাতে অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দানের কথা বলা রয়েছে, তা নিয়ে আসামের অন্য জায়গায় আপত্তি উঠতে পারে, কিন্তু এখানে, হিন্দু শরণার্থীদের এই বরাক উপত্যকায় এ বিল বিজেপির সমর্থন বাড়িয়ে দিয়েছে।
একই ঘটনা ঘটেছে এনআরসি-র ক্ষেত্রেও। আসাম জুড়ে এ প্রকল্প সমর্থন পেয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে বলে, কিন্তু বরাক উপত্যকার বিশ্বাস যে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া হিন্দু নামের পক্ষে দাঁড়াবে বিজেপি।
এসবের বিরুদ্ধেই ভোটে লড়ছেন কংগ্রেসের বিধায়ক সুস্মিতা দেব। সাতবারের সাংসদ সন্তোষ মোহন দেবের কন্যা সস্মিতা ২০১৪ সালে বিজেপির কবীন্দ্র পুরকায়স্থকে মাত্র ৩৫ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন। রাজ্য থেকে কংগ্রেস যে মাত্র তিনটি আসনে জিতেছিল, তার অন্যতম ছিলেন তিনি।
শিলচর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে শিলকুরি। এখানে আগে হিন্দু শরণার্থী শিবির ছিল। শিপ্রারানি দাস এখানে একটা টিনের বাড়িতে স্বামী-পুত্রের সঙ্গে বাস করেন। জল নেই, আলো নেই।
জুলাই মাসে যখন এনআরসির চূড়ান্ত খশড়া প্রকাশিত হল, দেখা গেল তাতে শিপ্রার স্বামীর নাম নেই। কিন্তু ওঁর তো ভোটার কার্ড ছিল না। বললেন শিপ্রা। শিপ্রার নিজেরও অবশ্য ভোটার কার্ড নেই, কিন্তু তালিকায় নাম রয়েছে। শিলকুরির প্রাক্তন বাসিন্দা ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাসের বয়স ৬০। এখন থাকেন তপোবন নগরে। তিনি জানালেন এনআরসি তালিকায় তাঁর নামও নেই, নেই তাঁর ছেলের নামও।
শিলকুরি শিবির জুড়ে বাস করেন দিন মজুররা, দিনে দুবেলা খাওয়া জোটানোই তাঁদের কাছে সমস্যার। এরই মধ্যে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে এনআরসি-র ভূত।
তবে শিপ্রা বা ব্রজেন্দ্র দুজনেই এখন বিশ্বাস করেন যে তাঁদের বাঁচাতে পারেন একজনই, তাঁর নাম মোদী। শিপ্রা বলছিলেন, আমি শুনেছি মোদী হিন্দুদের পাশে থাকবেন। তবে একই সঙ্গে তিনি জানালেন মোদীর কথা তিনি শুনেছেনই শুধু, ছবিও দেখেননি কখনও। ব্রজেন্দ্রে শুনেছেন একটা বিল আসছে, যা তাঁদের উপকারে লাগবে।
এসব অনিশ্চয়তার বাইরে থাকা বরাক উপত্যকার শহরাঞ্চলের হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালিও বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন, যে বিজেপি এ রাজ্যে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছে ২০১৬ সালে। বিজেপির শিলচরের প্রার্থী রাজদীপ রায় পেশায় একজন অর্থোপেডিক সার্জন।
শিলচরের নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় কমিটির সভাপতি তপোধীর ভট্টাচার্য বললেন, ”শিলচর শহরের বাসিন্দারা বিজেপির প্রতিশ্রুতিতে ভুলেছে।”
৫৩ বছরের এস কে দেব পেশাদার, বেতনভোগী। তাঁর মতে যারা বলছে ধর্মের ভিত্তিতে শরণার্থীদের মধ্যে বিভাজন করা সাম্প্রদায়িক, তারা ভুল বলছে। ”কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সুরক্ষা দেওয়া ইনসাফ আর হিন্দু বাঙালিদের সুরক্ষা দেওয়া সাম্প্রদায়িক?… মুসলিমরা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে যেতে পারে, হিন্দুদের যাওয়ার জায়গা নেই।”
বিদায়ী সাংসদে বিল তামাদি হয়ে গেলেও বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা ক্ষমতায় এলে এ বিল ফিরিয়ে আনবে।
শিলচরের জনবহুল এলাকা শিলংপট্টি দিয়ে বিজেপির একটা ভ্যান চলে গেল। তা থেকে আওয়াজ উঠছিল দেশের (বিজেপির) পক্ষে ভোট দেওয়ার, দেশবিরোধী (কংগ্রেসের) পক্ষে নয়। বছর তিরিশের সন্দীপ গোয়ালা দেকান চালান। তিনি বলছিলেন, ”আমি খুব দেশভক্ত নই। কিন্তু আমি যখনই মোদীকে টিভিতে দেখি, আমার মধ্যে দেশপ্রেম জেগে ওঠে।” শিলচরের সদরঘাট ব্রিজ এবং ব্রড গেজ রেললাইনের কথা বলে সন্দীপের দাবি, এসবই বিজেপির কাজ। ”সুস্মিতা দেব কী করেছে? মোদী তো এমপি না হয়েও এখানে কাজ করেছেন।”
শিলচরের কাছাড় কলেজের জয়দীপ বিশ্বাস বলছিলেন, বিজেপি দেশের অন্য জায়গার মতোই এখানে গোটা লড়াইটা মোদী বনাম অন্যান্য-য় নিয়ে যেতে পেরেছে। বিজেপি এই ভোটে প্রচার করছে "এটা দেশপ্রেমী বনাম দেশদ্রোহীদের মধ্যেকার যুদ্ধ। এখানে রাজদীপ রায়ের সঙ্গে সুস্মিতা দেবের লড়াই হচ্ছে না। লড়াই হচ্ছে মোদীর সঙ্গে সুস্মিতা দেবের।"
করিমগঞ্জ জেলার বদরপুরের নবীনচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক জয়নাল আবেদিন বললেন, ”বিজেপির সমর্থন খুব অবাক করার ব্যাপার নয়, কিন্তু মেরুকরণটা খুবই আশ্চর্যজনক। ১৯৯১ সালে আসামে প্রথম বিজেপি ঢোকে বরাক ভ্যালি দিয়ে। তারপর থেকেই ঠিক হয়ে গেছে যে হিন্দুরা বিজেপিকে ভোট দেবে, মুসলমানরা দেবে কংগ্রেসকে। কিন্তু সেটাও মেরুকরণ ছিল না। আমার গ্রাম ঠিক হিন্দু বাঙালি গ্রামের পাশেই। আমার ছোট ছেলে এখন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, হিন্দু কে! সুস্মিতা দেব যদি হিন্দু হয় তাহলে তুমি ওঁর সভায় যাবে কেন! এইটা অস্বস্তিকর।”
আবেদিন বলছিলেন, বরাক উপত্যকার মুসলিমদের নাগরিকত্ব বিল নিয়ে সমস্যা বলতে, ”এরকম একটা হিন্দু বিল কেন”- ছাড়া আর কিছুই নয়।
বরাক উপত্যকার অন্য লোকসভা কেন্দ্র করিমগঞ্জ। এ কেন্দ্র তফজিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত। যদিও এখানে মুসলিমদেরই সংখ্যাধিক্য রয়েছে। করিমগঞ্জের অধ্যাপক বিআর খান বললেন, “এ কেন্দ্রে কখনও কোনও মুসলিমরা প্রার্থী হননি, এ নিয়ে মুসলিম যুবকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।“
এআইডিইউএফ-এর বর্তমান সাংসদ রাধেশ্যাম বিশ্বাস পুনর্নির্বাচন দাবি করেছেন। এআইডিইউএফ এখানে মুসলমানদের দল হিসেবেই পরিচিত। আবেদিন বলছিলেন, এ কেন্দ্রে একটাই মাত্র নির্বাচনী মনোভাব, বিজেপিকে কীভাবে হারানো যায়।
কাছাড় জেলার বাঁশকান্দি গ্রামে, ৬২ বছরের আলিমুদ্দিন চৌধুরীকে দেখা হেল প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর রোড শো-য়ে। প্রিয়াঙ্কা এখানে সুস্মিতা দেবের হয়ে প্রচারে এসেছিলেন। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে আলিমুদ্দিন তখন ডগোমগো। শ্রীলঙ্কায় তিনি যে ভারতীয় শান্তি রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিজেপি বলতে চাইছে মুসলমানরা আসলে পাকিস্তানের।“
গত সপ্তাহে এক মুসলিম ব্যক্তিকে জোর করে শূকরের মাংস খাওয়ানোর ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বললেন, ”আপনিই বলুন, যদি একটা বাগানে একটা রঙেরই ফুল থাকে তাহলে কি শোভা বাড়ে?”
কংগ্রেসের এ অঞ্চলে জনভিত্তি তো রয়েইছে, একই সঙ্গে অনেকেই মনে করেন সুস্মিতা দেব জনপ্রিয়তার বিচারে নবাগত বিজেপি প্রার্থীর তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। ”সুস্মিতা দেবকে দেখা যায়। জাতীয় রাজনীতিতে তিনি প্রাসঙ্গিক, সারা ভারত মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী এবং শিলচরে ব্যাপক জনপ্রিয়। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নিজে ওঁর হয়ে প্রচারে এসেছেন, এ থেকেই বিষয়টা স্পষ্ট।” বলছিলেন তিনি।
কিন্তু নাগরিকত্ব বিলের সমর্থক প্রচুর। কংগ্রেসের এক কর্মীর কথায়, অনেকেই নাকি বলছেন যে তাঁরা সাংসদকে পছন্দ করেন কিন্তু তাঁদের দল বিলবিরোধী।
সুস্মিতা দেব নিজে এ ব্যাপারে বিজেপির পিছু হঠার অভিযোগ তুলছেন। বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি যে কাজ করবে না, সে ব্যাপারে তিনি আত্মবিশ্বাসী। তাঁর মতে, ”শিলচরের মত ব্যবসাভিত্তিক অর্থনৈতিক এলাকায় খিদে ও বেকারি নিয়ে যে উদ্বেগ তা ধর্মকে ছাপিয়ে যাবেই।”
সুস্মিতা দেব জানালেন, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, ধর্ম নির্বিশেষ তাঁদের সকলকে নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত।
বিজেপি প্রার্থী রাজদীপ রায়ের মতে, ”একটি জাতীয় দলের প্রতিনিধির কোনও ব্যক্তিগত মতামত থাকতে পারে না। বিল কোনও ব্যক্তিগত বিষয় নয়। হয় আপনি এর বিরুদ্ধে, নয় তো এর পক্ষে। মাঝামাঝি কিছু হয় না।”
সুস্মিতা দেবের উত্তর, ”এ বিলের ব্যাপারে বরাক ভ্যালি, ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি পৃথক অবস্থান নিয়েছে। এটাকে স্থানীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। এদিকে বিজেপি তো অগপর সঙ্গে জোট করেছিল। আপনি বিলকে সমর্থন করেন আবার বিল বিরোধীর সঙ্গে জোটও করেন?”
Read the Story in English