Advertisment

স্বেচ্ছায় ওঁরা কানহাইয়ার সেবায়

গত মাসে বিহারের বেগুসরাই লোকসভা কেন্দ্রে সিপিআই প্রার্থী হিসেবে কানহাইয়ার নাম ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই গোটা গ্রাম অভ্যাস করে ফেলেছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Lok Sabha polls 2019 kanhaiya kumar

দিল্লি থেকে আসা আরাধনা রাঠোর এবং সঞ্জয় শর্মা। ছবি: শশী ঘোষ

ঘড়িতে ভোর পাঁচটা। কিন্তু আড়মোড়া ভেঙে ধীরেসুস্থে ঘুম থেকে ওঠার কোনও ব্যাপারই নেই বেগুসরাইয়ের মসনদপুর গ্রামের এ তল্লাটে। বরং এই কাকভোরেও গ্রামে একটা ব্যস্তসমস্ত আবহ, ঠিক যেমনটা থাকে খবরের কাগজের নিউজরুমে, কফির ধোঁয়ার সহোদর যেখানে পড়িমরি সদাব্যস্ততা।

Advertisment

গ্রামের চৌমাথায় বিভিন্ন রাজ্যের লাইসেন্স প্লেট বসানো নানা ধরনের গাড়ি এসে জড়ো হয়েছে। সকাল সকাল স্নান করে ভিজে চুলেই ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছেন বেশ কিছু তরুণ তরুণী, লেবু চায়ের ভাঁড়ে চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে চলছে ইতস্তত আলোচনা। পরনে লাল টি-শার্ট, মুখে একগাল হাসি, সমগ্র শো পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন প্রিন্স কুমার, গ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত বাসিন্দা কানহাইয়া কুমারের ভাই। বস্তুত, গত মাসে বিহারের বেগুসরাই লোকসভা কেন্দ্রে সিপিআই প্রার্থী হিসেবে কানহাইয়ার নাম ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই গোটা গ্রাম অভ্যাস করে ফেলেছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা। "পুরো গ্রাম আমাদের সঙ্গে আছে," ফের একবার হাসেন প্রিন্স।

চেহারাটা অনেকাংশেই ভাইয়ের মতন, এবং সেটা জানেন প্রিন্স। তাঁকে ঘিরে ক্রমাগত জমছে জিজ্ঞাসু মানুষের জটলা। "শহরে কখন যাব আমরা?" "কানহাইয়া কখন দেখা করবে?" "গাড়ি কোথায় পার্ক করা যাবে?" সব প্রশ্নের উত্তর মজুত প্রিন্সের কাছে।

আরও পড়ুন: আমি চাই: মমতা-কানহাইয়া প্রধানমন্ত্রী হোন, জিতুক নকশালরাও

সবকিছুর মাঝে এঁকেবেঁকে এসে দাঁড়ায় একটি দিল্লির লাইসেন্স প্লেট লাগানো এসইউভি, একরকম গুঁতোগুতি করেই ঢুকে পড়ে অস্থায়ী পার্কিং লটে। গাড়ি থেকে নামেন সাদা সালোয়ার কুর্তা পরিহিতা মহিলা, সঙ্গে সাদা শার্ট পরা এক ভদ্রলোক। দুজনেরই শরীরী ভাষায় দ্বিধার ছাপ সুস্পষ্ট। প্রায় ছুুটে গিয়ে তাঁঁদের স্বাগত জানান প্রিন্স, সঙ্গে করে নিয়ে যান পার্কিং লটের মতোই অস্থায়ী গুমটির আকারের অফিসঘরে, কানহাইয়ার বাড়ির পাশেই।

আধঘন্টা পরে আমাদের সঙ্গে কথা বলার অবস্থায় আসেন উচ্ছ্বসিত আরাধনা রাঠোর। "আমরা জাস্ট দিল্লি থেকে গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম। কী করতে হবে কিছুই জানতাম না। কিন্তু এটুকু জানতাম, এখানে থাকতে চাই, বেগুসরাইতে, ইতিহাসের অংশ হতে চাই। কানহাইয়াকে সমর্থন করতে যা যা দরকার, করব। রান্না, খাবার পরিবেশন, প্রচারে যাওয়া," বলেন দিল্লির এই ডকুমেন্টারি পরিচালিকা।

Lok Sabha polls kanhaiya Kumar কল সেন্টারের চাকরি ছেড়ে এসেছেন গৌরব সম্রাট। ছবি: শশী ঘোষ

তাঁর স্বামী সঞ্জয় শর্মা দিল্লিতে ইভেন্ট ম্যানেজার। স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে বলেন, "আজকাল যে ধরনের রাজনীতির কথা শুনি বা পড়ি, বড় হতাশ লাগে। কানহাইয়া যুক্তির কথা বলে। ভেদাভেদের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। ওকে সবরকম ভাবে সমর্থন করা জরুরি।"

প্রিন্সের দাবি, গত একমাস ধরে মসনদপুরে নদীর স্রোতের মতো এসে চলেছেন একের পর এক স্বেচ্ছাসেবী। তাঁর কথায়, "আমার ধারণা, সংখ্যাটা প্রায় ২৫০, বা তার চেয়েও কিছু বেশি। আমরা আর হিসেব রাখছি না।" গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় গজিয়ে ওঠা অস্থায়ী কার্যালয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা, কানহাইয়ার মায়ের তত্ত্বাবধানে খাওয়াদাওয়া করছেন যৌথ রান্নাঘরে, এবং পৌঁছে যাচ্ছেন কানহাইয়ার সমস্ত রোড শো-তে।

এঁদের মধ্যে বেশিরভাগেরই কানহাইয়ার দেওয়া কোনো 'পেপ টক'-এর প্রয়োজন নেই, জোর দিয়ে বলছেন প্রিন্স। "কোনো একটা অদ্ভুত প্যাশন যেন ওঁদের চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রচারের হাড়ভাঙা খাটুনি হাসিমুখে মেনে নিচ্ছেন, একটা নালিশ নেই।" প্রচারের কাজ বলতে মূলত জেলার বিভিন্ন এলাকায় রোড শো। দুটি কনভয় নেমে পড়েছে রাস্তায়, একটি কানহাইয়ার উপস্থিতির আগাম সংবাদ দিতে, এবং আরেকটি খোদ কানহাইয়াকে নিয়ে।

আরও পড়ুন: বঙ্গের বামেদের ‘ঠাঁই নেই’ কানহাইয়ার বেগুসরাইতে

বিহারের নালন্দা জেলার রাজগীরের বাসিন্দা ২৯ বছর বয়সী গৌরব সম্রাট, দিল্লিতে কল সেন্টারের চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন কানহাইয়ার হয়ে প্রচার করতে। তাঁর কথায়, "আমাদের গাড়ি থেকে নেমে প্রতিটা গ্রামে পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়। নিজেদের পরিচয় দিই, তারপর নানা ধরনের আলোচনা শুরু করি। কিছু জায়গায় পথনাটক হয় আমাদের। কথাবার্তা সবসময় না হলেও, গ্রামবাসীদের চোখে চোখ মিলিয়ে তাকাই। তাতে বিশ্বাস তৈরি হয়।"

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেখা হতেই থাকে গৌরবের সঙ্গে। আশেপাশের সবাইকে ইমপ্রেস করতে যেন উঠেপড়ে লেগেছেন এই যুবক। কখনো অতিথিদের চা পরিবেশন করছেন মাথায় লাল গামছা বেঁধে, পরমুহূর্তেই কানহাইয়াকে ভিড় করে দেখতে আসা গ্রামবাসীদের সঙ্গ দিচ্ছেন, আবার তার পরেই দেখি, জল সরবরাহকারীর সঙ্গে গভীর আলোচনায় মগ্ন। বলেই ফেলেন, "আসলে জানি না তো ঠিক কী কী কাজ পারি, তাই সবই করে দেখছি।"

Lok Sabha polls kanhaiya Kumar গৃহবধূ শেহজাদি বেগম এসেছেন দেশের জন্য কিছু করার ভাবনা নিয়ে। ছবি: প্রেমাঙ্কুর বিশ্বাস

লাল গামছার স্রোতের মধ্যে চোখে পড়তে বাধ্য নীল কুর্তার সঙ্গে মানানসই নীলরঙা পাগড়ির জবরজং সিং-কে। পাঞ্জাবের ভাটিন্ডার বাসিন্দা ৩১ বছরের জবরজংকে কিঞ্চিৎ বিরক্তই লাগে ইন্টারভিউয়ের অনুরোধ করায়, কিন্তু কথা বলতে শেষমেষ রাজি হওয়ার পর আর রাখঢাক করেন না কোনও।

"আমি ভাটিন্ডার একটা গুরদোয়ারার সেবক। আমি এখানে এসেছি, কারণ কানহাইয়ার বক্তব্যের সঙ্গে আমি মেলাতে পারি নিজেকে। কানহাইয়া উন্নয়নের কথা বলে, এবং এই কথাগুলো বলা জরুরি।" কানহাইয়ার প্রচারে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় নিজেকে ঠিক কীভাবে দেখছেন? জবরজং-এর সোজাসাপটা উত্তর, "আমি কানহাইয়ার সঙ্গে থাকব প্রচারে, কথা বলব মানুষের সঙ্গে। ধর্মের কথা নয়, যুক্তির কথা বলব।"

পাটনার সবজি বাজারের শেহজাদি বেগমের ভাবনা অবশ্য শুধুমাত্র কানহাইয়ার সঙ্গে ঘোরাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ৫৫ বছরের শেহজাদি তো কানহাইয়ার সঙ্গে নির্বাচনী রোড শো-তে গত দু'দিন ধরে ঘুরছেনই, পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন গ্রামে গ্রামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।

আদতে গৃহবধূ শেহজাদি মনে করেন, এবার সময় এসেছে দেশের জন্য কিছু করার, "আমার সন্তানরা বড় হয়ে গেছে। আমাকে আর সেভাবে প্রয়োজন নেই ওদের। বেশ কিছু বিষয় আজকাল চিন্তায় ফেলে আমাকে। যেভাবে দেশে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে, সেটা আমার কাছে অসহ্য। কানহাইয়া কীভাবে আমাদের দেশের সমস্যাগুলোর সমাধানের কথা ভাবছে, সেটা বুঝতেই আমি এখানে এসেছি।"

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছ'টা ছোঁয়ার আগেই শেহজাদি বেরোনোর জন্য তৈরি। পরনে পরিপাটি হিজাব। ব্যাগে নিম্বুপানির বোতল। যেটা দেখিয়ে হাসেন মধ্যপঞ্চাশের প্রৌঢ়া, "গলা শুকিয়ে যায় মাঝে মাঝে। আসলে পথনাটকে ছোটখাটো রোলে অভিনয় করি তো কখনও কখনও। তখন মনে হয়, বয়সটা এক ঝটকায় কমে গেছে।"

Lok Sabha polls CPI Kanhaiya Kumar
Advertisment