Advertisment

হিন্দি বলয়ে মোদী ম্যাজিকে ম্লান জাতপাতের অঙ্ক

উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি-বিএসপি-আরএলডির মুসলিম-দলিত-জাট ভোটের সমীকরণ সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়েছে। বিহারেও বিরোধী জোট মুসলিম-যাদব-মুসাহার-কোয়েরি-নিষাদ সম্প্রদায়ের ভোট নিজেদের দখলে আনতে পারে নি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
modi, uttar pradesh, bihar

মোদী ঝড়ে উড়ে গেল জাতপাতের অঙ্ক

দেশ জুড়ে চলা গেরুয়া ঝড়ের অংশ হিসাবে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারেও বিপুল সাফল্য পেয়েছে বিজেপি। দুই রাজ্যের মোট ১২০টি আসনের মধ্যে ১০৩টি আসনে জিতেছেন পদ্ম-প্রার্থীরা। এই বিরাট সাফল্য একদিকে যেমন নরেন্দ্র মোদীকে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসতে সাহায্য করেছে, অন্যদিকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে মণ্ডল-ফর্মুলা নির্ভর জাতপাতভিত্তিক রাজনীতির পাটিগণিতকে।

Advertisment

সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে হিন্দি বলয়ে বিজেপির বিপুল উত্থানের জেরে উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি-বিএসপি-আরএলডির মুসলিম-দলিত-জাট ভোটের সমীকরণ সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়েছে। বিহারে বিজেপি-জেডিইউ-লোক জনশক্তির পার্টিকে হারাতে বিরোধীরা রামধনু জোট গঠন করেছিলেন। আরজেডি নেতৃত্বাধীন ওই জোটের লক্ষ্য ছিল, মুসলিম, যাদব, মুসাহার, কোয়েরি, নিষাদ সম্প্রদায়ের ভোট নিজেদের দখলে আনা। বাস্তবে, জাতপাতের ওই সমীকরণকে কার্যত উড়িয়ে দিয়ে বিপুল জয় পেয়েছে এনডিএ।

প্রথম দফার ভোট শেষ হওয়ার মাত্র পাঁচদিন পরে, ৭ এপ্রিল দেওবন্দে মহাগঠবন্ধনের প্রথম যৌথ নির্বাচনী প্রচারের প্রধান সুর ছিল, 'একটি ভোটও ভাগ হতে দেওয়া যাবে না।' এই স্লোগানের অর্ন্তনিহিত রাজনৈতিক প্রত্যাশাটি স্পষ্ট। মহাগঠবন্ধনের অর্ন্তগত তিনটি দলই তাদের 'কোর ভোটব্যাঙ্ক'কে বিজেপি-বিরোধী প্রার্থীর সমর্থনে 'ভোট ট্রান্সফার; করতে বলেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক মহল ও সমাজতাত্ত্বিকদের একাংশের বক্তব্য, এর ফলে কয়েকটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ছাড়া বাকিদের কাছে এমনই বার্তা গিয়েছিল যে, এই পাটিগণিতে তাঁদের কোনও প্রয়োজন নেই।

আরও পড়ুন: কাজ করল না 'প্রিয়াঙ্কা' ফ্যাক্টর

মণ্ডল-রাজনীতির সময় থেকেই সমাজবাদী পার্টি বা বিএসপির নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক ভোট দিয়েছে 'সামাজিক ন্যায়ের বিপক্ষে'র শক্তির বিরুদ্ধে। তাতে ফলও মিলেছে। কিন্তু এবার, সম্ভবত, অন্য কয়েকটি জনগোষ্ঠীর কাছে বার্তা গিয়েছে যে, বিরোধী জোট তাঁদের গণনার মধ্যেই আনছেন না। তাঁরা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটি সম্প্রদায়েরই সমর্থন প্রত্যাশী।

উত্তরপ্রদেশে বিরোধী জোটের এই রাজনীতি বিজেপির পক্ষে সহায়ক হয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে বিজেপি অ-যাদব এবং অ-যাতভ ভোটকে পদ্ম প্রতীকে সংহত করতে পেরেছে। এই ভোটব্যাঙ্ক দীর্ঘদিন সমাজবাদী পার্টি বা বিএসপির পক্ষে থাকলেও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই ভোট বিজেপির পক্ষেই ছিল। এই নির্বাচনে তা আরও সংহত হয়েছে।

এই ফলাফল প্রমাণ করে দিয়েছে, জাতপাত ভিত্তিক পাটিগণিত বিজেপির ভোট-রসায়নের কাছে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। বিজেপির ভোটের পরিমাণ ২০১৪ সালের ৪২.৬৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৯.৫৫ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে সমাজবাদী পার্টি-বিএসপি-আরএলডির ভোট শতাংশ ৪২.৯৮ শতাংশ থেকে কমে ৩৮.৯২ শতাংশ হয়েছে। ফলে বিরোধীদের সার্বিক জোট হওয়া সত্ত্বেও এনডিএ উত্তরপ্রদেশের ৮০টি আসনের মধ্যে ৬৪টি পেয়েছে।

বিহারের পরিস্থিতিও কার্যত এক। হিন্দি বলয়ের এই রাজ্যের রাজনীতিতেও দীর্ঘদিন যাবত জাতপাতের অঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেই অঙ্কের ভরসাতেই বিজেপি-কে হারাতে নীতিশ কুমারের জেডিইউ-এর সঙ্গে জোট করে আরজেডি। নীতিশ পক্ষ বদলে ফের বিজেপির হাত ধরায় এবার তেজস্বী যাদব অন্য বিরোধী দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে জাতপাতের অঙ্ক মাথায় রেখেই প্রার্থী বাছাই করেছিলেন।

আরও পড়ুন: মোদীর উত্থান: এক রূপকথার গল্প

তেজস্বী ভোটের আগে বিজেপির দুই জোটসঙ্গী উপেন্দ্র কুশওয়াহার আরএসএলপি এবং জিতনরাম মাজির এইচএএম-কে বিরোধী জোটে শামিল করেছিলেন। সঙ্গে ছিল কংগ্রেস এবং মুকেশ সাহানির দল ভিআইপি। বিরোধীদের লক্ষ্য ছিল, মুসলিম, যাদব, কেওরি, মুসাহার, নিষাদ ভোটকে বিজেপি-র বিরুদ্ধে সংহত করা। কিন্তু এই প্রচেষ্টাকে কার্যত গুঁড়িয়ে দিয়ে বিজেপি-জেডিইউ-লোক জনশক্তি পার্টি বিপুল জয় পেয়েছে বিহারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তায় ভর করে এনডিএ পেয়েছে ৫৩.২৫ শতাংশ ভোট। একটি বাদে রাজ্যের ৩৯টি আসনের সবকটিই গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের ঝুলিতে।

সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, বিভিন্ন রাজ্যে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হিসাবে পরিচিত কৃষক সমাজের দাপট ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে যাদব, হরিয়ানার জাট, গুজরাটের পাটিদার এবং মহারাষ্ট্রের মারাঠা সম্প্রদায় দীর্ঘদিন যাবত যে রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রেখেছিল, এই নির্বাচন তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলল।

গত কয়েক বছরে যাদবরা যখন জোট রাজনীতির নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার পথে হেঁটেছেন, তখন জাট, পাটিদার ও মারাঠারা ২০১৪ সালের পর চাকরি ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবিতে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক হিংসাত্মক আন্দোলন করেছেন। তাঁদের এই আন্দোলনগুলি আগামী কয়েক বছরের পরিচিতিসত্তার রাজনীতির (আইডেন্টিটি পলিটিক্স) গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি সরকার গত পাঁচ বছরে যখনই ওই আন্দোলনের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে, তখনই দেখা গিয়েছে, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিষয়টিকে ভালভাবে নেননি। এই নির্বাচনে প্রভাবশালী সম্প্রদায়গুলি কার্যত সরাসরি বিরোধী দলগুলির সঙ্গে যাওয়ায় রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্নই হয়েছেন বিরোধীরা। তার সুযোগে অন্য সম্প্রদায়গুলির ভোট বিজেপির পক্ষে সংহত হয়েছে।

bjp narendra modi PM Narendra Modi
Advertisment