একসময় গুনগুন গানের সঙ্গে নতুন চা-পাতা তোলার কাজ চলত। রোজগার কম হলেও কাজ ছিল। মনে ছিল ফূর্তি। মুখে হাসি লেগে থাকত। সেই সদাহাস্য়ময় পাহাড়ী আমেজটাই আজ হারিয়ে গিয়েছে। সেই চা-বাগানের পাতা এখন আর কারখানায় যায় না। বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিকরা নিজেরাই বাড়িতে পাতা তুলে প্য়াকেট চা তৈরি করছেন। ওই প্য়াকেটজাত চা পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে কোনওরকমে দিনাতিপাত করছেন। কোনও দলই তাদের খোঁজ রাখেনি। পেশক টি গার্ডেনের শ্রমিক নন্দ তামাং, গোরে তামাংরা ওই চা বাগানের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ইতিহাস হাতিয়ে বেড়ান। পাহাড়ের থেকে সমতলের নেতা, সকলের ওপরই তাঁরা আস্থা হারিয়েছেন।
দার্জিলিংয়ের তিনটে চা-বাগান বন্ধ। তার মধ্য়ে চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে পেশক টি গার্ডেন। পাওনাগন্ডা পাননি শ্রমিকরা। কেন বন্ধ এই বাগান? দার্জিলিং থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে পেশক। কালিম্পং যেতে রাস্তার দুদিকে পড়বে পেশক টি গার্ডেন। বেশ কয়েক একর জমি নিয়ে এই চা-বাাগান। এই বাগানে বছর পঁচিশ ধরে কাজ করছেন গোরে তামাং। তিনি জানান, একসময় এই গার্ডেনের মালিক ছিল রামদিন। তারপর টিটিসিআইয়ের মালিকানায় চলছিল। সর্বনাশটা হল যখন এর মালিকানা হাতবদল হয়ে গেল কেডি সিংয়ের কাছে। বিভিন্ন চিটফান্ড সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেল পেষক টি গার্ডেন। অন্ধকার ঘনিয়ে এল শ্রমিকদের ঘরে।
শুধু নন্দ বা গোরে তামাং নয়, ওই এলাকায় গেলেই দেখা হয়ে যাবে ছয়সাং তামাং, সিকমা তামাং, সঙ্গীতা তামাংদের সঙ্গে। এঁরা কেউ থাকেন পেশকেই, কারও বাস স্থানীয় ডাকবাংলো এলাকায়। প্রত্য়েকে দুঃসহ দিনযাপন করছেন। কারও মুখে হাসি নেই। প্রথমে রাজনীতির লোক ভেবে জেরা করতে শুরু করলেন আমাদের। একজন মন্তব্য ছুড়ে দিলেন, "সামনে ভোট, তাই এসেছেন আমাদের খোঁজ নিতে।" পরিচয় শুনে নন্দ তামাং জানালেন, কেউ তাঁদের খোঁজ নেয় না। "কোনও রাজনৈতিক দল ঠিক নেই। কারখানা বন্ধ। না খেতে পেয়ে মরছি, আর সরকার ভোট করাচ্ছে।"
১৮ এপ্রিল দার্জিলিংয়ে নির্বাচন। কী করবেন এই চা-বাগানের শ্রমিকরা? প্রশ্ন শুনেই যেন সরল পাহাড়ী মুখগুলো আরও শক্ত হয়ে গেল। ক্ষোভের আগুন জ্বলছে শরীরে। ভোট! স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এবার কোনও মতেই ভোট দেবেন না। তাঁদের বক্তব্য়, "যখন পেটই চলছে না, তখন আর ভোট দিয়ে কী হবে? আমাদের বাড়ির কেউ ভোট দিতে যাবে না। কারও মুখ রয়েছে ভোট চাওয়ার? কিসের জন্য় ভোট? প্রয়োজনে নোটাতে ('নান অফ দি অ্যাবাভ' বা NOTA) ভোট দেব।"
চোখ-মুখে অসহায়তার ছাপ স্পষ্ট, তবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এই চা-বাগানকে বাজি রেখেই। উপায়ই বা কী? এর বাইরে কোনও কাজ নেই, তাই প্রতিদিনই তাঁরা চা-বাগানে হাজির হয়ে যান। প্রাণপন চেষ্টা করে বাগানকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে। রুজি-রুটির জন্য় আজও বাগানে আসেন পেশক ডাকবাংলোর বাসিন্দা ছয়সাং তামাং, ৩৫ বছর ধরে এই বাগানে কাজ করছেন। চা-পাতা তোলা যে পেশা শুধু নয়, নেশাও তাঁদের। "এ এক অন্য় আকর্ষন," বললেন ছয়সাং।
ঠিক কী করে দিনযাপন করছেন বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিকরা? এই প্রশ্ন তাঁদের বুকে বিঁধলো, অবশ্যই। তবু টিকে থাকতে হলে লড়াইটা যে খুব জরুরী, তা বেশ ভালই জানেন পাহাড়ের মানুষ। সাধারণত কঠোর পরিশ্রমী তাঁরা। কাজকে ভয় পান না। কিন্তু পাহাড়ের রাজনীতির হাল দেখে তাঁদের সব ভরসাই উঠে গিয়েছে। তাই নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছেন নিজেদের কাজ। এই চা-বাগানের বিভিন্ন অংশের রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিজেরাই নিয়েছেন। আগাছা সাফাই থেকে চা গাছের যত্ন, সব কিছুই।
নিজেরাই চা-গাছ থেকে নিয়মানুযায়ী নতুন পাতা তোলেন। তারপর বাড়িতে নিয়ে যান। 'হোম মেড টি।' একেবারে ঘরোয়া পদ্ধতিতে বাড়িতে চা-পাতা বানিয়ে তা প্য়াকেটে ভরেন। ঘরোয়া এই দার্জিলিং চা স্থানীয় ভাবে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেন। তা থেকে সামান্য় যা অর্থ উপার্জন করেন, তাতেই চলে সংসার। কোনওদিন চা-পাতার প্য়াকেট বিক্রি হয়, কোনওদিন ওই প্য়াকেট বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। এই যন্ত্রণা বোঝার ক্ষমতা নেই কারও।
পেশক ডাকবাংলোর বাসিন্দা সিকমা ও সঙ্গীতা তামাং, দুজনেই শ্রমিকের কাজ করতেন এই চা-বাগানে। এখন দুজনেই বেকার। তাঁদের সাত বছরের ছেলে অঙ্কিত, এক বছরের মেয়ে অঙ্কিতা। সঙ্গীতা বলেন, "আমাদের কাছ থেকে সরকার ব্যাঙ্ক অ্য়াকাউন্ট নাম্বার, আধার কার্ড, ভোটার কার্ডের জেরক্স নিয়েছে। তখন বলেছিল, প্রতি মাসে ২,০০০ টাকা করে ভাতা দেবে সরকার। কিন্তু অপেক্ষাই সার। এখনও পর্যন্ত কানাকড়িও জমা পড়েনি অ্য়াকাউন্টে।" যদিও বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নেবেন বলে জানালেন দার্জিলিংয়ের বিধায়ক তথা তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা প্রার্থী অমর সিং রাই।
শ্রমিকরা জানালেন, এই চা-বাগানে প্রায় দেড় হাজার কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। বন্ধ হওয়ার সময় সংখ্যাটা ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচশো। তাঁদের সংসার ভেসে গিয়েছে। কেউ ন্য়ূনতম খোঁজ নেয়নি। পাহাড়ের দখল নিতে তৃণমূল ও বিজেপির ওপর ভর করেছে পাহাড়ের রাজনৈতিক যুদ্ধে জড়িত দুপক্ষ। ভোটের রাজনীতিতে নেতাদের ভবিষ্য়ত ভাঙা-গড়া হবে, কিন্তু এই অসহায় মানুষদের কথা কেউ ভাবছে না। নন্দ, গোরেদের বক্তব্য়, "আমাদের নিয়ে রাজনীতি হবে, তবে যে অন্ধকারে আমরা ছিলাম, আমরা আরও তলিয়ে যাব। বাগান একদিন রুক্ষ জমিতে পরিণত হবে।"
যাঁদের হাতে তোলা পাতা জগদ্বিখ্যাত করেছে দার্জিলিং চা-কে, তাঁরাই আজ অতলের দিকে তাকিয়ে।