নানা মুনির নানা মত। এক নেতাই সকলের অনুগামী, কিন্তু মত ভিন্ন। নকশাল বাড়ির কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঢেউ থমকে গিয়েছে এ রাজ্য়ে। কিন্তু সেই আন্দোলন ছড়িয়েছে ভিন রাজ্যে। কিন্তু নকশাল বাড়ির সেফডেলা গ্রামে কানু সান্যালের ঘনিষ্ঠদের মধ্য়ে এখন চরম মতবিরোধ। তৎকালীন নেতাদের কেউ আছেন এখন তৃণমূল কংগ্রেসে, আবার কেউ বিবেক ভোটের ডাক দিয়েছেন। সিপিআই(এম-এল) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কানু সান্যাল সংগঠন বিজেপি বিরোধী ভোট সুনিশ্চিত করতে আবেদন জানিয়েছেন।
৭৮ বছরের শান্তি মুন্ডার বাড়ি সেফডালা গ্রামে কানু সান্যালের বাড়ির পাশেই। ৭জনের সংসারে সাড়ে তিন বিঘে জমি। নাতি কাজ করেন শিলিগুড়িতে। "আমার ওপর দায়িত্ব ছিল মেয়েদের সংগঠিত করা। কানুদা এখানে এসে জোতদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন।" বলেন, শান্তি মুন্ডা।
শান্তিদেবী ১৯৮২ ও ১৯৮৭ সালে সিপিআই(এম-এল)এর প্রার্থী ছিলেন ফাঁসিদেওয়া কেন্দ্রে। বিজেপি কীভাবে এ রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করছে? শান্তি মুন্ডা বলেন, "মোদী কী করে এল পশ্চিমবাংলায়? তখন তো জ্যোতিবাবু ক্ষমতায় ছিলেন এখানে। তাঁদের জিজ্ঞেস করা উচিত। আদবানী যখন রথ নিযে ঘুরলো তখন সিপিএম টু শব্দ করেনি।" এরাজ্য়ে বিজেপি আসার ক্ষেত্রে সিপিএমকে দায়ী করতে ছাড়লেন না প্রবীণ এই কমিউনিস্ট নেত্রী।
শান্তি মুন্ডাও যে পরিবর্তন চান সেকথাও জোরের সঙ্গে বললেন। তিনি বলেন, "আমি শুধু নয়,দুনিয়ার লোকে চায়। আমিও পরিবর্তন চাই। সিপিএম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ জোট করেছে। আমাদের বলেছে। এখন জোটকে কী করে সমর্থন করা যাবে? আমি তো কিছু বুঝি না। আমরা ভোটের জন্য় অত চিন্তা করি না। যাকে ভাল লাগছে তাকে ভোট দিন।" অনেকে বিজেপিতে ভোট দিচ্ছে? শান্তি দেবীর জবাব, "হ্য়াঁ দেবে, অনেকে দেবে তো।" তিনি দলের রাজ্য কমিটিতে আছেন। তবে এখন আর বাইরে যেতে পারেন না। সংবিধানের পরিবর্তন চান শান্তি দেবী। নেতৃত্বের সংকটের কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। তিনি বলেন, "ভারতে যা পরিস্থিতি তাতে আন্দোলন সংগঠিত হতে বাধ্য। আমাদের নেতৃত্ব সকলেই বয়স্ক। যুব নেতৃত্বের প্রয়োজন।"
আরও পড়ুন, Exclusive: “এদেশে এসে সব হারিয়েছি,” জীবন-যন্ত্রনার কাহিনী অধুনা ছিটমহলের বাসিন্দাদের
শান্তি মুন্ডার উল্টো দিকেই প্রদীপ দেবনাথের বাড়ি। তিনি সম্পর্কে শান্তিদেবীর মেয়ের জামাই। অনুগামীদের মধ্য়ে বিরোধ এতটাই তীব্র যে প্রদীপবাবু বলেন, "যাঁরা কানুবাবুর অফিস-বাড়ি কব্জা করেছে তাঁদের কানু সান্যাল নিজে পছন্দ করতেন না। ২৩ মার্চ কানুদার মৃত্য়ু দিবস পালন করে। আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না।"
প্রদীপ দেবনাথ সিওসি(এম-এল) জেলা সম্পাদক ছিলেন। চা-বাগানের শ্রমিক সংগঠনরে দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। জানান প্রদীপবাবু। কেন তৃণমূলে যোগ দিলেন? তিনি বলেন, দলাদলির জন্য় তৃণমূলে যোগ দিতে হয়েছে। তবে এখনও তিনি নিজেকে কমিউনিস্ট মনে করেন। আর নেতা হিসাবে কানু সান্যালকেই মানেন বলে জানান প্রদীপবাবু। ৬০ বছরের প্রদীপবাবু বলেন, নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াই। একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য়ে তৃণমূলে আসতে হয়েছিল। তৃণমূলে নেতৃত্বের পদ বা পয়সার জন্য় যাইনি। বিশেষ পরিস্থিতিতে যেতে হয়েছিল। কানু সান্যাল আমার সব সময়ের নেতা। আমি যত দিন বেঁচে থাকব কানু সান্যাল আমার নেতা থাকবে। আমি নকশাল কথাটা বলব না আমি প্রকৃত কমিউনিস্ট মনে করি। তৃণমূল সংগঠনে থাকলেই তৃণমূল হয়ে যাব এমন ব্য়াপার নেই। কমিউনিস্টরা বিভিন্ন সময় সংগঠনের স্বার্থে অন্য় সংগঠনে থেকে কাজ করে। আমি ছাত্রাবস্থায় এসএফআই করতাম। তাহলে কী আমি এসএফআই ছিলাম? আমি তো এসএফআই ছিলাম না। আমি যখন তৃণমূলে গেলাম তখন নকশাল নেতাদের বলেছিলাম একটা সংগঠনের ভিতরে থেকে কাজ করি তাহলে টিকে যাব। তৃণমূল ভবিষ্য়তে নাও টিকতে পারে।
এই গ্রামেই থাকেন দিপু হালদার। তিনিও দীর্ঘ সময় কানু সান্যালের সান্নিধ্য়ে ছিলেন। দলাদলি নয়, জমির কারবারের জন্য়ই কেউ কেউ তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন দিপু হালদার। তিনি বলেন, "বিজেপি বিরোধী আন্দোলনে প্রকৃত বামপন্থীদের নেতৃত্ব না থাকলে সেই আন্দোলন বেশি দূর এগোবে না। বামপন্থায় বিশ্বাসীদের একযোগে বিজেপি বিরোধী মঞ্চ গড়তে হবে। আমরা বিজেপি প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রকৃত বাম ও ধর্ম নিরপেক্ষশক্তিতে ভোট দিতে আবেদন জানিয়েছি। কমিউনিস্টদের কাছে নির্বাচনটা একটা কৌশল মাত্র।" "মাওবাদীদের কার্যকলাপকে সমর্থন করি না। নকশালবাড়িতে কানু সান্যালরাও একসময় ভুল করেছিলেন। বলেন, দিপু হালদার।"
কানু সান্যালের অনুগামীরা এখন স্পষ্টত নানা মতে বিভক্ত। যে গ্রাম থেকে একসময় সারা রাজ্যে আন্দোলনের লেলিহান শিখা ছড়িয়েছে, এখন সেই গ্রামে দক্ষিণপন্থী, চরম দক্ষিণপন্থীদের দাপাদাপিও চোখে পড়ল। মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি কেন্দ্রে গত বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু প্রতীকী হলেও এই একটা গ্রামের হালহকিকত দেখেই মালুম হল এবারের লড়াই কতটা কঠিন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন