ঘটনার ৬ মাস পরও ছেলের কথা শুনেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠছেন ঝর্ণা কারক। বন্ধ হয়ে যায় নাওয়া-খাওয়া। ছেলের কথা ভেবেই সারাটা দিন কেটে যায়। ২০২০-এর ৬ অক্টোবর। রাত ১টা। তখন মিলেছিল নিথর দেহ। ফোন পেয়ে দাদাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন ভাই সুভাষ কারক। জমি দেখতে গিয়ে যে আর কোনও দিন দাদা মিলন বাড়িতে ফিরবেন না তা ভাবতে পারেননি সুভাষ। পাশের গ্রাম ভুলাতে কারক পরিবারের জমির কাছেই পড়েছিলেন কোচডিহির ২৪ বছরের মিলন কারকের হাতির পদপিষ্ট দেহ। সেই দুর্ঘটনার পর দিন থেকে এখনও হাতি-আতঙ্ক তাড়িয়ে বেরাচ্ছে কারক পরিবারে।
হাতির হানায় জমি নষ্ট হচ্ছে কীনা দেখতে গিয়েছিলেন মিলন। তখনই তাঁকে আছড়ে, পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলে দলমার হাতি। সাড়ে দশটার সময় ফোন এসেছিল হাতি এসেছে, জমি নষ্ট করে দিচ্ছে। ছুটে গিয়েছিলেন মিলন। সেই ঘটনার ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪ লক্ষ টাকা পেয়েছে পরিবার। চাকরির আবেদন করেছে মিলনের দিদি। সুভাষ বলেন, "দলমার হাতি এখানে এসে থেকে যাচ্ছে। কারও কোনও হেলদোল নেই। সবাই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তাড়িয়ে দেব। ওই পর্যন্তই।" লালমাটির দেশের এই রুক্ষ জেলায় ১২ বিধানসভা আসনে এখন নির্বাচনী লড়াইয়ে মেতেছে দলগুলি।
সোনামুখী থানার ভুলা, পাথরা, কোচডিহি ঘা ঘেষাঘেষি করা এই তিন গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বাইরে আবাসিক থেকেই পড়াশুনা করে। কারণ হাতির গ্রামে অহরহ আগমণ। কেউ আবার স্কুল বা টিউশন করতে গেলে ৬ কিলোমিটার দূরে বড় রাস্তায় এগিয়ে দিয়ে আসেন পরিবারের বড়রা। গ্রামবাসীরা বাড়ির বাইরে পা রাখতে আতঙ্কে ভোগেন। রাত হলে সেই আতঙ্ক কয়েকগুন বেড়ে যায়। যদিও বাড়িতেও খুব স্বচ্ছন্দে নিরাপদে থাাকেন এমন নয়। বাঁকুড়ার জঙ্গলঘেরা গ্রামগুলির বাসিন্দারা ২৪ ঘণ্টা হাতির আতঙ্কেই দিন কাটান। বিগত দিনে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে হাতির আক্রমণে। ফসল নষ্ট তো রোজকারের ঘটনা। বড়জোড়া, সোনামুখী, বিষ্ণুপুর, ছাতনা, রানিবাঁধসহ বাঁকুড়ার ১২টি বিধানসভার একটা বড় অংশে হাতির হানাও এবারের নির্বাচনে অন্যতম ইস্যু।
২০১৫-এর ২৬ জানুয়ারী রাত সাড়ে দশটা নাগাদ জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি ফেরার পথে পাথরা গ্রামে হাতির আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে গোপীমোহন নন্দীর(২৮)। সেদিন হাতির হানায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তুলকালাম হয়ে গিয়েছিল স্থানীয় বনদফতরের অফিস। গোপীমোহনের বাবা ৬৮ বছরের কুতুরাম নন্দী বলেন, "আমার একমাত্র ছেলের হাতির হানায় মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিপূরণ বাবদ যে আড়াই লক্ষ টাকা পেয়েছি সবটাই স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয়ে যায়। আমার তিন-সাড়ে তিন বিঘে জমি হাতির কবলেই থাকে। জঙ্গলঘেরা এই গ্রামে সবসময়ই হাতির আতঙ্কে থাকতে হয়। নিয়মানুসারে আমার ভাইপো অমিত নন্দী সরকারি চাকরি পেয়েছে।"
পাঁচ বছর আগের সেই ঘটনা এখনও ভুলতে পারেনি নন্দী পরিবার ও পাথরার বাসিন্দারা। সেদিন ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ছিল এলাকা। স্থানীয় বিট অফিসে ভাঙচুর থেকে আগুন ধরানো হয়েছিল। অভিযুক্ত হয়েছিলেন ২৬ জন। পাথরার ৫৮ বছরের বংশীবদন বিশ্বাসের অভিযোগ, "ভোটের আগে সব দল প্রতিশ্রুতি দেয়। ভোট পার হলেই সব বেপাত্তা। নেতাদের কোনও আগ্রহ নেই। হাতি নিয়েও রাজনীতি চলছে। হাতির হানায় মৃত্যু, ফসল নষ্ট, জমি চাষ করা যাচ্ছে না। নিশ্চিতভাবে এর প্রভাব পড়বে এবারের নির্বাচনে।"
আগে হাতির আক্রমণে ক্ষতিপূরণ মিলত ১ লক্ষ টাকা। ২০২০ সাল থেকে তা বেড়ে হয় ৪ লক্ষ টাকা। সম্প্রতি সরকারি নির্দেশিকায় এই ক্ষতিপূরণ বেড়ে হয়েছে ৫ লক্ষ টাকা। এমনকী গত অক্টোবরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ঘোষণা করেন, হাতির হানায় মৃতের পরিবারের একজন সরকারি চাকরি পাবে। ইতিমধ্যে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাঁকুড়া জেলায় অনেকের চাকরি হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছেন হাতি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সংগ্রামী গণমঞ্চ। সম্পাদক শুভ্রাংশু মুখোপাধ্যায় বলেন, "সরকার কিছু সমস্যার সমাধান করেছে। ২০১১ থেকে সরকারি চাকরি মিলছে। তার আগে হাতির আক্রমণে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদেরও চাকরি দিতে হবে। তাছাড়া হাতির হানায় নিয়মিত ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। তারও স্থায়ী সমাধান করতে হবে। আমাদের আন্দোলন চলবে।" ময়ুরঝর্ণা প্রকল্পের রূপায়নের দাবি জানান তিনি।
রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত হাতির হানায় পশ্চিমবঙ্গে ৪০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাঁকুড়ার রানিবাঁধের বুধখিলা গ্রামে একই দিনে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মৃত্যু হয়েছিল দুজনের। ছোট্ট পাহাড়ের টিলার ওপর এই গ্রামে মাটির বাড়ির পিছন দিকের বারান্দায় ঘুমাচ্ছিলেন ধরনী সর্দার(৫৭)। হুলা পার্টি হাতি তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাতই ঘুমন্ত ধরনী সর্দারকে মাটির বারান্দা থেকে হাতি শুঁড় দিয়ে টেনে নেয়। তরপর পা দিয়ে পিষে দেয়। স্ত্রী আদরি সর্দারের ভোরের ঘুম ভাঙে হাতির আক্রমণে স্বামীর মৃত্যুর খবরে। ছেলে সুমন্ত সর্দারের মনে এখনও সেই আতঙ্ক তাড়া করছে। চাকরির আবেদন করেছেন সুমন্ত।
বড়জোড়া বিধানসভার সাতজোড়া গ্রামের শম্ভু বাগ্দী ২০১০-এ ঘুটগড়িয়া গিয়েছিলেন কাজে। দিনমজুর পরি বাগদী বলেন, "আমরা খবর পেয়েছিলাম ঘটনার পরের দিন। পরে জানতে পারি হাতি শুঁড়ে করে আছড়ে দিয়েছিল আমার স্বামীকে।" বাড়ির কেউ কাজ না পাওয়ায় তাঁর চোখেমুখে হতাশার ছাপ। তাঁর পরিবার ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। তবে চাকরি পায়নি কেউ। কারণ সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে চাকরির কথা ঘোষণা করেছে সরকার। মাধ্যমিক পাস ছেলে মানু বাগদী দিনমজুরের কাজ করেন। বড়জোড়া বিধানসভার বেলিয়াতোড় থানার নিত্যানন্দপুরে ২০১৫-এর ৯ মে-তে হাতির আক্রমণে মৃত্যু হয় বুল্লি বাউড়ির। ছেলে কার্তিক বাউড়ি বলেছেন, "দিনমজুরি করে দিনাতিপাত চলছে। স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার। চাকরির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। নেতাদের কাছে গিয়ে বললে তাঁরা বলছেন আমরা কিছু জানি না।"
বিধানসভা নির্বাচনে হাজারো ইস্যুর মধ্যে হারিয়ে যায় হাতির হানায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতনের ঘটনা। জঙ্গলমহলে বর্গকিলোমিটার জমি নিয়ে ময়ুরঝর্ণা প্রকল্পে হাতিদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার কথা ছিল। যা কার্যকরী করার দাবি জানিয়েছে সংগ্রামী গণমঞ্চ। বাঁকুড়ার সাংসদ ডা সুভাষ সরকার বলেন, "রাজ্যে ক্ষমতায় এলে আমরা হাতির হানায় মৃতদের কর্মসংস্থানের কথা ভেবে দেখব। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়মনীতি মেনে চলে না রাজ্য সরকার। দিনের পর দিন ধরে জঙ্গল সাফাই করা হচ্ছে।" বাঁকুড়া জেলা তৃণমূল নেতা তথা ছাতনার তৃণমূল প্রার্থী সুভাশিষ বটব্যাল বলেন, "আমি নিজে জঙ্গল এলাকায় বসবাস করি। হাতির হানায় কী অবস্থা হয় তা আমি জানি। আমিও ভুক্তভোগী। রাজ্য সরকার এই ঘটনায় সহানুভুতিশীল হয়ে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বাড়িয়েছে। চাকরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।" ২০১১-এর আগে হাতির হানায় মৃতদের চাকরি দেওয়ার বিষয়ে তিনি জানিয়ে দেন বিষয়টা ভেবে দেখা হবে।
ভোট আসে ভোট যায়। নানা ইস্য়ু সামনে এলেও হাতির আক্রমণের ঘটনা নীরবেই থেকেই যায়। তবে বনদফতরের জনৈকি আধিকারিকের বক্তব্য, আগের থেকে হাতির আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্য়া কমেছে। হাতিগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে। বনাঞ্চল, কৃষিজমি, মানুষের বসবাস একই ক্ষেত্রে হওয়ায় হাতির দল সহজেই হানা দিতে পারে। তবে বিদ্যুতিক ফেন্সিং, খাল খনন করে হাতির দলকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন