scorecardresearch

ইভিএম কারচুপি শুধু কঠিনই নয়, বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভবও

ইভিএম হ্যাকিং নিয়ে ইদানীং দেশজুড়ে জোর চর্চা চলছে। কিন্তু প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে এখনও নীরব। সেই নীরবতার সুযোগে স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞরা এবং রাজনৈতিক নেতারা এ বিষয়ে নিজেদের অগভীর জ্ঞান জাহির করে চলেছেন।

ইভিএম কারচুপি শুধু কঠিনই নয়, বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভবও

ব্যাপক হারে ইভিএম মেশিনের ওয়ারলেস হ্যাকিং করতে প্রচুর অর্থ তো দরকারই, সঙ্গে দরকার প্রশাসনিক সাহায্য এবং মেশিন প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গে আঁতাত। দরকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ‘ট্রান্সসিভার’ সার্কিটও। এবং এতসব যদি একসঙ্গে চলেও আসে কারোর হাতে, তা হলেও ব্যাপক হারে ইভিএম-এ কারচুপি অসম্ভব। এর সবচেয়ে বড় কারণ, প্রমাণ থেকে যাবে অ্যানটেনায়।

ইভিএম হ্যাকিং নিয়ে ইদানীং দেশজুড়ে জোর চর্চা চলছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে এখনও নীরব। সেই নীরবতার সুযোগে স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞরা এবং রাজনৈতিক নেতারা এ বিষয়ে নিজেদের অগভীর জ্ঞান জাহির করে চলেছেন। ইভিএম হ্যাকিংয়ের প্রাথমিক প্রযুক্তিগত দিকগুলি নিয়ে তাই খোলাখুলি আলোচনার সময় এসেছে।

যে কোন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র দু’ভাবে হ্যাক করা যায়। সহজ ভাষায়, তার-সংযোগের মাধ্যমে এবং তারবিহীন পদ্ধতিতে। পরিভাষায়, ‘wired’ এবং ‘wireless’। কোনো যন্ত্রের হ্যাকিংয়ের সেরা উপায় যন্ত্রটির মস্তিষ্ক বা ‘কন্ট্রোল ইউনিট’-এর সঙ্গে তার-সংযোগ স্থাপন। টেকনিক্যাল ভাষায়, এই সংযোগ স্থাপন হয় একটি মাইক্রো-প্রসেসরের মাধ্যমে, যার কাজ হল কিছু সার্কিটের সাহায্যে নির্দিষ্ট কিছু তথ্যের ভিত্তিতে সাধারণ কয়েকটি গাণিতিক পদ্ধতির প্রয়োগ। সোজা কথায়, যে তথ্য যন্ত্রটিতে ভরে দেওয়া হবে, কন্ট্রোল ইউনিট তার ভিত্তিতে অঙ্ক কষে যন্ত্রের ‘মেমোরি’তে পাঠিয়ে দেবে। এবং পরবর্তীতে সেই অঙ্কের ফলাফল যন্ত্র থেকে উদ্ধার করা যাবে।

আরও পড়ুন: কেন এই তিনটি পরীক্ষায় ব্যর্থ ইভিএম?

তার-সংযোগের মাধ্যমে কোন যন্ত্রের হ্যাকিং করার অর্থ আদতে হল আর একটি ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র তৈরি করা, যার মাধ্যমে উপরোক্ত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট তথ্য পাঠানো যায় অন্য যন্ত্রের মস্তিষ্কে। ধরুন, আমি আপনার অ্যাপল ফোনটি হ্যাক করতে চাইছি। সে ক্ষেত্রে আমাকে এমন একটি সফটওয়্যার বানাতে হবে যার সঙ্গে অ্যাপল-ব্যবহৃত IOS নেটওয়ার্কের সঙ্গে প্রযুক্তিগত সামঞ্জস্য থাকবে। এবং যে সফটওয়ারটি টার্গেট ফোনের কন্ট্রোল ইউনিটে পাঠানো যাবে কোন বাধা ছাড়াই। কী ভাবে এটি সম্ভব, তা মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা একবার হাতেকলমে দেখিয়েছিলেন। আরও একটি পদ্ধতি আছে। কৃত্রিমভাবে মাইক্রোপ্রসেসরটি বদলে দেওয়া। যে পদ্ধতির প্রসঙ্গ গত দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময় তুলেছিলেন আম আদমি পার্টির সদস্যরা।

তারবিহীন বা ‘ওয়ারলেস’ হ্যাকিংয়ের জন্য যন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের প্রয়োজন হয় না ঠিকই। কিন্তু কন্ট্রোল ইউনিট, টার্গেট ডিভাইস এবং তার প্রায়োগিক দিকগুলির বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা তো লাগেই। সম্প্রতি স্বঘোষিত সাইবার-বিশেষজ্ঞ সঈদ সুজা তারবিহীন হ্যাকিং প্রসঙ্গে দাবি করেছেন, তাঁর টিম নাকি হ্যাকিং-সংক্রান্ত কিছু সিগন্যাল বা তরঙ্গবার্তার হদিশ পেয়েছে।

এখানে বলা প্রয়োজন, তারবিহীন হ্যাকিংয়ের জন্য প্রয়োজন একটি রেডিও রিসিভার, যাতে থাকবে বিশেষভাবে তৈরি ইলেক্ট্রনিক সার্কিট এবং অ্যানটেনা।

নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট জানিয়েছে, তাদের ইভিএম-এ এই জাতীয় বিশেষ সার্কিটের অস্তিত্ব নেই। তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায়, কেউ এমন বিশেষ সার্কিট বানাল, এমন ট্রান্সসিভার তৈরি করল যা ইভিএম-এর কন্ট্রোল ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলেও লক্ষ লক্ষ এমন বিশেষভাবে তৈরি ট্রান্সসিভার দরকার, যা প্রতিটি ইভিএম-এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে।

আরও পড়ুন: প্রশ্নটা ভোটদানের স্বচ্ছতার, মাধ্যমের নয়

এখন সমস্যা হল, এই ধরণের সর্বাধুনিক ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র আপনার বাড়ির সামনের রাস্তার মোড়ে কিনতে পাওয়া যায় না। বিশ্বে মাত্র আধ ডজন সংস্থা রয়েছে যারা এই বিশেষ ধরণের চিপ-সম্বলিত যন্ত্র বানাতে পারে, যা কোন ইভিএম-এর কন্ট্রোল ইউনিটে ঢুকতে পারবে। এমন একটি চিপ বানাতেও খরচ কমপক্ষে দুই মিলিয়ন ডলার।

এখানেই শেষ নয়। ‘কাহানি মে টুইস্ট’ অন্যত্র। এই পদ্ধতিতে তারবিহীন হ্যাকিং করতে গেলে বিশেষভাবে তৈরি অ্যানটেনারও প্রয়োজন, যা ট্রানসিভার সার্কিটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করবে। এবং ট্রানসিভার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও এই অ্যানটেনাটিকে লুকোনো সম্ভব নয়, সম্ভব নয় চোখে না পড়ার মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাবে বানানো। চোখে পড়বেই। ব্যাপক হারে হ্যাকিং করতে গেলে এমন লক্ষ লক্ষ ট্রানসিভার আর অ্যানটেনা লাগবে যা প্রতিটি ইভিএম-এর কন্ট্রোল ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। বস্তুত, কেউ যদি লক্ষ লক্ষ ইভিএম-কে এইভাবে হ্যাকিং-যোগ্য করে তুলতে পারেন এমন মাপের অ্যানটেনার সাহায্যে, যা বাইরে থেকে কেউ দেখতেই পাবে না, তাঁর অবিলম্বে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত।

সুতরাং, ইভিএম হ্যাকিং নিয়ে যাঁরা সন্দিহান, তাঁরা বড়জোর এটুকুই দাবি করতে পারেন যে যন্ত্রগুলি কাচের মোড়কে মুড়ে দেওয়া হোক, যাতে যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত মূল উপাদানগুলি বাইরে থেকে সাদা চোখে দেখা যায়। কারণ, আগেই বলেছি, আর যা-ই লুকোনো যাক, অ্যানটেনা লুকোনো যাবে না।

(লেখক ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক। ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট। সেন্সর-মাইক্রোসিস্টেম এবং অ্যানটেনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ)

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Election news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Explained why it is impossible to hack evm indian elections