গোধরা রেল স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয় সিগন্যাল ফলিয়া। সবরমতী এক্সপ্রেসে আগুন লাগানোর ঘটনায় অভিযুক্তদের অধিকাংশকেই এখান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এখানকার হিন্দু ও মুসলিম, দুই সম্প্রদায়ের মানুষই এমন একজন প্রার্থীকে চাইছেন, যিনি প্রতিশ্রুতি পালন করবেন। কেউই অবশ্য তেমনটা ঘটবে বলে নিশ্চিত নন।
প্রায় ষাট বছর বয়স হতে চলল হানিফভাইয়ের। তিনি পেশায় গাড়ি চালক, পুরো নাম বলতে চাননি ভয়ে। হানিফভাইয়ের কথায়, "আমরা সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ। আমরা সামান্য কাজ চাই যাতে খাওয়া জোটে আর পরিবার চলে যায়। সাত দিন ধরে আমার ট্রাকটা এখানে দাঁড়িয়ে আছে... ভোট আমি দেব, কিন্তু কোন পার্টিকে দেব জানি না। প্রার্থী কে, সেটা দেখব আগে। সবাই ক্ষমতায় যায়, কিন্তু কাজ কেউ করে না।"
হিন্দু এলাকায় যাওয়া যাক। ৫২ বছরের জ্যোতিকা রাণা লালবাগ বাস স্টেশন এলাকায় সোডার দেকান চালান। জ্যোতিকা ভোট দেবেন কি না ঠিক নেই। "কী হবে? সবাই আসে, বড় বড় কথা বলে, তারপর ভুলে যায়।"
গোধরা পড়ে পাঁচমহল লোকসভা কেন্দ্রের আওতায়। এখানে সংখ্যালঘু ভোট ১,৯৪ লক্ষ, মোট ভোটারের ১২ শতাংশ। শুধু গোধরা বিধানসভা কেন্দ্রেই মুসলিম ভোটারের সংখ্যা এক তৃতীয়াংশ।
২০০২সালের দাঙ্গার পর গোধরা জিতিয়েছিল বিজেপি প্রার্থী হরেশকুমার ভাট। পাঁচ বছর পর অবশ্য সে আসন ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেস, এবং সে জয়ের ধারা অব্যাহত ছিল ২০১৭ সাল পর্যন্ত।
অন্যদিকে এই লোকসভা আসনটি, যা আগে গোধরা লোকসভা কেন্দ্র বলেই পরিচিত ছিল, দাঙ্গার পর থেকে বিজেপির দখলেই আছে। ২০০৪, ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে এখানে জিতেছে বিজেপি। এ আসনের বর্তমান সাংসদ অবশ্য সম্প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন।
সম্ভাবনার একটা সুবাস পাচ্ছে কংগ্রেসও। ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে পাঁচমহল লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে তিনটে জিতেছিল কংগ্রেস, তিনটে বিজেপি। একটি আসন পেয়েছিল নির্দল।
পুর এলাকাতেও রাজনৈতিক তোলপাড় হয়েছে প্রচুর। ২০০২ সালে গোধরা পুরসভার প্রধান ছিলেন নির্দল মহম্মদ হুসেইন কালোটা। সবরমতী এক্সপ্রেস পোড়ানোর ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর সঙ্গে গ্রেফতার হন আরও তিনজন মুসলিম কাউন্সিলর। কালোটা গত বছর মারা যান। আদালত তাঁকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার আগে জীবনের শেষ পর্যায়ের অধিকাংশ সময়েই জেলে কাটান তিনি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় ভোটের সব খবর পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
৪৪ সদস্যের পুরসভায় এখন ১৮ জন বিজেপি কাউন্সিলর, ২৫ জন নির্দল এবং একদন কংগ্রেস। এঁদের মধ্যে ২০ জন নির্দল এবং কংগ্রেসের একমাত্র সদস্য মুসলিম। সাতজন নির্দল কাউন্সিলরের সমর্থন নিয়ে বিজেপি পুরসভার দখল রেখেছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ মুসলিম সমাজ, তাঁরা ১৬ বছর পর এবার পুরসভার দখল পাওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন।
সিগন্যাল ফলিয়ায় যেটা খুব স্পষ্ট সেটা হল একটেরে হয়ে যাওয়ার মনোভাব। সবরমতী এক্সপ্রেসের ঘটনা এবং তৎপরবর্তী দাঙ্গার দেড় দশক কেটে যাওয়ার পর মুসলিমরা এখন মুখ খোলেন বটে কিন্তু অধিকাংশই পুরো নাম জানাতে চান না, হানিফভাইয়ের মত।
এক চায়ের দোকানে কথোপকথন চলার সময়ে গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে এলেন একজন শ্রমিক। নিজের নাম আদৌ বললেন না তিনি। বললেন, "আমি চাই আমার ছেলে মেয়ে ভাল করে পড়াশুনো করুক, আমি যা দিতে চাই সেগুলো যেন দিতে পারি। তার জন্য আমাদের কাজ দরকার, ঠিকঠাক কাজ। আমরা রাজনীতির কচকচিতে বেশি ঢুকি না, কিন্তু কেউ যদি আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে আমি বলব দরকার মতো কাজ চাই যাতে আমরা যাতে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারি।"
বর্তমান সাংসদ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, "আমার কোনও অভিযোগ নেই, তবে আমি জানি না যে কাকে ভোট দেব।"
৮৩ বছর বয়সী আব্দুল গফফর কড়া কংগ্রেস সমর্থক। তিনি বললেন "পার্টির এখানে ভোট চাইতে আসারও দরকার নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কংগ্রেসের ফিক্সড ডিপোজিট। আমরা সবাই নির্দ্বিধায় কংগ্রেসকে ভোট দেব।"
কিন্তু ৬৬ বছরের ইয়াকুব সুজেলার মতে এই মনোভাব থেকে মুসলিমদের বেরিয়ে আসা দরকার। "আমাদের মধ্যে অনেকেই বিজেপির সমর্থক। দিনের শেষে কাজই কথা বলে। এখনকার সাংসদ গোধরা স্টেশনে যাতে আরও বেশি সংখ্যক ট্রেন দাঁড়ায়, তার ব্যবস্থা করেছেন, স্টেশনের কাছে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্রিজ নতুন করে তৈরি করা হয়েছে।" সুজেলা রেলে লোকো পাইলটের কাজ করতেন।
পাঁচমহল আসনের অন্য জায়গাগুলিতে অনেকেই মোদী সরকারের পক্ষে। ভেজালপুরে চিলালা গ্রামের নিম্রত ভারিয়া বললেন "বিজেপি ফের ক্ষমতায় আসবে এবং পাঁচমহল থেকে জিতবে। অন্য কোনও পার্টির কোনও চান্স নেই।"
কালোলের দেসারা গ্রামের নরওয়ার সোলাঙ্কির বক্তব্য, "বর্তমান সরকারের আমলে আমাদের গ্রামে আবাস যোজনা প্রকল্পের আওতায় বাড়ি হয়েছে, শৌচাগার হয়েছে, রাস্তা হয়েছে। আমরা আবার ওদের ভোট দেব না কেন?"
কিন্তু ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটের ফলাফলে আশান্বিত কংগ্রেস মনে করছে তারা লড়াই চ্যুত হয়ে যায়নি। "২০১৪ সালে বিজেপি এক লাখেরও বেশি ভোটে জিতেছিল কিন্তু ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে সাতটি বিধানসভা এলাকায় ওদের ভোট প্রায় ৫০ শতাংশ কমে এসেছে।" বলছিলেন মধ্য গুজরাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত এআইসিসির সম্পাদক বিশ্বরঞ্জন মহান্তি।
এন সি পি-র সঙ্গে কংগ্রেসের আসন সমঝোতার উপরেই নির্ভর করছে এখানে বিজেপির বিরুদ্ধে কে লড়বে। বর্তমানে এনসিপি-তে রয়েছেন বর্ষীয়ান শংকর সিং বাঘেলা। তিনি এর আগে পাঁচমহল আসন থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তিনি এখান থেকে ভোটে দাঁড়াতে পারেন।
গোধরার বর্তমান বিধায়ক সি কে রাউলজি বাগেলার ঘনিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন। ২০০৭ এবং ২০১২ সালে কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের অগাস্টে বিজেপিতে গিয়ে রাজ্যসভা ভোটে দাঁড়ান এবং মাত্র ২৫৮ ভোটে জয়লাভ করেন।
পানের দোকান চালান রূপেশ পাঞ্চাল। তিনি মনে করছেন পাঁচমহল থেকে বাগেলার জেতার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। "জনতা নতুন মুখ চায়।"
তবে জ্যোতিকা কিংবা হানিফভাইদের পক্ষে হতাশার কথা হল, এখানে অ্যাজেন্ডার কোনও বদল ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। গত ১২ ফেব্রুয়ারি গোধরা থেকে ১০ কিলোমিটার ধরে এক দলীয় সভায় হাজির হয়ে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের ডাক দেন। ৩ মার্চ গোধরা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নিয়ে নির্মীয়মাণ এক সিনেমার শুটিংয়ের সেটে মুম্বইয়ের এক চলচ্চিত্রকার ট্রেনের কামরায় আগুন জ্বালান। সে সিনেমায় সবরমতী এক্সপ্রেসের ঘটনার কথা থাকবে।
জ্যোতিকা বললেন, "লোক খেপিয়ে ভোট তোলার জন্য দাঙ্গাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। ট্রেন জ্বালানোর ঘটনার পর গোধরায় কিছু হয়নি, কিন্তু আমাদের নাম খারাপ হয়ে গেছে রাজনীতির লোকজন গোধরাকে ব্যবহার করায়। সবাই ও ঘটনা পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। সেটাই উচিত। আমাদের সত্যিকারের সমস্যা আছে, রাস্তাঘাট, পরিকাঠামো, সিভিল হাসপাতালে যথেষ্ট সার্জন নেই, কাজ নেই।"
শেষে ন্যায়বিচারের কথা। হানিফভাই বলছিলেন, এসবের সময় আর কার আছে? "আমার ষোল বছরের ছেলে আর তিন ভাইকে ডাব্বা কাণ্ডের (সবরমতী এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনা) পর তুলে নিয়ে গেছে। ওরা নির্দোষ, কিন্তু আমার টাকা নেই, ক্ষমতা নেই, আর লড়াইয়ের ইচ্ছেও নেই।" চারজনই এখন জেলবন্দি।
Read the Full Story in English