তাঁর জীবনের সম্ভবত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে লড়ছেন তিনি। পাশাপাশি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করছেন, বাম এবং কংগ্রেস ব্যর্থতার কারণেই এই রাজ্যে উত্থান ঘটেছে বিজেপির। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ত্রিপুরায় পাওয়া বিজেপি সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে বাংলায়। তাঁর প্রচার অভিযানে সঙ্গী জয়ন্ত ঘোষালের সঙ্গে কথা বললেন মমতা।
গত আট বছর ধরে বিরোধীদের প্রধান অভিযোগ এই যে আপনার সরকার মুসলমান তোষণের রাস্তায় হেঁটেছে, যে কারণে পদ্মফুল ফুটেছে বাংলায়।
আমার তা মনে হয় না। বাংলায় পদ্মফুল ফুটতে পারবে না। কংগ্রেস এবং সিপিএম, দুইয়েরই অবস্থা খারাপ। দুই দলেরই বেশ কিছু সদস্য বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। একসঙ্গে হয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। রাজ্যে কংগ্রেস এবং সিপিএমের সঙ্গেও ভালো সমীকরণ বিজেপির। সেটা রাজ্যস্তরের বোঝাপড়া, তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ওটা রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি, আদর্শভিত্তিক কিছু নয়।
বিজেপি সবসময় ত্রিপুরার (২০১৮ বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের) কথা বলে, কিন্তু ত্রিপুরা ছোট রাজ্য, বাংলার তুলনায় পুরসভা বলতে পারেন। বাংলায় বিজেপির কোনো শিকড় নেই। ত্রিপুরায় একটা প্রবল সিপিএম-বিরোধী, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী জনমত ছিল। বিজেপি ভোটে জেতার জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থব্যয় করেছিল। রাজ্য কংগ্রেসের পতনের ফলে বহু কংগ্রেস নেতা এবং কর্মী বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন।ত্রিপুরায় জিতলেই বাংলায় জিতবে, এমন কোনো কথা নেই।
বিজেপি বলছে আপনার সরকার সংখ্যালঘু তোষণ করে। তার ফলে কি হিন্দু ভোটাররা আপনাদের থেকে দূরে সরে গেছেন?
এটা একটা মিথ, যা বিজেপি বিশ্বাস করে। ২৩ মে’র পর যখন ফলাফল ঘোষণা করা হবে, বিজেপি বুুুঝবে…বাংলায় সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য রয়েছে। এটা ঠিক যে বাংলায় ৩০ শতাংশ মুসলমান জনসংখ্যা, কিন্তু খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধও রযেছেন। কোনো বিদ্বেষ নেই। বিজেপি চাইছে এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে।
আসামেও যখন বিজেপি ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসে, পরিস্থিতি কিছুটা এরকমই ছিল।
প্রতিটা রাজ্য আলাদা, সব জায়গায় জেতার প্রক্রিয়া এক হতে পারে না। আসামে যা সফল হয়েছিল, বাংলায় তা সম্ভব নয়। বাংলাটা একটা মিনি-পৃথিবী। এখানে ২৩.৩ শতাংশ এসসি ভোটার, ৫.৯ শতাংশ আদিবাসী ভোটার, ১৭ শতাংশ ওবিসি ভোটার, তার ওপর সাধারণ ভোটার। আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি। বিজেপির প্রচার ওদেরই বিপক্ষে যাবে।

আপনার প্রচার সভায় আপনি রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়ার কথা বলেছেন, মা দুর্গা এবং মা কালীর পুজোর কথা…
আমরা ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে মুসলমান এবং অন্য সব ধর্মাবলম্বীরা একসঙ্গে থাকেন। আমি গঙ্গাসাগর যাই, যাকে বলা হয় ‘কুম্ভের প্রবেশপথ’…গণপতি বাপ্পা মোরিয়া, ছট পুজো, কালী এবং দুর্গাপুজো…শিখ মহিলারা যখন গুরুদ্বারে উৎসবের আয়োজন করেন, আমি সেখানেও গিয়ে তাঁদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করি। ওরা (বিজেপি) প্রচুর টাকা খরচ করছে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য। ওদের স্ট্র্যাটেজিটা ঠিক কী? গুজরাটে বলছে ‘বিহারী হঠাও’, আসামে বলছে ‘বাঙালি হঠাও’, মহারাষ্ট্রে বলছে ‘ইউপি হঠাও’। কোনদিকে যাচ্ছে বিজেপি? এই কি ‘অখণ্ড ভারতের’ দর্শন?
তাছাড়াও, হিন্দুত্ব এবং হিন্দুধর্ম এক নয়। এটা খুব স্পষ্ট করে দিতে চাই আমি। হিন্দুত্ব একটি রাজনৈতিক মতবাদ, হিন্দুধর্ম একরকমের জীবনযাপন। আমিও জন্মসূত্রে হিন্দু। ঈশ্বরের আরাধনা করি। হিন্দুধর্ম স্বভাবগতভাবেই অত্যন্ত উদার মতবাদ। আপনি রোজ প্রার্থনা না করলেও আপনি হিন্দু। ওরা ‘জয় শ্রী রাম’ কে রাজনৈতিক স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে, কিন্তু রাম তো একা বিজেপির নন। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ শুধু কালীভক্তই ছিলেন না, রামেরও ভক্ত ছিলেন। স্রেফ হনুমানের অস্ত্র বলে রাস্তায় রাস্তায় গদা দেখিয়ে বেড়ালে হিন্দু হওয়া যায়? এ তো বাংলার অপমান। বাঙালি হিন্দুরা স্বভাবত ভাল মনের। আপনি কটা আচার পালন করেন তার ওপর কিছু নির্ভর করে না।
এই মুহুর্তে বাংলায় বিজেপিই প্রধান বিরোধী দল। এ ব্যাপারে কি আপনি সহমত?
এটা সত্যি। প্রকৃতির নিয়মই এই, যে কোনো শূন্যস্থান ভরাট হয়ে যাবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমিও তো একসময় বিরোধী ছিলাম। বাংলায় এই পরিস্থিতি বাম এবং কংগ্রেসের ব্যর্থতার ফল। কিন্তু তার মানে কি এই যে বাংলার মানুষ বিজেপিকে গ্রহণ করেছেন? আদর্শগতভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক মনোভাব এখনও পছন্দ করে না বাংলা। সিপিএম এবং কংগ্রেস যদি নিজেদের আদর্শ মেনে চলত, তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত। কিন্তু ৩৪ বছরের সিপিএম শাসনে তৈরি হয় ‘হার্মাদ বাহিনী’, অর্থাৎ গুণ্ডা বাহিনী এইসব গুণ্ডারা এখন টাকার লোভে আশ্রয় নিয়েছে বিজেপিতে। খারাপ একটা ‘পয়সা কালচার’ আমদানি করেছে বিজেপি।
আপনি নিজে কিছু বলেন নি, কিন্তু বহু তৃণমূল কর্মী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার নাম তুলে ধরছেন।
না না। এই মূহুর্তে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেটা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূল ইস্যু হলো মোদীকে সরানো। আমি চেয়েছিলাম বিরোধী ঐক্য। বেড়ালের গলায় ঘণ্টা কাউকে তো বাঁধতে হবে। কাজেই আমি কলকাতায় বিরোধীদের জনসভা করার চেষ্টা করি। প্রত্যেক বিরোধী নেতা এসেছিলেন সভায়। আমাদের অনেক সিনিয়র নেতা আছেন, শরদ পাওয়ার, শরদ যাদব, দেব গৌড়া…দশজন প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার আছেন। নির্বাচনের পর আমরা সবাই একসঙ্গে বসে নাম ফাইনাল করব।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তো একজনই হতে পারবেন…
হ্যাঁ। কিন্তু সেটা নিয়ে সমস্যা হবে না, কোনোরকম স্থায়িত্বের অভাব হবে না, যেমনটা বিজেপি তাদের প্রচারে দাবি করছে। আসল কথাটা হলো, মানুষ বিরক্ত হয়ে গেছেন, এবং মোদী এভাবে চলতে থাকলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে উনি শেষ করে দিচ্ছেন। ডিমনেটাইজেশন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কোথাও চাকরি নেই। ডিমনেটাইজেশনের পরের দিন, মানে তার পরের সকালেই, পেটিএম-এর বিজ্ঞাপন বেরোল। পেটিএম কী করে জানল কী হতে যাচ্ছে? নরেন্দ্র মোদী ভাবছেন উনি ক্ষমতায় ফিরবেন। কিন্তু বাস্তবে পারবেন না। পরবর্তী সরকারের উচিত, সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা।
বাংলায় এই পরিমাণ রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটে কেন? বাম আমলেও হতো, কিন্তু আপনার আমলেও তো একই পরিস্থিতি।
কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে। নির্বাচনের সময় সব জায়গাতেই হয়। বিজেপি পরিচালিত ন্যাশনাল মিডিয়ার একাংশ সেটাকে বড় করে দেখায়। বাংলার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়। তাছাড়াও প্রচুর নকল ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরে। কিছু পুরোনো ছবি, কিছু তো আবার অন্য দেশের ছবি। একবার তো বাংলাদেশের একটা ছবি দিয়েছিল। খুবই দুঃখজনক।
কিন্তু টিভি চ্যানেলেও তো ভোটের দিন হিংসার ঘটনা দেখানো হয়েছে…
কিছু বিক্ষিপ্ত, ছোটখাটো ঘটনাকে বড় করে দেখাচ্ছে ন্যাশনাল মিডিয়ার বিজেপি পরিচালিত অংশ।
আপনার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনে ২০১৯-এ এসে আপনি শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দিল্লিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য তৈরি হচ্ছেন কি? এবারের নির্বাচনী খেলাটা কি আপনি পাল্টাতে পারবেন?
এটা ঠিক যে ২৩ মে’র পর বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল ব্যবধানে জয় পাবে। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ নিজেদের ভুল বুঝবেন, বাংলার মানুষ সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছেন, সেটা বুঝবেন। ওঁরা বাঙলাকে বোঝেন না। ওঁদের সিনিয়র নেতারা এটাও জানেন না, রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় জন্মেছিলেন না বীরভূমে, কিন্তু ওঁরা বাংলায় আসন পেতে চান। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। অনেকেই মনে করেন মোদী ফেরত আসবেন। মোদী নিজেও তাই ভাবেন। কিন্তু আমি জানি মোদীর পতন ঘটবে এবং নতুন সরকার গঠন হবে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কে হবেন?
বললাম না, আমাদের অনেক দাবিদার রয়েছেন, কেউ একজন হবেন। একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রার্থী নির্বাচন করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
নরেন্দ্র মোদী বিরোধীদের ‘মহামিলাওট’ আখ্যা দিয়েছেন, যেখানে দলগত আদর্শের কোনো মিল নেই।
এটা ভুল মূল্যায়ণ। মোদীর নীতি গরীবদের পক্ষে নয়। চাকরি নেই, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নেই। বহু অর্থনীতিবিদ, যেমন অমর্ত্য সেন, মোদীর অর্থনৈতিক মডেলের সমালোচনা করেছেন। গুজরাট তো স্রেফ একটা ছোট রাজ্য, এবং সেখানে মোদী যা করেছেন তার কৃতিত্ব গুজরাটিদের। তাঁরা স্বভাবতই ব্যবসায় দক্ষ। গুজরাট বাংলার মতো জটিল নয়। বহু দশক ধরে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার শিকার বাংলা।
মোদী আপনাকে ‘দিদি’ বলে থাকেন তাঁর ভাষণে। এই নির্বাচনের মূল সুরটাই যেন ‘মোদী বনাম দিদি’-তে দাঁড়িয়ে গেছে।
না, ব্যাপারটা তা নয়। আমি কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্কের উন্নতির চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু মোদী মুখে ‘ফেডারালিজম’-এর কথা বললেও রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস করেন না। রাজ্যের উন্নতিকে তিনি অগ্রাধিকার দেন না। দিল্লি তো সারা দেশ থেকে রাজস্ব আদায় করে, কিন্তু সেই টাকার ন্যায্য অংশ রাজ্যে আসে না।
কিন্তু পাল্টা অভিযোগও তো আছে আপনার বিরুদ্ধে। অসহযোগিতার অভিযোগ। আপনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের আধিকারিকদের ভিডিও কনফারেন্স বন্ধ করে দিয়েছিলেন, রাজ্যের অফিসারদের দিল্লিতে মিটিংয়ে যেতে অনুমতি দেন না, নিজে মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেন না…
ডাহা মিথ্যে কথা। ইন্টার স্টেট কাউন্সিলের মিটিংয়ে আমাকে দু’বার ডাকা হয়েছিল। দু’বারই গিয়েছিলাম। ওই মিটিংগুলোয় কিস্যু হয় না। মোদীই শুধু বলে যান, আর আমরা শুনি। আর ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল (এনডিসি)-এর মিটিং যেভাবে চালিত হয়, তা আমার অপছন্দের। নেহরুর উদ্ভাবিত প্ল্যানিং কমিশনের ধারণাটাকেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল প্ল্যানিং কমিশন গঠনে। আর এখন? নীতি আয়োগে ‘নীতি’-ই নেই কোনও।
আর ভিডিও কনফারেন্সের কথা যদি বলেন, যখন কোনও রাজ্যে একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী আছেন, তখন দিল্লি থেকে সরাসরি রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথা বলাটা ঠিক কাজ নয়। এটা সাংবিধানিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ। একবার রাজীব গান্ধী ভিডিও কনফারেন্স করে সরাসরি দেশের সব ডিএম-এর সঙ্গে কথা বলার নিয়ম চালু করতে চেয়েছিলেন। প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। রাজীব গান্ধীকে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল ওই পদ্ধতি।
রাজনীতির কথা থাক এবার। আপনার তো প্রচুর হাঁটার অভ্যেস…
হ্যাঁ, আমি রোজ কুড়ি কিলোমিটার হাঁটি। বাড়িতে থাকলে ট্রেডমিলে হাঁটি। কলকাতার বাইরে থাকলেও সুযোগ পেলেই হাঁটি। তবে দিনে কুড়ি কিলোমিটার কমপক্ষে হাঁটিই।
খানও তো খুবই কম। ফ্লাইটে তো দেখলাম শুধু শশা খেলেন।
(হাসি) এই গরমে ডিহাইড্রেশন আটকাতে শশা খাওয়া খুব উপকারী। তাছাড়া দিনে অনেকবার চা খাই।