ইঁটটা আচমকাই উড়ে এল। আধলা ইঁট, যে ধরনের ইঁট মাথা দুফাঁক করে দিতে পারে নিমেষে। কে ছুড়ল? দেখতে পাই নি, চাইও নি। তখন কুঁকড়ে গিয়ে গাড়ির জানালার লেভেল থেকে যতটা সম্ভব মাথা নামিয়ে দুহাত তুলে মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত আমরা দুজনে। দুজনেই পেছনের সিটে বসে, সঙ্গে আরেকটি সংবাদমাধ্যমের এক সতীর্থ, যিনি গাড়ির মেঝেতে প্রায় শুয়ে পড়েছেন আতঙ্কে।
প্রথম ইঁটটা উল্কার গতিতে পেছনের জানালা ভেঙে ঢুকেছে, এক চুলের জন্য বেঁচেছে মাথা। পরেরটা আছড়ে পড়েছে উইন্ডস্ক্রিনে, সঙ্গে সঙ্গে কাচ ফেটে চৌচির। হঠাৎ ব্রেক কষে থেমেছে গাড়ি, সেই ধাক্কায় আমাদের মাথা ঠুকে গিয়েছে জানালার ফ্রেমে। পাশাপাশি শুরু হয়েছে গুলির মতো ইঁট বৃষ্টি, একইসঙ্গে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত গাড়ির গায়ে। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে হিংসার মুখোমুখি হওয়া এই প্রথম নয়, কিন্তু এত তীব্র আক্রমণ আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
সোমবারের দুপুর, ঘটনাস্থল তেঁতুলিয়া, যেখানে ভোটকেন্দ্রে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ ওঠায় পৌঁছন বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিং। তিনি পৌঁছনো মাত্রই কেন্দ্রের বাইরে তৃণমূল কর্মীরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। সঙ্গে চলতে থাকে স্লোগান। সমগ্র ঘটনার খবর পেয়ে অকুস্থলে পৌঁছই আমরা (একাধিক সাংবাদিক এবং চিত্রসাংবাদিক)। হঠাৎই মিডিয়া কর্মীদের লক্ষ্য করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন তৃণমূল কর্মীরা। পরিস্থিতি ক্রমশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে বুঝে গাড়িতে উঠে বেরোনোর চেষ্টা করি আমরা। কিন্তু ততক্ষণে আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে।
গোটা ঘটনাটি ঘটে তেঁতুলিয়া ভোট কেন্দ্রের ৫০ মিটারের মধ্যে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সাংবাদিকদের আক্রান্ত হতে দেখেও কেন্দ্রীয় বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসে নি। এদিকে একের পর এক ইঁটের নিশানা তখন আমরা। আমাদের সতীর্থদের অবস্থা তথৈবচ। পাশের জানালার কাচ ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে এসে লাগছে ঘাড়ে, গালে, গলায়। অসংখ্য ছোট ছোট আঘাতে জ্বলছে মুখের একপাশ। শার্টের পকেট ভরে গিয়েছে ছোট বড় কাচের টুকরোয়।
গণতন্ত্রের সর্ববৃহৎ উৎসব পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের সাধারণ নির্বাচন। সেই সর্ববৃহৎ উৎসবে অংশ নিয়েই রক্ত ঝরালাম আমরা। বহাল থাকল রাজনৈতিক সন্ত্রাস। অন্যান্য দফাগুলিতে বিক্ষিপ্তভাবে হিংসার ঘটনা ঘটলেও, আজ পঞ্চম দফায় তা ভিন্ন মাত্রা পেল। কারণ এবার আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সংবাদ মাধ্যম।
যাঁরা আমাদের আক্রমণ করেন তাঁদের দাবি, তৎক্ষণাৎ ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। অথচ সাংবাদিকরা গাড়িতে উঠে গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পথে গাছের গুঁড়ি দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়।
না বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে থাকা নিরাপত্তা রক্ষী, না ভোট কেন্দ্রে মোতায়েন থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্মী, পরিস্থিতি সামাল দিতে কেউ এগিয়ে আসেন নি। কত বড় বিপদের হাত থেকে যে কত অল্পের জন্য আমরা রক্ষা পেয়েছি, ভাবলে এখনো শিউরে উঠছি।
আমরা ভাগ্যবান। কারণ আমাদের সতীর্থদের মধ্যে কারোর মাথা ফেটেছে, কারোর ভেঙেছে হাত। মিডিয়া কর্মীদের ওপর এই আঘাত পরিকল্পনা মাফিক করা হয়েছে মনে করলে কি খুব ভুল করা হবে? বোধহয় না। কোনও রকম উস্কানি ছাড়া এই আক্রমণ স্বাভাবিক নয় একেবারেই। একরকম অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছি, আপাতত সেটাই পরম প্রাপ্তি।