সিঙ্গুর এখন যেন রাজনৈতিক ভুলভুলাইয়া। নন্দীগ্রামের মত সিঙ্গুরের জমি রক্ষা আন্দোলনের প্রবীণ তৃণমূল নেতা এখন বিজেপিতে। অনিচ্ছুক কৃষকদের অনেকেই শিল্প চাইছেন। ইচ্ছুক বাম মনোভাবাপন্ন চাষিরা এখন বিজেপির মুখাপেক্ষী। এরইসঙ্গে এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রির জন্য জমি ঘিরে উন্নয়ন প্রক্রিয়া। ইট, পাথরের জমিতে ফলনের মরিয়া চেষ্টা কৃষকদের। সিঙ্গুরের হাল-হকিকত খতিয়ে দেখল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।
সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনই যে তৃণমূল কংগ্রেসকে এ রাজ্যে রাজনৈতিক জমি মজবুত করতে সাহায্য করেছিল, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরে নন্দীগ্রাম বামেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঢেউ তুলেছিল। সিঙ্গুর ছিল তার পথিকৃৎ। যত সময় গড়িয়েছে তত সিঙ্গুরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বদল ঘটেছে। নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের আর এক নেতা শুভেন্দু অধিকারী এখন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী। সিঙ্গুরের আন্দোলনের অন্যতম মুখ তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ৮৯ বছর বয়সে পদ্মশিবিরে যোগ দিয়েছেন। সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা এখন মাটিতে মিশেছে, চাষাবাদও হচ্ছে কিছু জমিতে।
এখনও ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে থাকেন। তাঁর বাড়িতেও গিয়েছেন দিদিসহ তৃণমূল কংগ্রেসের তাবড় নেতৃত্ব। দেড় বছর বয়সে জেল খেটেছে তাঁর ভাইঝি পায়েল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আন্দোলনের সময় পুলিশের মার খেয়েছিলেন। হাঁটুতে গুরুতর চোটও পেয়েছিলেন জয়দেব বাগ। সিঙ্গুরের পূর্ব বেড়াবেড়ি গ্রামের পাশে পূর্বতন টাটাদের অধিগৃহীত জমি ফিরে পেয়ে পরিস্কারের কাজ করছেন কৃষকরা। সেখানে দাঁড়াতেই স্থানীয় কৃষক জয়দেব বাগ হাজির। দূর থেকে অচেনা মুখ দেখতেই তিনি খোঁজ নিতে এসেছেন। তিনি ছিলেন অনিচ্ছুক কৃষক।
আরও পড়ুন: ‘কার জন্য খাটব?’ তৃণমূল নিয়ে চরম আক্ষেপ সিঙ্গুরের ‘শহিদ’ তাপসী’র বাবার
জমির কী হাল? জয়দেববাবু একনাগারে বলতে শুরু করলেন, "এখন জমি চাষ করতে পারছি। আমার সব জমিতে আলু চাষ হচ্ছে। জমিতে যে ইট-পাথর ছিল তা একশো দিনের কাজে পরিস্কার করে দিয়েছিল। তবে সম্পূর্ণ ঠিক করতে ২ বছর সময় লাগবে। ক্ষতিপূরণ হিসাবে জমির মূল্য পেয়েছি। মাসে ২ হাজার করে টাকা পেয়েছি। আর মসে ১৬ কেজি কে চাল পাচ্ছি।"
এখন আপনি কি শিল্প গড়ার পক্ষে না বিপক্ষে? এই প্রশ্নে কিন্তু সিঙ্গুরের শিল্পের জন্য জমি দিতে অরাজি এই চাষি হকচকিয়ে যান। জয়দেববাবু বলেন, "আগে অনিচ্ছুক ছিলাম। বাঁধের ওধারের জমি নিলে কেউ অনিচ্ছুক থাকত না। ওরা একেবারে বাড়ির গা অবধি টেনে নিয়েছিল। সেই জন্য কৃষকদের একটা বড় অংশ ইচ্ছুক ছিল না। এখন চিন্তাভাবনা না করে বলা যাবে না।" শিল্প নিয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত একসময়ের অনিচ্ছুক চাষিরা। শিল্প স্থাপনের সেই সরাসরি বিরোধিতায় অনেকেই নেই।
তবে টাটাদের শিল্পের জন্য যে সব কৃষক স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছিলেন তাঁরা এখনও চাইছেন শিল্প হোক। তাঁরা মনে করছেন, তাহলেই বেকাররা চাকরি পাবে। বেড়াবেড়ি বাজারের বাসিন্দা তেষট্টি বছরের লক্ষ্মীকান্ত বাগের তিন বিঘে জমি আছে। লক্ষ্মীকন্তবাবু বলেন, "আমি ইচ্ছুক চাষি। জমি দিয়ে কিছুই পাইনি। আমি ২ বিঘে জমিতে আলু চাষ করেছি। শিল্পের জন্য জমি নিলে অনেকেই আপত্তি করবে না। কর্মসংস্থানের স্বার্থে শিল্পের প্রয়োজন। আমার জমি যদি শিল্পের জন্য ফের চায় নিশ্চয় দেব। জমি ফিরে পেলেও তা চাষের উপযুক্ত করতে মরণপন লড়াই করছেন কৃষকরা। ব্যয় হচ্ছে অর্থ। ৬৫বছরের হারাধন বাগ। তাঁর আক্ষেপ, "আড়াই বিঘে জমি। আমি ৩৫ হাজার টাকা খরচ করেছি জমি চাষযোগ্য করতে। জমির ওপর দিয়ে রাস্তা গিয়েছিল। জমিতে বিম রয়েছে অসংখ্য, ছিল পাথরের টুকরো।" জমিতে গিয়ে দেখা গেল গোপাল দে, রতন বাগ অনেকেই জমিতে চাষের কাজে ব্যস্ত। আবার খাসেরবেড়ির শরৎ ঘোষের মত কৃষকরা চাইছেন শিল্প।
সিঙ্গুরের অনেকেই শিল্প স্থাপনের আশায় দিন গুনছেন। সাহেব পাড়ার বাড়ুই পরিবারের সদস্যরা জানালেন শিল্প স্থাপেন তাঁরা আশাবাদী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পরিবারের এক সদস্য বলেন, "আমার বাড়ির একজন টাটা সংস্থায় ট্রেনিং নিয়েছে। সে চাকরিও পেয়ে গিয়েছে। চাকরিটা সিঙ্গুরে হতে পারত। আমি এখনও আশা করছি সিঙ্গুরে শিল্প হবে। জানি না বিজেপি কী করবে। বিজেপি নেতাদের বলেছি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেবেন না। ওরা বলেছে শিল্প হবে। দেখা যাক কী হয়।" টাটাদের অধিগৃহীত জমির মধ্যে ১৩ একর জমি পড়েছে বিশিষ্ট চিকিৎসক উদয়ন দাসের। সেই জমিতে বহুমুখী হিমঘর, গোটারি ও ফিসারি প্রকল্পও চালু হয়েছিল। বাম মানসিকতার এই চিকিৎসকের বড় আক্ষেপ সিঙ্গুরে শিল্প না হওয়ায়। হিমঘরতো কবেই মাটিতে বসে গিয়েছে। তিনি বলেন, "সিঙ্গুরের জমিতে এই মুহূর্তে কিছুই করতে পারছি না। কোনও কিছুর অনুমতি জন্য হাজার বার ঘোরানো হচ্ছে।"
২ নম্বর জাতীয় সড়ক তথা দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ের পাশে সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার জন্য ৯৯৭.১১ একর জমি অধিগৃহীত হয়েছিল। অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে ২০০৬-এ জমি আন্দোলন শুরু হয়। ৩১ অগাস্ট ২০১৬-তে জমি ফেরত দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়। ৮০ বছরের উর্দ্ধদের টিকিট দেওয়া হবে না এই কারণে সিঙ্গুর আন্দোলনের অন্যতম মুখ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে তৃণমূল কংগ্রেসে টিকিট দেয়নি। প্রার্থী করা হয়েছে বেচারাম মান্নাকে। পাশের হরিপাল কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছেন তাঁর স্ত্রী করবী মান্না। এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন অশীতিপর মাস্টারমশাই।
আরও পড়ুন: কমিশনের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর, জয়পুরের তৃণমূল প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল ডিভিশন বেঞ্চের
তৃণমূল প্রার্থী বেচারাম মান্নার কথায়, "সিঙ্গুরের গ্রামে গ্রামে কংক্রিটের রাস্তা হয়েছে, কলেজ স্থাপন হয়েছে। কিষাণ মান্ডি, ট্রমা কেয়ার সেন্টার হয়েছে। জাতীয় সড়কের পাশে ১১ একর জমিতে এগ্রো-ইন্ডস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির কাজ চলছে। বিজেপি চাইছে সিঙ্গুরে শিল্প হোক। বিজেপি নেতা মনসাচরণ মাইতি বলেন, "আমাদের মূল ইস্যু সিঙ্গুরে শিল্প স্থাপন করা। বহু বছর কেটে গিয়েছে। ওই জমিতে চাষাবাদ সম্ভব নয়।" সিপিএম এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যকে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন