/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/05/Jesop-Express-Photo-Joy-Prakash-Das.jpg)
বন্ধ জেসপ। এক্সপ্রেস ফটো: জয়প্রকাশ দাস।
জেসপ কারখানার ৩ নম্বর গেটে শ্রমিকদের জটলা। কথা বলতেই জানা গেল, কারখানা বন্ধ হলেও রোজই তাঁরা আসেন। কারখানার ভূত-ভবিষ্যৎ, নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প-গুজব করে বাড়ি ফিরে যান। জেশপে গেলে নিত্য এই দৃশ্য চোখে পড়বে। কারখানায় কোনও কাজ না থাকলেও 'অফিস টাইমিং' অনুযায়ী তাঁরা সেখানে বসে বসে 'ডিউটি' দেন। কারখানার শ্রমিকদের কাছে ভোট এখন বাতুলতা। একদা রেলের উন্নতমানের ইএমইউ কোচ নির্মানের অন্যতম সংস্থা জেসপ আজ এভাবেই 'চলছে'।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/05/92c73554-2d07-4714-bc01-12116cd89191.jpg)
কারখানার শেডের নীচে গড়াগড়ি খাচ্ছে রেলের চাকা। কোথাও আবার টিনের শেডও চুরি হয়ে গিয়েছে। কারখানার ভিতরে লোহার বিশ্বকর্মা মন্ডপ যেন পোড়ো মন্দির। লাগাতার চুরির ফলে কারখানার ভিতরটা এখন ফাঁকা ময়দান। আর কাজহীন শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছেন কারখানার ৩ নম্বর গেটে। তাঁদের গলায় হতাশার সুর স্পষ্ট। শরীরি ভাষায় ভোট নিয়ে বিরক্তি ঝরে পড়ছে। বিগত পাঁচ বছরে আটজন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন, বাকিরা কোনওরকমে এখনও দিন গুজরান করছেন।
রাজ্য সরকার ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারখানা অধিগ্রহণের পর তিন বছর কেটে গিয়েছে। এখনও অধিগ্রহণ বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর মেলে নি। শ্রমিকদের একমাত্র ভরসা, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী মাসে ১০ হাজার টাকা। আর যাঁরা অবসর নিয়েছেন বা কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের পরিবারের অবস্থা সঙ্কটজনক বললে কম বলা হয়। মাসিক পেনশনের অঙ্কটা চমকে ওঠার মতো - স্রেফ ১ হাজার টাকা। এই পেনশনে এই বাজারে আর কী হয়! শ্রমিকরা আক্ষেপের সুরে বলছেন, বাঙালী রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তিনিও কারখানার শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ালেন না।
কেমন আছেন আপনারা? সকলের মুখের ভাব দেখে মনে হলো, প্রশ্ন করাটাই অন্যায় হয়েছে। বন্ধ কারখানার শ্রমিক আর কেমন থাকবে, ভেসে এল উত্তর। মজুরি তামাদি হয়ে গিয়েছে। ফলে তাঁদের কাছে বেঁচে থাকাটাই এখন বড় দায়। সন্তানের নাচ শেখার ফি দিতে না পারায় আত্মহত্যা করেছেন এই কারখানার শ্রমিক প্রশান্ত কর্মকার। পাঁচ বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা আট। এক হাজার টাকায় কারও একমাস চলতে পারে, প্রশ্ন করেন কনিকা ঘোষাল, শিখা দেবনাথরা। তাঁরা বলেন, "আমাদের জন্য কেউ ভাবছে না। আজকের দিনে এক হাজার টাকায় কিছু হয়? এই টাকায় বেঁচে থাকাই তো দায়!" চারশো শ্রমিক বেকার, তবু ভোটের ময়দানে জেসপ এখন আর ইস্যু নয়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/05/72328559-c727-4aea-8efb-ba7dec8759ee.jpg)
গত দুবারের সাংসদ সৌগত রায়কে নিয়েও শ্রমিকরা তাঁদের ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। আইএনটিটিইউসি নেতা শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "২০১৬ সালে জেসপ অধিগ্রহণ করেছে রাজ্য সরকার। শ্রমিকদের প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে দিচ্ছে রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছি, মৃত ও অবসরপ্রাপ্তদের পরিবারগুলোকে ৫ হাজার টাকা করে এক্স গ্রাশিয়া দেওয়া হোক। তাহলে অন্তত পরিবারগুলো বাঁচবে। কারণ, যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদের পরিবার ১ হাজার টাকা করে পেনশন পায়। সেই টাকায় কি সংসার চলে? আমাদের ইএসআই আছে। ওদেরও মেডিক্যালের ব্যবস্থা করে দিক। খাদ্য দফতর বিনে পয়সায় রেশন দিক।" তিনি আরও জানান, "আমরা ৫০ হাজার লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে দিয়েছি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কাছে আবেদন করেছি। এখনও কাজের কাজ কিছু হয় নি।"
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/05/8477d86b-bcf6-45d3-9f6e-95bf0d9d0710.jpg)
পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে কারখানা বন্ধ। তবুও জেসপের কর্মীরা কারখানায় গিয়ে রোজ হাজিরা দেন। দিনভর সেখানে কাটিয়ে বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যা নাগাদ। এখনও আশা ছাড়েন নি তাঁরা। কারখানার যন্ত্রাংশও নিয়ম করে রোজ চুরি হয়। শ্রমিকদের বক্তব্য, "এ তো আর শুধু চুরি না, চোখের সামনেই কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এ যেন 'মাষ্টারমশাই আপনি কিছুই দেখেন নি'।" এসবের সঙ্গে কারা জড়িত? জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে অনেকেরই মদত রয়েছে বলে অভিযোগ। "সঠিক তদন্ত হলেই বেরিয়ে পড়বে কারা রয়েছে চুরির পিছনে। তা কী সম্ভব! ঘরশত্রু বিভীষণ। এখনও চুরি অব্যাহত।" দীপক রাম, আশিষ চক্রবর্তী, অভিজিৎ নন্দীরা এভাবেই ক্ষোভ উগরে দিলেন। তাঁদের অভিযোগ, গ্যাসকাটার দিয়ে মেইন গেট কেটে ট্রাক ট্রাক যন্ত্রপাতি গায়েব হয়ে গিয়েছে। কে জড়িত নয়, সেটাই তাঁদের প্রশ্ন।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/05/586a700c-d8ca-4070-aa62-f9864555af2c.jpg)
আদৌ কি খুলবে জেশপ? সেই প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসে শ্রমিকদের মনে। মুখ্যমন্ত্রীর ১০ হাজার টাকার অনুদান পেলেও নির্বাচন নিয়ে একেবারেই নিস্পৃহ তাঁরা। ১৯ মে ইভিএমের কোন বোতামে আঙ্গুল পড়বে তা নিয়ে নিজেরাই সংশয়ে রয়েছেন। খোলসা না করলেও ইঙ্গিতে স্পষ্ট, 'চাপ' রয়েছে শাসকদলের।
১৫০ বিঘে জমির ওপর দমদমের মূল কারখানা। বর্তমানে এই জমির মূল্যই প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। কারখানার কাছেই রয়েছে দেড় বিঘার মত আর একটা জমি। এছাড়া দুর্গাপুরে জেসপের আরও ৭০ বিঘা জমি আছে, জানালেন শ্রীকুমারবাবু। এখানকার সাংসদ বা রাজ্যের কোনও মন্ত্রী আপনাদের সাহায্য করেন নি? তাঁদের জবাব, "আমরা মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করি না। কারও কাছে সাহায্য পাইনি।"
২০১৪-তে সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের নোটিশ ঝোলে জেসপে। দেশের প্রথম ইএমইউ কোচ নির্মানকারী সংস্থা ১৯৯৫-তে বিআইএফআর-এ যায়। ২০০৩ সালে নামমাত্র মূল্যে পবন রুইয়ার হাতে জেসপ তুলে দেওয়া হয়। আধুনিকীকরণের জন্য সরকার দেয় ৩৬৩ কোটি টাকা। সেসময় কর্মীর সংখ্যা ১,৭৭৪ থেকে ৯০০ হয়ে যায়। এখন কর্মীর সংখ্যা ৩৯০। শ্রমিকদের দাবি, সম্প্রতি কারখানার সম্পত্তি দখলদারির জন্য নোটিশ ঝুলেছে দরজায়। এর পিছনেও রুইয়ার ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করছেন কাজ হারানো শ্রমিকরা।