১৯৯৫-তে মায়ের মৃত্যু হয়েছিল বিনা-চিকিৎসায়। তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা গাড়িও জোটেনি। তিন ভাই-তিন বোনের অভাবের সংসারে জোটেনি পড়নের পোষাক। এঁটো খাবারই ছিল একমাত্র সম্বল। প্রথাগত পড়াশুনাও হয়ে ওঠেনি। আজ মালবাজার থানার ধলাবাড়ির ৫৪ বছরের করিমূল হক সারা উত্তরবঙ্গের গর্ব। জেদ আর অধ্যাবসায় একটা মানুষকে কতটা উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে তা পদ্মশ্রী করিমূলের কার্যকলাপ না দেখলে কারও বিশ্বাস হবে না। শিলিগুড়িতে প্রচারে এসেও প্রধানমন্ত্রী রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে করোনা পরিস্থিতিতেও জড়িয়ে ধরনে বাইক অ্যাম্বুলেন্সের জনককে।
শিলিগুড়ি থেকে গাজোলডোবা হয়ে ধলাবাড়ি। করিমূলের বাড়ি যাব বলতেই অনেক আগে থেকেই মানুষজন বলতে থাকলেন কোন পথ ধরে তাঁর বাড়ি পৌঁছানো যায়। একটা হাসপাতাল নির্মানের কাজ চলছে। গ্রামের মানুষের জন্য জলপ্রকল্প রয়েছে। চালু রেখেছেন ৮টা স্কুল। অথচ করিমূল নিজে থাকেন বাঁশের বেড়ার ঘরে। করিমূলের কার্যকলাপ একজন চিকিৎসকের মতোই। তিনি নিজেকেও চিকিৎসক বলেই দাবি করেন। "আমার ব্যাগে স্টেথো, সুগার টেস্ট, হিমোগ্লোবিন, অক্সিমিটার, সেলাইয়ের ছুঁড়ি-কাঁচি, সহ নানান যন্ত্র থাকে। স্পটে কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে সেলাই করে দিতে পারি।" বলেন করিমূল।
কী ভাবে এমন অসাধ্য়সাধন করলেন? ধলাবাড়ির নির্মিয়মান হাসপাতালে বসে করিমূল বলেন, "আমার মা অনুপ্রেরণা। বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিল। টাকা ছিল না, গাড়ি ছিল না। অসহায় হলে মানুষের দরজায় গেলে তাড়িয়ে দেয়। তাই মোটরসাইকেলকে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়েছি। গ্রামের কোনও মানুষের যেন বিনাচিকিৎসায় মৃত্য়ু না হয়। স্যালাইন দেওয়া, স্টেথো ধরা, সেলাই করা সব শিখেছি। আমার দুই ছেলে ৩৫ বছরের আহাচানুল হক ও ২৭ বছরের আমিনুর হক আমার সঙ্গে অনেক কিছু শিখেছে। হাসপাতাল তৈরি করতে ইতিমধ্যে ৬০-৭০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে।"
প্রত্য়ন্ত এই ধলাবাড়ির দূরত্ব শিলিগুড়ি থেকে ৫০ কিলোমিটার। তাছাড়া ৬০-৭০ কিলোমিটার দূর থেকে রাত-বিরেতে সাহায্য়ের জন্য় ফোন আসে করিমূলের কাছে। এই বাইক অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কোনও বাধা পেয়েছেন? করিমূল বলেন, "বাইক আবার অ্যাম্বুলেন্স", এমন নানা টিটকারি শুনতে হয়েছে। লোকে আমাকে পাগল বলত। যে প্রথম টিটকারি করেছিল তাঁকেই প্রথম সাপে কেটেছিল। তিনি আমার বাইক অ্যাম্বুলেন্সে করেই হাসপাতাল গিয়েছিলেন। তারপর তাঁর প্রাণ রক্ষা হয়েছিল। হাসপাতালে যাওয়ার পথে জঙ্গলে হাতি, বাঘ ও বাইসনের পাল্লায়ও পড়েছি। জঙ্গলে ছিনতাই পার্টির খপ্পরে পড়েছিলাম। অ্য়াম্বুলেন্স কাকু বলে তাঁরাই আমাকে ৩০০টাকা দিয়েছে।" প্রধানমন্ত্রীকে ও মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছি চেল নদীতে একটা সেতু করার জন্য। জানান, করিমূল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একবার না অনেকবার সাক্ষাৎ হয়েছে এই পদ্মশ্রী প্রাপকের। করিমূলের কথায়, "ব্যক্তিগত ভাবে কেন এত ভালবাসে জানি না। করোনা মহামারীতেও কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক ভাবে না থাকলেও একটা বড় মিল আছে। উনি মাকে ভালবাসেন, আমিও মাকে ভালবাসি। ইসলাম বলেছে অন্য ধর্মের লোককে ভালবাসতে। আমি চেল নদীর সেতুর কথা বলেছি। আর উত্তরবঙ্গে এইমস করতে আবেদন করেছি। প্রধানমন্ত্রী ভেবে দেখবেন বলে কথা দিয়েছেন।" অটোবায়োগ্রাফীর শুটিং শুরু হওয়ার কথা ১৫ এপ্রিল। করোনা আবহে তা পিছিয়ে গিয়েছে। জানালেন করিমূল।
রাজ্য়ে বিধানসভা নির্বাচন চলছে। শিলিগুড়িতে করিমূল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করছেন। কিন্তু নিজেকে রাজনীতির উর্দ্ধে রেখেই মানবিকতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। এটাই তাঁর নেশা। এখানেই তিনি সার্থক।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন