রাজ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ নিয়ে সরব ডান-বাম সব পক্ষই। আগের সমস্ত নির্বাচনের হিসেব গুলিয়ে দিয়ে এবার জাতপাতের ভোটে রাজ্য সব থেকে এগিয়ে রয়েছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। এবার পরিবর্তনের আন্দোলনের অন্যতম নন্দীগ্রামেও কী মেরুকরণের ভোট হতে চলেছে? সেখানে শুভেন্দু অধিকারীই বা কতটা ফ্যাক্টর? বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, 'ওদের ভরসা ৬২ হাজার ভোট আর অন্যদিকে ২ লক্ষ ১৩ হাজার জয় শ্রীরাম বলা লোক রয়েছেন।' রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য ছিল, গেরুয়াশিবিরে পা রেখেই মেরুকরণের পথে হেঁটেছেন শুভেন্দু। মেরুকরণের রাজনীতি না শুভেন্দুর দলবদল ফ্যাক্টর কতটা কাজ করবে তা খতিয়ে দেখতে নন্দীগ্রামে হাজির হয়েছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।
নন্দীগ্রামের প্রাক্তন বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর তৃণমূলের ভাঙন যে একেবারে ঘটেনি তা নয়। শুভেন্দুপন্থী অনেকেই যোগ দিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে। তাঁরা যোগ দেওয়ার পর প্রথম দিকে আদি বিজেপির সঙ্গে গন্ডগোলও হয়েছে। দেখা গেল তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি মেঘনাথ পালের পাশে বসে রয়েছেন নন্দীগ্রাম বিধানসভা বিজেপির কো-কনভেনর দেবাংশু মাইতি। টেঙ্গুয়া মোড়ের অফিসে বসে মেঘনাথ পাল বলেন, "আমরা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেস সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। প্রচারে বাধা দিচ্ছে। ফোন বা সারাসরিও হুমকি দিচ্ছে। আমি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য আবেদন করেছি। আমার কাছে পিকের টিমও এসেছিল। আমাকে তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছি।"
তৃণমূল তো বলছে এখানে তাঁদের জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কী বলবেন, "তৃণমূল কংগ্রেস স্বপ্ন দেখছে। এখানে যিনিই বিজেপির প্রার্থী হবেন তিনিই জিতবেন। শুভেন্দুবাবু বলেছেন ৫০ হাজার ভোটে হারাব। আমাদের অনুমান, আরও বেশি ভোটে হারাবেন তৃণমূল প্রার্থী।" তাঁর অভিযোগ, "কেন্দাবাড়ি, দাদপুর, সামসাবাদসহ বেশি কিছু মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ভয়-ভীতি বেশি। একশো শতাংশ সংখ্যালঘু অঞ্চলে কর্মীরা কাজ করতে পারছে না। সেই সব অঞ্চলে ভয়ে যেতে পারছেন না কর্মীরা।" শুভেন্দু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "তৃণমূলে থাকলেও শুভেন্দুর সঙ্গে অনেকেরই যোগাযোগ রয়েছে। নন্দীগ্রামের ৬০ শতাংশ তৃণমূল নেতৃত্ব আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তাঁরা আসার জন্য এক পা এগিয়ে আছে।"
বিজেপি নেতা প্রলয় পালের বক্তব্য, নন্দীগ্রামে মুসলিম ভোটের সবটাই তৃণমূল পাবে না। শতাংশের হিসাবে মুসলিম ভোট তৃণমূল কংগ্রেস বেশি পাবে, তবে ওরা যে ভেবে রেখেছে সবটাই পাবে তা সম্ভব নয়। প্রচুর মুসলিম আমাদের সংগঠনের হাল ধরেছে। ওরা মুর্খের স্বর্গে বাস করছে। ভোট যত এগিয়ে আসবে আরও মুসলিমরা এগিয়ে আসবে। নন্দীগ্রাম ১-এ ৩৫ শতাংশ, নন্দীগ্রাম ২-এ ১২-১৪ শতাংশ মুসলিম। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় দাঁড়াক বা যেই দাঁড়াক নন্দীগ্রাম বিজেপি পাবে আটকাবার কোনও ক্ষমতা নেই। তাঁর মতে, "শুভেন্দু আসায় শক্তি বেড়েছে। যাঁরা আসবে না তাঁরা গোপনে থেকে ভোট করে দেবে। তাছাড়া করোনা, আমফান নিয়ে দুর্নীতির পাহাড় জন্মেছে।"
বিজেপি নেতৃত্বের এসব দাবিকে তোয়াক্কা করছেন না নন্দীগ্রামের তৃণমূল নেতৃত্ব। তাছাড়া শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে গিয়ে লাভের লাভ কিছু হবে না বরং সিপিএমের লক্ষ্মণ শেঠের দশা হবে বলে দাবি করলেন একসময়ের সহযোগী তৃণমূল নেতা আবু তাহের। গোপীমোহনপুরে আবু তাহেরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল উঠোনের চৌহদ্দিতে নিরাপত্তা কর্মীদের থাকার ঘর তৈরির কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। ওয়াই ক্যাটাগড়ির নিরাপত্তা পেয়েছেন আবু তাহের। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে জমি আন্দোলনের নেতা বলেন, "নন্দীগ্রামে প্রথমে ভূমি আন্দোলনে আমার মতো স্থানীয়রা নেতৃত্ব দেন। তাঁরাই প্রথম সারিতে ছিলেন। পরে নেতৃত্ব দেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দিন, যেমন ৩ জানুয়ারি, ৭ জানুয়ারি, ১৪ মার্চ ও ১০ নভেম্বর মিছিলের ওপর আক্রমণ হয়েছে। ওই মিছিলে উনি হাঁটেননি। তিনি পরে এসেছেন। আমরাই সব কিছু করেছি। ঘরছাড়া হয়েছে নন্দীগ্রামের মানুষ। বাইরের মানুষ তো ঘরছাড়া হয়নি। কষ্ট করেছে নন্দীগ্রামের মানুষ।" কেন তিনি শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে বিজেপিতে ভিরে যাননি তা এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন আবু।
মেরুকরণের রাজনীতি এবারের ভোটে কোনও প্রভাব পড়বে না বলেই দাবি আবু তাহেরের। তাঁর মতে, "এখানে বিভাজনে কোনও কাজ হবে না। এখানে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক ভারতবর্ষে নজির। এখানে হিন্দু সম্প্রদায়কে উসকানো হচ্ছে। পঞ্চায়েত চালাচ্ছি হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে। প্রচারে আপাতত বুথ ভিত্তিক ছোট ছোট মিটিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। দলনেত্রী এবার আর বলে-কয়ে আসবেন না। আচমকা আসবেন।" জানান তিনি।
নন্দীগ্রামের আন্দোলনের নেতা হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন। আবার জাহাজ বাড়ি বানিয়েও যথেষ্ট প্রচার পেয়েছেন। তাঁর এই আলিসান জাহাজ বাড়ির কথা তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও জানে। সেই বাড়ি ঘেঁষা দলীয় কার্যালয়ে বসে শেখ সুফিয়ান বিজেপি নেতাদের অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন। জেলা তৃণমূলের এই নেতা বলেন, "অযথা আতঙ্কের নাটক করছে বিজেপি। নিরাপত্তা কর্মী সঙ্গে নিয়ে ঘুরে স্টাইল দেখাচ্ছে তাঁরা।" তাঁর বক্তব্য, সাম্প্রদায়িক কথাবার্তাকে ঘৃণা করেছে বাংলার মানুষ। শুভেন্দু কেন তৃণমূলে গিয়েছে তার জবাব দিতে পারেনি। তাহেরের সুরে সুর মিলিয়ে সুফিয়ানও বলেন,'লক্ষ্মণ শেঠের হাল হবে শুভেন্দুর।'
আমফনের দুর্নীতির কথা মানতে নারাজ সুফিয়ান। তিনি বলেন, "এটা পরকল্পিত ভাবে মানুষের গায়ে কালির দাগ লাগানো হয়েছে। মিথ্যা অপপ্রচার করে তৃণমূলের ক্ষতি করেছেন। বিজেপিকে অক্সিজেন দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমফানে কোনও দুর্নীতি হয়নি। যাঁরা প্রকৃত প্রাপক তাঁরা টাকা পেয়েছে। তাছাড়া নন্দীগ্রামে রাস্তাঘাট, উন্নত হাসপাতাল, জল প্রকল্প, রাজ্য সরকারের একাধিক প্রকল্পের রূপায়নসহ লাগাতার উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে।" তাঁর অভিযোগ, বামেরা এই আসন ছেড়ে দিয়েছে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য।
নন্দীগ্রামে সাধারণ তৃণমূল কর্মীরা অনেকে রাজনীতি থেকেই উতসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। ভোটের মুখে তাঁরা নিজের নিজের কাজ-কর্ম নিয়েই ব্যস্ত। ভোটের মুখে কেন্দামারিতে চিংড়ি চাষের ভেড়ির জল প্রস্তুতির কাজ করছেন শেখ জুলফিকার। তাঁর মতে, বিজেপিতে যোগ দিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য এখানকার তাঁদের সম্প্রদায় ভালভাবে নেয়নি। ভোট পাবে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। এদিকে সোনাচূড়ার রমেন গোঁসাই জানিয়ে দিয়েছেন, শুভেন্দু অধিকারী সেদিকেই আমরা। নন্দীগ্রাম দুনম্বর ব্লকে বুথে গেরুয়া শিবির অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তবে নন্দীগ্রাম এক যেখানে আন্দোলনের আঁতুরঘর ছিল সেখানে 'দুপক্ষের লড়াই হবে জোরদার। বুথের সংখ্যাও বেশি নন্দীগ্রাম এক-এ।
২০১৯ লোকসভার নিরিখে নন্দীগ্রামে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ১,৩০,৬৫৯। বিজেপি ভোট পায় ৬২,২৬৮। তিন নম্বর স্থানে সিপিআই প্রার্থীর বরাতে জোটে ৯,৩৫৩ ভোট। এই নন্দীগ্রামেই ১০ বছর আগে বিধানসভা ভোটে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ১.৭২ শতাংশ। তৃণমূল পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৬১.২১ শতাংশ ভোট। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা আরও বেড়ে ৬৭.২০ শতাংশ। বিজেপি পায় ৫.৪০ শতাংশ ভোট। এবার ওই আসনে তৃণমূলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে বিজেপি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন