পাহাড়ে নির্বাচন ১৮ এপ্রিল। তার দুদিন, অর্থাৎ ৪৮ ঘন্টা আগে, প্রচারপর্ব শেষ হয়ে যাবে। রাজ্যের বাকি জায়গায় লোকসভা ভোটের প্রচারের জোয়ার চলছে। অথচ পাহাড়ে তন্ন তন্ন করেও ভোট প্রচারের পোস্টার, ব্য়ানার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কী হল পাহাড়ে? প্রার্থীদের প্রচার কোথায়?
পাহাড়ে সাধারনত সমতলের মত দেওয়াল লিখনের জায়গা বিশেষ নেই। বাড়ির দেওয়ালে লেখা সম্ভব নয়। অতএব কর্মব্য়স্ত দার্জিলিংয়ে এখনই ভোটপ্রচারে নামছে না কোনও দল। মজার কথা হলো, দার্জিলিং আসনের জন্য় সমতলে জোরকদমে প্রচার করছে সব পক্ষই। কিন্তু পাহাড়ে প্রচারে ঝাঁপানোর আগে সব দলই জল মাপছে এখনও। দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়ং, সর্বত্রই এক অবস্থা। পাহাড়বাসীর একাংশের বক্তব্য়, "কীভাবে ভোট চাইতে আসবে? গোর্খাল্য়ান্ড দূরের কথা, সামগ্রিক উন্নয়নের কথাও কেউ ভাবছে না। পাহাড়ে জগাখিচুড়ি রাজনীতি চলছে। এটা আমরা চাই না।"
আরও পড়ুন: Lok Sabha polls 2019: ভোট নয়, ‘হোম মেড টি’ সঙ্গী করে লড়াই চা শ্রমিকদের
এই ক্ষোভের ওপর প্রলেপ রয়েছে আপাত নিস্পৃহতার। ভোট নিয়ে যতই উত্তাপ-উত্তেজনা থাক সমতলে বা কলকাতায়, দার্জিলিং, কালিম্পং ও কার্শিয়ংয়ে ভোট নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্য়ে আপাতদৃষ্টিতে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। যুযুধান কোনও পক্ষ এখনও সেভাবে প্রচারে নামে নি। তবে দমবন্ধ চাপা পরিস্থিতি রয়েছে পুরো পাহাড়জুড়ে। চোরাস্রোত স্পষ্ট। কখনও তা প্রকাশ্য়েও চলে আসছে। কোন চিহ্নে বোতামে চাপ পড়বে তা বোঝা মুশকিল। তবে এবারের লড়াই যে বেশ কঠিন, তা ইতিমধ্যে বুঝতে পারছে প্রধান দুই পক্ষই।
কালিম্পং, দার্জিলিং, কার্শিয়ং, মাটিগাড়া-নক্সালবাড়ি (এসসি), শিলিগুড়ি, ফাঁসিদেওয়া (এসটি) ও চোপড়া, এই সাতটি বিধানসভা নিয়েই দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নানা বিশেষত্ব রয়েছে এই অঞ্চলে। পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কাছে ভোট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কী বলছেন তাঁরা? শরণ তামাং। পেশায় গাড়িচালক। সিভিক পুলিশের অত্য়াচার নিয়ে সরব তিনি। তাঁর মতে, "এভাবে গাড়িচালকদের হয়রানি করার কোনও মানে হয় না।" সরকার পক্ষের প্রতি তাঁর ক্ষোভ, রাগ উগরে দিলেন। লোকসভার ভোটে স্থানীয় ইস্য়ু যে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ, তা শরণের কথায় স্পষ্ট।
দার্জিলিংয়ের বাসিন্দা সঞ্জয় ছেত্রী, উমেশদের ভোট নিয়ে ভাবার সময় নেই। তবে এবারের ভোট যে মারকাটারি হতে চলেছে, তা তাঁদের বক্তব্য়ে পরিস্কার। পাহাড়ের নেতাদের ঐক্য় যে "চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে", তাও বলতে ছাড়ছেন না পাহাড়ের মানুষ। প্রায় দেড়শো বছর ধরে দার্জিলিংয়ে রয়েছেন ব্য়বসায়ী বি পি আগরওয়ালের পরিবার। নিজেকে পাহাড়বাসীই বলেন তিনি। এই প্রৌঢ়ের বক্তব্য়, "২০১৭ সালের অরাজকতা ভোলেন নি পাহাড়ের মানুষ। এখানকার মানুষের বুকে সেই কষ্ট এখনও রয়েছে। পাহাড় জ্বলেছে, ১৩ জন প্রান হারিয়েছেন। সেই জ্বালা নিয়েই কিন্তু মানুষ ভোট দেবেন।"
কালিম্পংয়ের সূরজ ছেত্রী বা কার্শিয়ংয়ের সুনীল তামাংয়ের গলায়ও একই সুর। পাহাড়ের অনেকেই সেই পুরানো স্মৃতি আউড়ে যাচ্ছেন। এবারের ভোটে চুপচাপ কোন ফুলে ছাপ পড়বে তার জবাব মিলবে একেবারে ২৩ মে।
দার্জিলিং কেন্দ্রে পাহাড়ের তিন বিধানসভা কেন্দ্রই সাধারণত জয়ের পার্থক্য় গড়ে দেয়। পাহাড়বাসীর একতরফা ভোট জয়ের ব্য়বধান তৈরি করে, সাধারনত এটাই পাহাড়ের নির্বাচনের ইতিহাস। এই ভোটেই হাসি ফোটে বিজয়ী প্রার্থীর। এবারও কি সেই ট্র্য়াডিশন বজায় থাকবে? কালিম্পং, কার্শিয়ং বা দার্জিলিংয়ে কিন্তু এবার সেই চিত্র অধরা। ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে পাহাড়েই।
আরও একটি অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। দার্জিলিং লোকসভা জয়ে এবার সমতলের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেই মত অভিজ্ঞ মহলের। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, বিমলপন্থী মোর্চা, মন ঘিসিং বা হরকাবাহাদুর ছেত্রী, সব মিলিয়ে পাহাড়ের আন্দোলন বহুমুখী হয়ে উঠেছে, যদিও তবে বিজেপিকে যৌথভাবে সমর্থন করেছেন বিমল গুরুং ও মন ঘিসিং। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (গজমুমু) থেকে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছে, হরকাবাহাদুর ছেত্রী নিজেই প্রার্থী হয়েছেন। গোর্খা নেতৃত্বে ভাগাভাগির মত এবার পাহাড়ের ভোটেও সেই থাবা বসবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।