কোথাও শ্মশানের শূন্যতা,সঙ্গে আতঙ্ক। কোথাও বিহ্বল, হতবুদ্ধি অবস্থা। কোথাও আবার কার্যত হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রয়েছেন কয়েকজন নিঃসঙ্গ নেতা। দেশজোড়া গেরুয়া ঝড় এবং বঙ্গে বিজেপি-র অপ্রত্যাশিত উত্থানের দিনে তৃণমূল, বাম এবং কংগ্রেস শিবিরের অবস্থা এমনই।
যে কোনও নির্বাচনের দিনেই সাধারণত লোকে লোকারণ্য থাকে কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির গলি। দুপুর গড়ানোর আগেই উপচে পড়ে ভিড়। সবুজ আবির, নেত্রীর ছবি সম্বলিত জোড়া ফুল আঁকা পতাকা নিয়ে ভিড় জমান সমর্থকেরা। ২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যের মসনদে আসার আগে থেকেই এমনই রেওয়াজ। চেনা এই ছবিটা এ-বছর কার্যত আমূল বদলে গিয়েছে। ফলপ্রকাশের দিন দুপুরে সুনসান মুখ্যমন্ত্রীর পাড়া। ইতিউতি দু-একটি জোড়া ফুল আঁকা পতাকা চোখে পড়েছে ঠিকই। কিন্তু উৎসাহী কর্মী, সমর্থকদের উপস্থিতি প্রায় নেই।
ডায়মন্ড হারবারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে যাওয়ার পর বেলার দিকে একটি ছোট মিছিল আসে ঠিকই, কিন্তু তাতেও হাতে গোনা কয়েকজন সমর্থক। অন্যবারের মতো এ-বারও সবুজ আবিরের পশরা সাজিয়ে বসেছিলেন চেতলার অরিন্দম কাঁড়ার। কিন্তু বিক্রি হয়নি প্রায় কিছুই। অরিন্দম বলেন, "অন্যবার দুপুরের মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যায়। এবার তো কোনও লোকই নেই। কী হবে জানি না!" মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছেই তিরিশ বছর ধরে লস্যির দোকান চালান রামশরণ মিশ্র। তিনি বলেন, "এ-বছর তো প্রায় শ্মশানের অবস্থা! শেষ কবে এই রকম দেখেছি জানি না।"
কালীঘাটের চেয়েও শোচনীয় অবস্থা তপসিয়ার তৃণমূল ভবনের। দুপুর দেড়টা নাগাদ গিয়ে দেখা গেল, কর্মী, সমর্থক তো দূরস্থান, কার্যত কাকপক্ষীও নেই। নিরাপত্তারক্ষীরা কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। তৃণমূল ভবনের সামনের চা-সিগারেটের দোকান চালান মহম্মদ আশরাফুল। তাঁর কথায়, "প্রতিবারই ভোটের ফলপ্রকাশের দিন ভিড় হয়, বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। এবছর একদম উল্টো ছবি। সবাই ভয়ে আছেন, কোন নেতা কবে দল ছেড়ে যাবেন কে জানে!"
তৃণমূল শিবিরে যখন চাপা আতঙ্ক, তখন কার্যত হতবুদ্ধি অবস্থায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। সকাল থেকে নির্বাচনী বিপর্যয়ের খবর আসছিল। এক কর্মীর কথায়, "খারাপ ফল হবে জানাই ছিল, কিন্তু সাত শতাংশ ভোট আমাদের! এ কখনও হতে পারে!" দুপুরে রাজ্য সিপিএমের সদর দফতরে বৈঠকে বসেন বিমান বসু, সুজন চক্রবর্তীরা। আলিমুদ্দিনের সামনে তখন কর্মীর চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেশি। এ জে সি বোস রোডের যে বিখ্যাত পেট্রল পাম্পের গা ঘেঁষে আলিমুদ্দিনে ঢুকতে হয়, সেখানে মুখ চুন করে বসেছিলেন মধ্য কলকাতার প্রবীণ বাম নেতা। কেন এমন হাল? ১৯৬৭ থেকে ভোট করানো ওই নেতার কথায়, "আমরা যে ভোটে জিততে পারি, মানুষ আর সেটা ভাবছেন না। গভীর আত্মসমালোচনা প্রয়োজন।" খানিক বিরতি দিয়ে তিনি বলেন, "হয়তো একদিক দিয়ে ভালই হলো। পুরনো বহু কিছু বাতিল হয়ে গেল, হয়তো নতুন কিছু তৈরির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলো।"
তথৈবচ অবস্থা বিধান ভবনেও। রাজ্য কংগ্রেসের কর্মীহীন সদর দফতরে অমিতাভ চক্রবর্তী, শুভংকর সরকারদের সঙ্গে নিয়ে বসে ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র। সঙ্গে দীর্ঘদিনের সঙ্গী বাদল মজুমদার। সোমেনের আক্ষেপ, "ভোটে জয়-পরাজয় আছেই। কিন্তু রাজ্যটা হিন্দু-মুসলিমে ভাগ হয়ে গেল! এ অনেক দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি। জানি না কবে এই ক্ষতে প্রলেপ পড়বে।"