প্রধানমন্ত্রী পেনশন প্রকল্পে অনীহা শ্রমিকদের মধ্যে

যাঁরা অন্য পেনশন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত, তাঁরা প্রধানমন্ত্রী পেনশন যোজনায় নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন না। চল্লিশ বছরের বেশি বয়সী যাঁরা কর্মরত, তাঁরাও নথিভুক্ত হতে পারবেন না।

যাঁরা অন্য পেনশন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত, তাঁরা প্রধানমন্ত্রী পেনশন যোজনায় নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন না। চল্লিশ বছরের বেশি বয়সী যাঁরা কর্মরত, তাঁরাও নথিভুক্ত হতে পারবেন না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
PM-SYM

ফুলে দেবী (বাঁ দিক থেকে প্রথম) সদ্য কাজ ছেড়েছেন অসুস্থতার জন্য়

চাঁদ লাল, বয়স ৪৫। একটা হতাশা ভরা দিন সেরে ফিরে এলেন দিল্লির রোহিণীর জেজে বস্তির ৮ ফুট বাই আট ফুটের ছোট্ট ঘরে। বস্তির সামনের হ্যান্ড পাম্পের জলে পা ধুতে ধুতে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, "আজ মাত্র ৩০০ টাকা রোজগার হয়েছে।"

Advertisment

মধ্য প্রদেশের ছত্তরপুর জেলা থেকে চলে এসেছেন চাঁদ লাল। ২০০০ সাল থেকে নির্মাণকর্মী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এখনও পর্যন্ত একটি কানাকড়িও জমাতে পারেননি। কোনও কল্যাণমূলক প্রকল্পেই এখনও নাম নেই তাঁর, এবং কেন্দ্রের পেনশন প্রকল্পে নাম তোলার কোনও আকাঙ্ক্ষাও তাঁর নেই আপাতত। উল্লেখ্য, বার্ধক্যে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই প্রকল্প সম্প্রতি শুরু হয়েছে।

১ ফেব্রুয়ারি যে বাজেট পেশ করা হয়েছে , সেখানে প্রধানমন্ত্রী শ্রম যোগী মনধন যোজনার কথা বলা হয়েছে। অংগঠিত ক্ষেত্রের যেসব শ্রমিকদের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা বা তার নিচে, তাঁরা যদি মাসে ন্যূনতম ৫৫ টাকা করে জমা রাখেন, তাহলে এই প্রকল্পের আওতায় তাঁরা ষাট বছর বয়স হওয়ার পর ৩০০০ টাকা করে মাসিক পেনশন পাবেন। সরকার এঁদের জন্য প্রতি মাসে সমপরিমাণ টাকা জমা করবে।

publive-image দুর্দশা নিয়ে তিতিবিরক্ত শ্রমিকরা

Advertisment

সারা দেশে, সরকারি হিসেবে মোট ৪২ কোটি অসংরক্ষিত শ্রমিক রয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর সরকারের প্রত্যাশা, এই প্রকল্পে এপ্রিলের শেষে মোট ১ কোটি শ্রমিক নিজেদের নাম নথিভুক্ত করবেন। আগামী ৫ বছরে মোট ১০ কোটি অসংগঠিত শ্রমিককে এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার।

সারা দেশে যখন ভোট চলছে এবং মোদী যখন এ রাজ্য থেকে সে রাজ্যে নিজের প্রকল্পের কথা বলে প্রচার করছেন, সে সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কাছে স্বেচ্ছাদানের কোনও পেনশনপ্রকল্পই আকর্ষণীয় নয়।

সাড়ে চারজনের পরিবার চাঁদ লালের। ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে তাঁর দৈনন্দিন রোজগার। দুধহীন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ক্লান্ত শোনায় তাঁর গলা। "সরকারি ন্যূনতম রোজগারই প্রতিদিন পাই না, কী করে পেনশনের জন্য টাকা জমাব! একদিন কাজের জন্য আমাদের অন্তত ৫০০ টাকা পাওয়া উচিক, কিন্তু কাজ কম বলে প্রায় সব সময়েই কম টাকায় কাজ করি আমরা। যা আসে তাই নিয়ে কোনও রকমে দিনের খরচা চালাই।"

প্রধানমন্ত্রী পেনশন প্রকল্পে নাম অন্তর্ভুক্তি

দু মাসের বেশি সময় হয়ে গেছে এ প্রকল্প শুরু হয়েছে। দিল্লির মজদুরদের মধ্যে মোদী পেনশন প্রকল্প নিয়ে সাড়া নেই। মধ্য প্রদেশ থেকে আসা বছর চল্লিশেকের সুদেশ দেবী, গত পাঁচ বছর ধরে একটি নামকরা সংস্থায় ২০০০ টাকা বেতনে চাকরি করছেন।

দিনে শেষবারের মত অফিসে ঝাড়ু দিতে দিতে বললেন, "আমি গত পাঁচ বছর ধরে মাসে ২০০০ টাকা মাইনে পাই। কোনও ছুটি নেই। হেল্পারের কাজ করি। সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের ক্ষেত্রেও কি এটাই নিয়ম! এখনই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে পেনশন নিয়ে আমি কী করব!"

৪০ বছরের মীনা কুমারী খুব চেষ্টা করছেন বিধবা পেনশন যোজনার সুবিধা পাওয়ার। আমার স্বামী গত বছর মারা গেছেন। সেই থেকে ডকুমেন্ট নেই বলে আমার আর্জি অনেকবার খারিজ হয়ে গেছে। সরকারি পেনশন প্রকল্পে ভরসা রাখার থেকে অনেক সহজ যদি আমি একটা কাজ পাই। এসব আমাদের মত লেখাপড়া-না-জানা মানুষের জন্য নয়।

২০০৮ সালের অসংগঠিত শ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা আইনের অন্তর্ভুক্ত এই পেনশন প্রকল্প চালু হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী পেনশন যোজনায় নথিভুক্তির কাজ করছে কমন সার্ভিস সেন্টার। রিপোর্ট অনুযায়ী সারা দেশে মোট ৩.১৯ কোটি কমন সার্ভিস সেন্টার রয়েছে।

চাঁদ লালের খুপরি যেখানে, সেই জেজে কলোনির কাছেই উত্তর পশ্চিম দিল্লির মঙ্গলপুরী এলাকায় সিএসসি চালান প্রেম চাঁদ। গত দু বছর ধরে গরিব মানুষদের কাছে ই গভর্ন্যান্স পরিষেবার বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য করে থাকেন।

চাঁদের বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী পেনশন যোজনা নিঃসন্দেহে রিক্সা চালক এবং মেথরদের পক্ষে খুবই কাজে লাগবে। তিনি মনে করেন "এ প্রকল্প নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এখনও এ প্রকল্পে একজনও নাম লেখায়নি। হ্যাঁ, নাম নথিভুক্তকরণের ব্যাপারটা খুবই শ্লথ, আমাদের ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে প্রকল্পের সুবিধার কথা বোঝাতে হবে। জানাতে হবে যে এর ফলে তাঁদের ভবিষ্যৎ কতটা সুরক্ষিত থাকবে। "

দিল্লির অন্য সিএসসি কেন্দ্রগুলি নিষ্ক্রিয়। তাদের মধ্যে কয়েকটি গরিব মানুষদের নথিপত্রের ব্যাপারে সহায়তা করছে।

সুবাস ভাটনগর, সমাজকর্মী তথা নির্মাণকর্মীদের একটি সংস্থার কোঅর্ডিনেটর। তিনি বলেন, "নয়া এই পেনশন প্রকল্প কাঠামোগত কারণেই বাস্তবায়িত হয়ে উঠবে না।"

তিনি বলেন, "কোনও নির্দিষ্ট রোজগার নেই এমন অবস্থায় কেন ও কোনও কর্মী ২৫-৩০ বছর ধরে অর্থ বিনিয়োগ করে চলবেন! তাও সে সময়ে তাঁরা যে পরিমাণ অর্থ পাবেন, তার পরিমাণও হয়ত তখন যথেষ্ট হবে না।"

নির্মাণ কর্মীদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ভাটনগর বলেন, "১৯৬৬ সালের বিওসিডব্লিউ আইন অনুসারে সমস্ত নির্মাণকর্মীদের রেজিস্টার্ড হওয়ার কথা এবং তাঁদের পেনশনও পাওয়ার কথা।"

যাঁরা অন্য পেনশন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত, তাঁরা প্রধানমন্ত্রী পেনশন যোজনায় নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন না। চল্লিশ বছরের বেশি বয়সী যাঁরা কর্মরত, তাঁরাও নথিভুক্ত হতে পারবেন না। এ প্রকল্পের জন্য নথি হিসেবে আধার, ব্যাঙ্কের সেভিংস অ্যাকউন্ট এবং একটি চালু মোবাইল নম্বর লাগবে, যা শ্রমিকদের বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেরই নেই।

বয়স্কদের রোজগার

উত্তর প্রদেশের মোহেন জেলার পরিযায়ী শ্রমিক ফুলে দেবী। কাগজ কুড়ুনির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন হাঁপানির জন্য। পেনশন প্রকল্পে কাজের জন্য তিনি আগ্রহী কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানতে চাইলেন, নিখরচায় চিকিৎসার কোনও প্রকল্প আছে কিনা।

বর্তমান সরকারের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ফুলে দেবী বলেন, "আমার বয়সী শ্রমিকদের জন্য কোনও ব্যবস্থাই নেই। আমি সারাজীবন ময়লা কুড়িয়েছি, থাকি একটা খোলা নালার উপর এক বস্তিতে। এরকম একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, অনেকেই অল্প বয়সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যদি কোনও পেনশন প্রকল্প থেকেই থাকে, তাহলে ৫০ বছর বয়সেই তার সুবিধে আমাদের পাওয়া উচিত।"

ভোটের গিমিক

সারা ভারত অসংগঠিত শ্রমিক কংগ্রেসের চেয়ারম্যান অরবিন্দ সিং বললেন, "পেনশন প্রকল্প তো প্রয়োজনানুসারী নয়। অসংগঠিত শ্রমিকদের আয়ু সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের থেকে কম। আপনি দিল্লির যে কোনও বস্তিতে গিয়ে দেখুন, ১০ শতাংশের বেশি বয়স্ক মানুষ পাবেন না।"

"সংগঠিত শ্রমিকদের জন্য যে কর্মপদ্ধতি, তা অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। যেখানে ক্রমাগত মানুষ জায়গা বদল করছেন, তাঁদের সমস্ত তথ্য ট্র্যাক করার বিষয়ও রয়েছে।"

জেজে বস্তির অনেকেই এ সব প্রকল্পকে নির্বাচনী গিমিক বলে মনে করছেন। মাখন লাল, নির্মাণকর্মী, কাঁধরে হাড় সরে যাওয়ার কারণে কাজ ছাড়ার উপক্রম হয়েছে তাঁর। তিনি বললেন, "মোদীর পেনশন প্রকল্প বা রাহুল গান্ধীর ন্যায় আমি এসব কিছুই শুনিনি। আমি জানি না যে কে জিতবে কিন্তু জানি যে আমরা গরিবই থেকে যাব, খোলা নালার উপরেই আমাদের জীবন কাটবে, বর্ষায় আমাদের ঘর নর্দমার জলে ভেসে যাবে।"

PM Narendra Modi