General Election 2019: পঞ্চম দফায় সোমবার রাজ্যের তিন জেলার সাত কেন্দ্রে ভোট। হুগলির তিন কেন্দ্র- আরামবাগ, হুগলি ও শ্রীরামপুর; হাওড়া জেলায় হাওড়া ও উলুবেরিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ ও ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন।
মনে করা হচ্ছে, ৫ম দফা থেকে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচন ভিন্ন মাত্রা পেতে চলেছে। কারণ, এই দফা থেকেই পুরোদস্তুর কলকাতা লাগোয়া দক্ষিণবঙ্গে ভোট শুরু হচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি এমনিতেই প্রশ্নাতীত। এদিকে আবার বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে নারাজ বিজেপি। ফলে, জোর টক্কর হতে চলেছে সোমবার। শনিবার বিকালেই প্রচার শেষ হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে ভোটকর্মীদের ও নিরাপত্তাবাহিনীর তৎপরতা তুঙ্গে। সব মিলিয়ে ভোট জ্বরে কাবু হাওড়া, হুগলি ও উত্তর ২৪ পরগনা। কিন্তু, কী হতে চলেছে কালকের ভোটে? আসুন জেনে নেওয়া যাক, এই সাত কেন্দ্রের নির্বাচনী সমীকরণ-
লোকসভা নির্বাচনের সব খবর পড়ুন এখানে
ব্যারাকপুর
৫ম দফায় যে আসনগুলিতে ভোট হচ্ছে, সেগুলির মধ্যে আলোচনার শীর্ষে থাকা ও নজর কাড়া কেন্দ্র ব্যারাকপুর। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকায় নাম না থাকায় দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন ভাটপাড়ার প্রাক্তন বিধায়ক তথা একদা তৃণমূলের 'বাহুবলী' নেতা অর্জুন সিং। ব্যারাকপুর কেন্দ্রে এবার বিজেপির প্রার্থী হিসাবে লড়ছেন অর্জুন সিং। অন্যদিকে, এই কেন্দ্রে তৃণমূলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা ব্যারাকপুরের বিদায়ী সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী। রাজনৈতিক মহলের মতে, অর্জুন সিং এবং দীনেশ ত্রিবেদীর লড়াই শুধু দু'জনের বা দুই দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই আসনে জয়-পরাজয়ের উপর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মর্যাদাও জড়িয়ে গিয়েছে। এই কেন্দ্রের পুরসভাগুলিতে অর্জুন সিং-এর একাধিক আত্মীয় ও 'কাছের মানুষ'রা কাউন্সিলর। এছাড়া শোনা যাচ্ছে, নোয়াপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা অর্জুনের আত্মী সুনীল সিং এবং বিজপুরের বিধায়ক তথা মুকুলপুত্র শুভ্রাংশু রায় নাকি পদ্ম শিবিরের দিকে পা বাড়িয়েই রয়েছেন। তবে, তাঁরা কেউই এই সরাসরি এমন খবরের সত্যতা মেনে নেননি। পাশাপাশি, ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্তও বরাবর মুকুল অনুগামী বলেই পরিচিত। ফলে, তৃণমূল থেকেও ভোটের দিন এঁরা কী ভূমিকা নেবেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ চটকলের শ্রমিক সংগঠনই অর্জুন সিং-এর নিয়ন্ত্রণাধীন। তবে, রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল হিসাবে তৃণমূলের দাপটও স্বাভাবিকভাবেই চোখে পড়ার মতো। ফলে, এক কথায় লড়াই এখানে হাড্ডাহাড্ডি। এই কেন্দ্রে কংগ্রেস মোহাম্মদ আলিকে প্রার্থী করেছে। সিপিএম প্রার্থী করেছে গার্গী চট্টোপাধ্যায়কে। সিপিএম প্রার্থী লড়াইয়ের ময়দানে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলেও সেভাবে দেখা যায়নি কংগ্রেসকে। তবে তৃণমূল ও বিজেপি-র লড়াইয়ের মাঝে বাম-কংগ্রেসের তেমন একটা গুরুত্ব নেই বলেই শোনা যাচ্ছে শিল্পাঞ্চলের আনাচে কানাচে।
আরও পড়ুন- ভোট প্রচারে আক্রমণাত্মক মমতা, বিঁধলেন মোদী-মুকুলকে
বনগাঁ
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে এবারের নির্বাচন 'ঠাকুর পরিবার' কেন্দ্রিক। একই পরিবারের দু'জন দুই যুযুধান দলের প্রার্থী। ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ির মমতাবালা ঠাকুর তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ও শান্তনু ঠাকুর বিজেপি প্রার্থী। শনিবার এক পথ দুর্ঘটনায় শান্তনু ঠাকুরের মাথা ফেটে যায়। বিজেপি অভিযোগ করে, এর পিছনে চক্রান্ত রয়েছে। এবারের ভোটে মতুয়া সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক বিভাজনও স্পষ্ট। মতুয়াদের ভোট কুড়োতে এখানে সভা করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই উদ্দেশ্যে এখানে সভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। এই আসনটি আবার রাজ্যের মন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের খাস তালুক। গাইঘাটার বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় এই এলাকাটিকে চেনেন হাতের তালুর মতো এবং এখানে তাঁর সংগঠন ও প্রতিপত্তি প্রশ্নাতীত। ফলে, মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁর নির্বাচনে চিত্তাকর্ষক লড়াই হতে চলেছে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বনগাঁ কেন্দ্রে সৌরভ প্রসাদকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস। সিপিএম এখানে প্রার্থী করেছে অলকেশ দাসকে।
উলুবেড়িয়া
উলুবেড়িয়া কেন্দ্রে এবারও প্রয়াত সুলতান আহমেদের স্ত্রী সাজদা আহমেদকেই প্রার্থী করেছে তৃণমূল। সুলতানের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীকে এই আসন থেকে উপনির্বাচনে প্রার্থী করে সংসদে নিয়ে যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। অন্যদিকে, উলুবেড়িয়ায় এবার বিজেপির প্রতীকে লড়ছেন অভিনেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত উলুবেরিয়া কেন্দ্রে ধর্মীয় মেরুকরণ একটা ফ্যাক্টর হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে শুধু ধর্মীয় মেরুকরণই নয়, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং 'তোষণের রাজনীতি'ও প্রভাব ফেলতে পারে এই কেন্দ্রে। উল্লেখ্য, প্রয়াত সুলতান আহমেদ নারদকাণ্ডে অভিযুক্ত ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, সুলতান আহমেদের মৃত্যুর জন্য বিজেপি দায়ী। এই লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী মাকসুদা খাতুন। অন্যদিকে সোমা রাণিশ্রী রায়কে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস।
আরও পড়ুন- ‘কৃষক, ব্যবসায়ী এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে মোদীর শাসন দুর্বিষহ’
হাওড়া
নারদকাণ্ডে অভিযুক্ত তথা অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবারও হাওড়া কেন্দ্রে প্রার্থী করেছেন তৃণমূল নেত্রী। অন্যদিকে, বিজেপি প্রার্থী করেছে প্রাক্তন সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্তকে। জানা যায়, সংঘ পরিবারের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে রন্তিদেববাবুর।
সম্প্রতি হাওড়ায় আইনজীবী ও পুরোকর্মীদের সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে আইনজীবীদের ওপর। সেই ঘটনার ফায়দা তুলতে মরিয়া পদ্ম শিবির। এছাড়া, হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রে লিলুয়া, বেলুড় উত্তর ও মধ্য হাওড়া-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় অবাঙালি ভোটার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। ফলে, এই কেন্দ্রে হিন্দিভাষী ভোটারদের ভোট নির্ণায়ক ভিমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী সুমিত্র অধিকারী এবং কংগ্রেসের প্রার্থী শুভ্রা ঘোষ। বিগত নির্বাচনেও এখানে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল সিপিএম। আর ২০১৫ উপনির্বাচনে সমানে সমানে টক্কর হয়েছিল তৃণমূল ও সিপিএমের মধ্যে। তবে, এলাকায় ঘুরে স্পষ্ট যে এবার লড়াই ঘাসফুল ও পদ্মফুলের।
শ্রীরামপুর
হুগলির শ্রীরামপুরেও এবার লড়াই হবে জোরদার। রাজনৈতিক মহলের মতে, তৃণমূল প্রার্থী তথা দুঁদে আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবার এই কেন্দ্রে যথেষ্ট চাপে রয়েছেন। কল্যাণের বিপক্ষে রয়েছেন বিজেপি যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি দেবজিত সরকার। 'কু-কথা' এবং 'দুর্বব্যবহারে'র জন্য কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তির বেশ খানিকটা ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছে রাজনীতির কারবারিরা। আর এর সঙ্গে রয়েছে বাংলা জুড়ে বিজেপির হাওয়া। ফলে লড়াই এখানে অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যের। এইবার এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী দেবব্রত বিশ্বাস ও সিপিএম প্রার্থী তীর্থঙ্কর রায়।
আরও পড়ুন- মমতার যাত্রাপথে ‘উল্টোপাল্টা’ কথা বলে আটক তিন, প্রতিবাদে মুখর গেরুয়া শিবির
হুগলি
হুগলি কেন্দ্রে বিদায়ী সাংসদ ডাঃ রত্না দে নাগকেই ফের প্রার্থী করেছে তৃণমূল। বিজেপি প্রার্থী করেছে মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী তথা অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়কে। রাজনৈতিক শিবিরের মতে, এই কেন্দ্রে রত্না দে নাগকে তেমন একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে না। অভিজ্ঞ মহলের মতে, অন্য সাংসদদের তুলনায় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন বা ব্যবহারে রত্নাদেবী অনেকটাই এগিয়ে। তাঁর সাধারণ জীবন যাপন এই ভোটে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। ফলে, লকেট লড়াই করার চেষ্টা করলেও আদতে ইভিএমে কতটা প্রতিফলন পড়বে তা জানতে ২৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। হুগলিতে সিপিএম প্রার্থী প্রদীপ সাহা ও কংগ্রেস প্রার্থী প্রতুল চন্দ্র সাহা।
আরামবাগ
আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রটি তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী করেছে নারদকাণ্ডে অভিযুক্ত তথা বিদায়ী সাংসদ অপরূপা পোদ্দারকে। তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী তপন রায়। অপরূপা নারদায় অভিযুক্ত হলেও বিজেপি নির্বাচনী প্রচারে তেমন একটা লড়াইয়ের ছাপ ফেলতে পারেনি। ফলে, এই কেন্দ্রে পদ্মফুলকে সহজেই মাত করবে ঘাসফুল, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্র এক সময় সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি ছিল ছিল। ১৯৮৪-২০০৪ এই সময় কালে সাংসদ ছিলেন অনিল বসু। সিপিএমের এই সাংসদ ২০০৪ সালে ৫ লক্ষ ৯২ হাজার ৫০২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে ব্যবধানের নিরিখে রেকর্ড করেছিলেন। এখানে এবার সিপিএম প্রার্থী শক্তিমোহন মালিক। তবে এখন সিপিএমের সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। অন্যদিকে, কংগ্রেসের প্রার্থী এখানে জ্যোতি দাস।