তাঁর প্রতিটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে 'চৌকিদার চোর হ্যায়' স্লোগানের ঝড় তোলেন কংগ্রেস সভাপতি। গান্ধী পরিবারে তিনি-ই প্রথম একসঙ্গে দুটি লোকসভা কেন্দ্র (আমেঠি এবং ওয়ানাড়) থেকে প্রার্থী হয়েছেন। শেষ পাঁচ বছরে রাজনৈতিক ভাবে বেশ খানিকটা পরিণত হয়েছেন তিনি, এ কথা স্বীকার করেন সবাই। মোদীর সমালোচনার সুযোগ পেলেই রেয়াদ করেন না এতটুকু। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের পক্ষ থেকে নেওয়া রাহুল গান্ধীর সাক্ষাৎকার তুলে দেওয়া হল বাংলার পাঠকদের জন্য।
চার দফা নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। আপনার প্রতিটা প্রচারে একটাই প্রবণতা দেখা গেল বারবার। একজন মানুষকেই আপনি আক্রমণ করে গেলেন। চৌকিদার, প্রধানমন্ত্রী। আদর্শকে আক্রমণ না করে ব্যক্তিকে আক্রমণ করলেন কেন?
স্পষ্ট করে বলি, মোদী যদি বাজপেয়ীর মতো সরকার চালাত, যেখানে একাধিক ক্ষমতার কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে নানা ইস্যু নিয়ে আক্রমণ করা যায়, একাধিক নেতাকে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু এই সরকারের যা কিছু সমস্যা, সবের জন্য দায়ী মোদী। সরকারে আর কেউ নেই। বিমুদ্রাকরণের সময় উনি আর কারও সঙ্গে আলোচনাও করেননি। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার কারোর সঙ্গে আলোচনা না করে একা সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছেন। ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন সর্বোচ্চ। আর মোদীকে আক্রমণ করা মানেই আর.এস.এস এর আদর্শকে আক্রমণ করা। মোদীর আদর্শই আর.এস.এস-এর আদর্শ।
রাফালে চুক্তি নিয়ে আপনি ৩০০০০ কোটি টাকার অঙ্ক নিয়েই আলোচনা করে গেলেন। কিন্তু চুক্তি তো ৬০০০০ কোটি টাকার।
অনিল আম্বানির সঙ্গে ফরাসি সংস্থার চুক্তি ৩০০০০ কোটি টাকার হয়েছিল। সব নথি রয়েছে। পুরো চুক্তি পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে অনেক। হিন্দুতে প্রকাশিত হওয়া তথ্য বলেই দিচ্ছে যুদ্ধবিমান নিয়ে দরদাম খুব ন্যায়সঙ্গত ভাবে হয়নি।
'চৌকিদার চোর হ্যায়' তো আপনারই স্লোগান...। আপনি ছাড়া সংসদে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে কাউকেই এই স্লোগান দিতে শোনা যায়নি। আপনি একাই কেন এই স্লোগান ব্যবহার করেন? বাকিরা ভয় পান?
এটা মোটেই আমার স্লোগান নয়। ছত্তিসগড়ের এক সভায় আমি বলেছিলাম প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের চাকরি দেননি, চৌকিদার আপনাদের চাকরি দেননি, চৌকিদার ১৫ লক্ষ টাকা দেননি। কিছু তরুণ সেই সভায় ছিল। যেই আমি বললাম, চৌকিদার, অমনি ওরা নিজেরাই বললেন, "চোর হ্যায়''। এটা আমার স্লোগান না, দেশের মানুষই এই স্লোগান দিয়েছেন। আর এখন শুধু আমিই বলিনা, দলের অনেক অভিজ্ঞ নেতাই বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে এই স্লোগান দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন, রোড শো’র মাঝে কেজরিওয়ালকে চড়
২০১৪-এর লোকসভায় মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। এত খারাপ ফল আগে কখনও হয়নি। কিন্তু তারপরের ৫ বছরে কোনও পরিবর্তন এল না? আদর্শের সংঘাত?
শেষ পাঁচ বছরে আদর্শের লড়াইয়ের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে আমাদের। কে বলেছে আপনাকে দলে পরিবর্তন আসেনি? বিজেপির আদর্শের সঙ্গে যুঝতে খুবই পরিকল্পিত ভাবে লড়াই করতে হয়েছে আমাদের। এই নির্বাচনে মোদীকে যদি কেউ হারায়, সেটা কংগ্রেস। মোদী শুধু 'কংগ্রেস মুক্ত ভারত' -এর কথা বলেন। এর পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। একমাত্র কংগ্রেসই পেরেছে মোদী এবং আর.এস.এসকে ভয় দেখাতে। জমি অধিগ্রহণ বিল তুলে নেওয়ার জন্য মরিয়া ছিলেন মোদী। একমাত্র কংগ্রেসের ৪৪ জন সদস্যের জন্য তা সম্ভব হয়নি।
আপনার সমালোচকরা বলেন, আপনার রাজনীতি জীবনে যা কিছু অর্জন করেছেন, সবটাই পরিবারের জন্য।
আপনি বলতে চাইছেন শেষ পাঁচ বছর মোদীর সঙ্গে লড়াই করতে পেরেছি আমার রক্তের জন্য? আমার ক্ষমতা দিয়ে আমায় বিচার করুন। আমি কী করছি, আমার আদর্শ কী, তাই দিয়ে বিচার করুন। আর ভুলে যাবেন না আমি তিনবারের লোকসভার নির্বাচিত প্রার্থী। সেটাকে অবজ্ঞা করবেন না। বিগত পাঁচ বছর কী ভাবে কাজ করলাম, আপনারা দেখেননি?
রাজনৈতিক মহলে একটা কথা আছে। ৫ বছর আগেও সবাই জানত আপনি কংগ্রেস সভাপতি হবেন। কিন্তু আজ থেকে ৫ বছর পর কে বিজেপির সভাপতি হবেন, কেউ জানে না।
সত্যিই তাই কি? একমাত্র নরেন্দ্র মোদীর কথায় উঠবে, বসবে, এমন কেউই কি বিজেপির সভাপতি হবেন না? মোদীর আদেশ ছাড়া অমিত শাহ কিছু করেন না, কিছু না। আমায় কংগ্রেসের মতো একটা বিশাল দলকে আসতে আস্তে একটু একটু করে বদলাতে হয়েছে। সেটা একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, একটা বড় পদ্ধতি। ২০১৪ তে কংগ্রেসের প্রতি মানুষের মোহমুক্তি ঘটেছিল। সেখান থেকে ২০১৯-এ কংগ্রেস যেখানে দাঁড়িয়ে, তা দেখার মতো। এখন কংগ্রেসের সাংগঠনিক জোর এতটাই, যে নরেন্দ্র মোদী, বিজেপি এবং আর.এস.এসকে ধ্বংস করতে পারে দল।
মোদীর প্রতি মানুষের মোহমুক্তি ঘটেছে...
ভাল লাগল, আপনারা এটা স্বীকার করলেন বলে। কিন্তু আপনাদের কতটা আক্রমণ করেছেন মোদী? বিজেপি গুণ্ডাদের কত লাঠি খেয়েছেন আপনারা? ব্যক্তিগত ভাবে আমার বিরুদ্ধেই ১৫ থেকে ২০টা মামলা এনেছে বিজেপির গুণ্ডারা। আমি খুশি, ২০১৪ তে আমরা হেরেছিলাম। ২০১৪-র কংগ্রেসের ভরাডুবি দলকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
দেশপ্রেম কোনও রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি নয়, তাহলে বিজেপি যে দেশপ্রেম এর ইস্যুকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, কংগ্রেস হাত গুটিয়ে বসে কেন?
না, আমরা দেশপ্রেম থেকে সরে আসিনি। কিন্তু এই নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল বেকারত্ব। ভারতের গর্ব ছিল অর্থনীতি। সেই গর্ব চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। এখন মোদীর একটা কৌশল আছে। সমস্যায় পড়লেই উনি মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন, “কংগ্রেসের মিথ্যে বলার অভ্যেস আছে”
২০০৯ এবং ২০১৪-র ইস্তেহার থেকে এবারের ইস্তেহার একটা জায়গায় খুব আলাদা। মুসলমান সম্প্রদায়ের বঞ্চনার কথা ভেবে সাচার কমিটির কথা বললেন না এবার।
আমাদের ধারণা খুব স্পষ্ট। এই দেশ প্রত্যেক নাগরিকের। সমস্ত ধর্মের, জাতের, ভাষাভাষীর দেশ এটা। কাউকে বাদ দিয়ে দেশ গড়তে চাইউ না আমরা। বিজেপি মুক্ত ভারতও চাই না। এসব মূর্খের মত চাওয়ায় আমাদের বিশ্বাস নেই।
আদর্শগত দিক থেকে কংগ্রেস সবসময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে। কিন্তু এখন অনেকেই বলছেন, আপনি বামপন্থার দিকে ঝুঁকছেন।
চরম বামপন্থা, চরম মধ্যপন্থা, চরম দক্ষিণপন্থা কোনও কিছুরই জায়গা নেই এখানে। কংগ্রেস দেশের মানুষের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করে। আর সেইমতো কাজ করার চেষ্টা করে। ১৯৭০ সালে কংগ্রেস ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করেছিল, সেটাকে বামপন্থা বলবেন? আবার ১৯৯০ সালে দেশে উদারনীতিবাদের জন্ম দিল কংগ্রেসই, সেটা কে নিশ্চয়ই দক্ষিণপন্থা বলবেন? কংগ্রেস শুধু মানুষের স্বার্থের কথা ভেবে কাজ করে।
কংগ্রেস সভাপতি কর্পোরেটের নাম ধরে ধরে আক্রমণ করেন।
না। সৎ, পরিশ্রমী এবং আইনি পথে চলা কর্পোরেটদের আমি কখনই আক্রমণ করিনি। অনিল আম্বানি, মেহুল চোক্সি, নীরব মোদী, বিজয় মালিয়াকে আমি এই শ্রেণির কর্পোরেটের মধ্যে ফেলতেই পারছি না। এরা দেশের কিংবদন্তি কর্পোরেটদের নামও খারাপ করেছে। এমন কর্পোরেট আছে, আমি যাদের সর্বত ভাবে সমর্থন করি।
কোন একটা কারণে মানুষ মোদীর চাইতে রাহুল গান্ধীকে এগিয়ে রাখবে?
রাহুল গান্ধী মানুষের কথা শোনেন, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং মানুষকে সত্যিই সাহায্য করতে চায়।
Read the full interview in English