মোদী জমানায় ৪ গুণ বেড়েছে সক্রিয়তা, ED-র স্ক্যানারে ৯৫ শতাংশই বিরোধী নেতা।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে কিছুদিন আগেই এক তদন্তমূলক রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যাতে দেখা গিয়েছে, কংগ্রেস এবং বিজেপি দুই আমলেই গত ১৮ বছরে ২০০-র মতো নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিবিআই। তার মধ্যে ৮০ শতাংশই বিরোধী দলের। ইডি-র ক্ষেত্রেও ফল একই। এখানেও দ্বিতীয় এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১২১ জন প্রখ্যাত নেতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে ইডি। হানা দেওয়া হয়েছে, জেরা করা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে এমন নেতার সংখ্যা অন্তত ১১৫ বিরোধী নেতাকে। ৯৫ শতাংশই বিরোধী দলের সদস্য। ইডি-র কর্মী সংখ্যা সিবিআইয়ের এক তৃতীয়াংশ।
ইউপিএ আমলে দশ বছরে মাত্র ২৬ জন নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল ইডি। যার মধ্যে ১৪ জন (৫৪ শতাংশ) বিরোধী দলের। একনজরে ইউপিএ এবং এনডিএ আমলে ইডি-র তৎপরতা দেখে নিন-
ইউপিএ আমলে ইডি-র স্ক্যানারে দুজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, তিনজন মন্ত্রী, তিন জন সাংসদ ছিলেন। একজনও গ্রেফতার হননি, ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ হয়, দোষী সাব্যস্ত হন তিন জন। উল্টোদিকে, দ্বিতীয় এনডিএ সরকারের আমলে একজন মুখ্যমন্ত্রী, ১৪ জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, ১৯ জন মন্ত্রী, ২৪ জন সাংসদ, ২১ জন বিধায়ক, ১১ জন প্রাক্তন বিধায়ক, ৭ জন প্রাক্তন সাংসদ রয়েছেন ইডি-র স্ক্যানারে। যার মধ্যে ১৯ জন গ্রেফতার হয়েছেন, চার্জশিট পেশ হয়েছে ৩২ জনের বিরুদ্ধে।
বিরোধী দলের মধ্যে কংগ্রেসের নেতা-নেত্রী বেশি (২৪ জন)। তার পরেই রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস (১৯ জন)। বিজেপি এবং শরিক দলের মাত্র ৬ জন। তৃণমূলে থাকাকালীন শুভেন্দু অধিকারী এবং মুকুল রায় ছিলেন ইডি এবং সিবিআইয়ের স্ক্যানারে। সারদা এবং নারদ কাণ্ডে তাঁদের নাম উঠে আসে। কিন্তু ২০২০ সালে বিজেপিতে যোগ দেন শুভেন্দু। তারও অনেক আগেই ২০১৭ সালে বিজেপিতে চলে যান মুকুল। তার পর থেকে কোনও মামলাতেই শুভেন্দু বা মুকুলের বিরুদ্ধে তৎপরতা দেখায়নি কেন্দ্রীয় এজেন্সি। সারদা ও নারদ কাণ্ডে অন্য তৃণমূল নেতা–মন্ত্রীদের গ্রেফতার করা হলেও এঁদের দুজনকে জেরা করতেও ডাকেনি ইডি-সিবিআই। যা নিয়ে বঙ্গ তৃণমূল বারে বারেই নিশানা করেছে বিজেপিতে।
সম্প্রতি সামনে এসেছে আরও এক চমকে দেওয়ার মত তথ্য। ২০১৪ সাল থেকে মোদী জমানায় দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত ২৫ জন বিরোধী নেতা বিজেপিতে যোগ দেন। তাদের মধ্যে ২৩ জনই তাদের বিরুদ্ধে উঠা দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পান।
এক্সপ্রেস তদন্তে দেখা গিয়েছে ২০১৪ সাল থেকে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির তদন্তের সম্মুখীন হয়ে ২৫ জন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বিজেপিতে পাড়ি জমান৷ তাদের মধ্যে ২৩ জনই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। তালিকায় ১০ জন কংগ্রেসের থেকে বিজেপিতে যোগ দেন। এনসিপি এবং শিবসেনা থেকে চার জন নেতা। টিএমসি থেকে তিন জন। TDP থেকে দুজন; এবং SP এবং YSRCP থেকে একজন করে।
একদিকে ইডি-সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের টার্গেট করার বিরুদ্ধে বিরোধীদের ক্ষোভ অন্যদিকে কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি নিয়ে জার্মানি-আমেরিকার পর এবার রাষ্ট্রসংঘ-এর মন্তব্য। এরই মাঝে এনডিএ-তে যোগ দেওয়ার ৮ মাসের ব্যবধানে প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে এবার বন্ধ হয়েছে সিবিআই তদন্ত।
গত বছরের জুনে, প্রফুল প্যাটেল এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পাওয়ারের সঙ্গে পাটনায় একটি বিরোধী জোটের বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। এর ঠিক এক মাস পরে তিনি আরও ছয় এনসিপি নেতার সঙ্গে অজিত পাওয়ার দলে যোগ দেন এবং এনডিএ-র অংশ হন। অজিত পাওয়ার নিজেই মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী। বিরোধীরা তখন অভিযোগ করেছিল যে সিবিআই তদন্তের ভয়ে প্রফুল্ল প্যাটেল এনডিএ-তে যোগ দিয়েছেন।
কংগ্রেস আমলে অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রকের দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। ২০১৭ সালের মে মাসে, সিবিআই প্যাটেলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে দুটি মামলা দায়ের করেছিল। অভিযোগ ছিল টাকা’র বিনিময়ে বেসরকারি বিমান সংস্থার হাতে এয়ার ইণ্ডিয়ার লাভ জনক রুট তুলে দেন তিনি। পাশাপাশি বিমান কেনার ক্ষেত্রেও বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এরপর ইডিও এই মামলার তদন্ত শুরু করে।
তবে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রফুল্ল প্যাটেলকে বিরাট স্বস্তি দিয়েছে সিবিআই। দিল্লির রাউজ অ্যাভিনিউ আদালতে সিবিআই একটি ক্লোজার রিপোর্ট দাখিল করে জানিয়েছেন এই মামলায় তারা প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে কোন সুর্নিদিষ্ট প্রমাণ পান নি। তবে সিবিআই ক্লিনচিট দিলেও প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে এখনও তদন্ত করছে ইডি।
তবে প্রফুল্ল প্যাটেল একা নন। মহারাষ্ট্রের ১২ জন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এই ২৫ জনের তালিকায় রয়েছেন। যাদের মধ্যে ১১ জন ২০২২ সালে বা তার পরে বিজেপিতে যোগ দেন। যার মধ্যে এনসিপি, শিবসেনা এবং কংগ্রেসের চারজন রয়েছেন। তালিকায় রয়েছেন শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ারও। ২০১৯ সাল থেকে নারদ স্টিং অপারেশন মামলায় বাংলার বিরোধীদল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের মামলা আপাতত ঠাণ্ডাঘরে চলে গিয়েছে। সে সময় তিনি তৃণমূল সরকারে থাকলেও ২০২০ সালে টিএমসি থেকে বিজেপিতে যোগ দেন শুভেন্দু অধিকারী।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এবং মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চৌহ্বানের বিরুদ্ধেও মামলাগুলি আটকে আছে। সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি মামলায় ২০১৪ সালে হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। কিন্তু ২০১৫ সালে শর্মা বিজেপিতে যোগদানের পর থেকে তার বিরুদ্ধে সিবিআই অভিযান থমকে যায়। আদর্শ হাউজিং মামলায় সিবিআই এবং ইডির কার্যক্রমের উপর সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও অশোক চৌহ্বান চলতি বছর বিজেপিতে যোগ দেন।
পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং-এর ছেলে রনিন্দর সিং-ও ২০২০ সালে ইডির জেরার মুখে পড়েন। ২০২১ সালের নভেম্বরে বাবা অমরিন্দর কংগ্রেস ছাড়েন। ২০২২-এর সেপ্টেম্বর অমরিন্দর বিজেপিতে যোগ দেন। তারপর থেকে সেই মামলার তদন্ত আপাতত হিমঘরে।
এসপি-এর সঞ্জয় শেঠের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের জুনে আয়কর বিভাগ তার কোম্পানিতে অভিযান চালায়। ২০১৯-এর অগাস্টে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারি বিজেপি তাঁকে রাজ্যসভার জন্য উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রার্থী করে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
কলকাতার প্রাক্তন মেয়র এবং বর্ষীয়ান টিএমসি নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়। নারদ স্টিং অপারেশন মামলার এক প্রধান অভিযুক্ত এবং সারদা চিটফান্ড মামলায়ও কেন্দ্রীয় সংস্থা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এপ্রিল ২০১৭-তে CBI নারদা স্টিং মামলায় FIR দায়ের করে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে কলকাতার মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। ২০১৯-এর অগাস্টে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন।
মার্চ ২০২১ বিজেপি ছাড়েন তিনি। মে মাসেই সিবিআই তাকে গ্রেফতার করে।
১০০-কোটির বেশি দুর্নীতির অভিযোগে ইডি ২০১৬-এর মার্চ-এ মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মন্ত্রী, ছগন ভুজবলকে গ্রেফতার করে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ইডি চার্জশিট ফাইল করে। ২০১৮ সালের মে মাসে দু বছর জেলে থাকার পর জামিন পান তিনি। ২০২৩-এর জুলাইয়ে অজিত পাওয়ারের সঙ্গে এনডিএতে যোগদান করেন তিনি। ২০২৩-এর নভেম্বরে বিশেষ আদালত বলেছে তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে "শামুকের গতিতে"।
পুরনিয়োগ দুর্নীতিতে আর্থিক তছরুপের মামলায় প্রাক্তন তৃণমূল নেতা তাপস রায়ের বিরুদ্ধে চলা মামলা থেকে এখন তিনিই বিজেপির উত্তর কলকাতার প্রার্থী। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে তাপস রায়ের বাড়িতে ইডি অভিযান চালায়। চলতি বছর মার্চেই বিজেপিতে যোগদান করেন তিনি।
এছাড়াও তালিকায় রয়েছে কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া অর্চনা পাতিল। ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মধু কোডার স্ত্রী গীতা কোডা। কংগ্রেস থেকে এনডিএতে যোগ দেওয়া বাবা সিদ্দিকী। জ্যোতি মির্ধা ২০২৩ সালে কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দেন।দলবদলের তালিকায় রয়েছেন টিডিপির সুজানা চৌধুরী। ২০১৯ সালে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। YSRCP থেকে ২০২৩ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন কে গীতা। পাশাপাশি কংগ্রেসের দিগম্বর কামাত ২০২২ সালে কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দেন।