ক্ষেত জুড়ে জমি চাষের কাজ চলছে। যে সিঙ্গুরের পথ ধরে তৃণমূলীয় উত্থান, সেই পথে গাড়ি এগোতেই যেন ঠিক দশ বছর আগে ফিরে যাওয়া। নির্বাচনী উত্থান-পতনের লড়াইয়ের আরেক নাম ছিল এই এলাকা। একুশের নির্বাচনে এই কেন্দ্র হাইভোল্টেজ না হলেও, নির্বাচনী ইতিহাসের পাতায় 'হেভিওয়েট' তো বটেই। স্থানীয় এক ব্যক্তিকে (পূর্ব পরিচিত) জিজ্ঞেস করা হল- নন্দীগ্রামের খবর দেখেছেন? উত্তর এল- ভীষণ লড়াই চলছে তো সেখানে। ভাগ্যিস দিদি আর শুভেন্দু নন্দীগ্রাম থেকে লড়াই করেছেন। তাই এখন সিঙ্গুরে কোনও হিংসার ঘটনা ঘটেনি।
বিকাশ রাই, একজন সিঙ্গুরবাসী। টাটারা যখন কারখানার জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল সেই জমিতে চাষ করতেন তিনি। নিজের জমি ছিল না। তবে অন্যের জমিতে দিনে ৩৫০টাকা মজুরির বিনিময়ে কাজ করতেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইয়ের সাক্ষী ছিলেন তিনিও। একুশের ভোটে কাকে দেখতে চান ক্ষমতায়? সরাসরি সে প্রশ্ন রাখতেই তিনি বলেন, " আমি দিদির সেই লড়াই বুঝি। কৃষকদের জমি অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আমি দিদিকে সমর্থন করেছিলাম। কিন্তু এখন যখন ছেলেমেয়েরা যখন জিজ্ঞেস করে চাকরির কথা, চুপ থাকতে হয়। আমার কাছে কোনও উত্তর নেই। এখন মনে হয় শিল্প হলে অন্তত ছেলেমেয়েরা চাকরি তো পেত।"
ভোটের এই উত্তপ্ত বাজারে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে জবাব দেন বিকাশ। গলায় লুকোনো থাকে ক্ষোভ, হতাশা। ১০ এপ্রিল রাজ্যের চতুর্থ দফার ভোট। সেদিন সিঙ্গুরেও ভোট। কিন্তু ফের যেন 'পরিবর্তন' চাইছে সিঙ্গুরবাসী। সবুজের মাঝে গেরুয়া হাওয়ার খানিক গন্ধ যেন মিশে রয়েছে এই বিধানসভা কেন্দ্রে। কিন্তু কেন? সে প্রশ্ন উঠতেই অপর স্থানীয় স্বপন রাই বলেন, "কেউ বলতে পারবে না দিদি কাজ করেননি। গরীবদের নিয়ে অনেক ভেবেছেন। লকডাউনে তিনি আমাদের চাল দিয়েছিলেন, দু'বেলা খেতে পেরেছিলাম। কিন্তু তাঁর লোকেরা সব কিছুর জন্য আমাদের থেকে টাকা নেয়। তাই দিদিকে পছন্দ করি। কিন্তু চাইছি বিজেপিকেই। একটু বিভ্রান্তিতে রয়েছি।"
দ্বিধা চিত্তে থাকার কারণ অবশ্য পরিস্কার করলেন বিকাশ। তিনি বলেন, "বিজেপি এসেও যে কি ভাল করবে কে জানে! তাঁরা কি গরীবের কথা ভাবে? পেট্রোল, ডিজেল, এলপিজি গ্যাসের দাম দেখুন। কেউ ভাল নয়। সব খারাপ।" সিঙ্গুরের প্রান্তে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন বিজেপি কর্মী এবং নির্বাচিত পঞ্চায়েতের সদস্য সমীর হালদার। বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভের কথা জিজ্ঞেস করতেই মাথা নেড়ে বললেন, "এটা সত্যি যে বাড়ি বাড়ি যখন যাচ্ছি এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু মানুষ কর্মসংস্থান, দুর্নীতি এবং তোলাবাজি অনেক বেশি ক্ষুদ্ধ। তাঁরা চায় পরিবর্তন আসুক আবার।"
ভোট পরিসংখ্যানের প্রসঙ্গও আনলেন সমীরবাবু। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে তৃণমূল বিপুল ভোটে জিতেছিল এখান থেকে। কিন্তু ২০১৯ সালে লকেট চট্টোপাধ্যায় ১১ হাজার ভোটের ব্যবধান রেখেছিলেন এই কেন্দ্রে। ২০২১-এ সেই ট্রেন্ড ধরে রাখতে চাইছি আমরা। একুশের নির্বাচনে সিঙ্গুর গুরুত্বপূর্ণ কারণ তৃণমূলের চারবারের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মাস্টারমশাই এবার তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে টিকিট পেয়ে এই কেন্দ্রেই লড়াই করছেন। বিরুদ্ধে রয়েছেন তৃণমূলের বেচারাম মান্না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজেপি নেতা স্বীকার করেছেন যে প্রার্থী নিয়ে বিজেপির মধ্যে সমস্যায় রয়েছে। যদিও তিনি বলেন, "মানুষ এখনও পরিবর্তন চায় এবং তাই আমরা জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। তবে তা কাজে লাগবে। মাস্টারমশাইএকজন ভাল, সৎ লোক এবং সকলে তাঁকে শ্রদ্ধা করে। আর বেচারাম মান্না হলেন অনেকটা নন্দীগ্রামে যেমন শুভেন্দু তেমন। তিনি গ্রামের সব চিনলেও দুর্নীতি-সহিংসতায় ভরা। এবার এখানে সৃজনও বামেদের হয়ে লড়াই করছে। ও অনেক শিক্ষিত ছেলে। প্রত্যেকেই আলাদা।"
যদিও সিঙ্গুরের হাওয়ায় এবারে বেশ কিছুটা মিশেছে গেরুয়া হাওয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই এখনও সিঙ্গুরের মাটিতে বর্তমান। দিদির প্রতি ভালবাসা থাকলেও কিছুটা ক্ষোভও রয়েছে, অভিমান নয় কিন্তু। লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই পদ্মের সুবাসে মোহিত হয়েছে সিঙ্গুরের একাংশ। তবু দ্বিধা চিত্ত সিঙ্গুর! কোন পথে আগামীর দিকে হাঁটবে এই কেন্দ্র, তা এবার ঠিক করবে সিঙ্গুরবাসীরাই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন