মাতলা নদীর উপর তখন মেঘ ঘনিয়েছে বটে, কিন্তু গরমে পুড়তে পুড়তে রশিদা আমিন তাতে স্বস্তি পাচ্ছেন না। তাঁর চিন্তা এবারের কালবৈশাখিতে তাঁর ঘরটা বাঁচবে কি না তা নিয়ে। আমিনের আশঙ্কা বৃষ্টি হলে নদী ফেঁপে উঠে ঘরে জল ঢুকবে, কিংবা তার চেয়েও খারাপ, ফের ভাসিয়েই নিয়ে যাবে ঘরটাকে।
২০০৯ সালে আয়লা ঝড়ের পর থেকে এ ক বছরে মোট ৬ বার তিনি ঘরহারা হয়েছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী ব্লকের রাধাবল্লভপুর গ্রামে তাঁর নিবাস।
তিনি বলছিলেন, “আয়লার সময়ে আমরা সব হারিয়েছিলাম। আমাদের চলে যেতে হয়েছিল যেখান থেকে আমরা চলে এসেছিলাম সেই দ্বীপে।”
আমিন এবং তাঁর পরিবার মূল ভূখণ্ডের আরেকটু কাছে চলে এসেছেন এখন। জায়গাটা সুন্দরবনের জঙ্গল এলাকার বাইরে। তাঁর আশা ছিল, এখানে তাঁরা একটু নিরাপদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। গত ৮ বছরে নদী এখানে খুব একটা সদয় ছিল না।
বাড়ির সামনের জড়ো করা বস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে দুই সন্তানের মা বললেন, “প্রতি বর্ষায় আমার ঘরে জল ঢুকে যায়। এখানে কোনও ঠিকমত বাঁধ নেই। সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে কি ঘর বা গ্রাম বাঁচানো যাবে?”
চন্দ্রকোণা গ্রাম আর রাধাবল্লভপুর পাশাপাশি। এখানকার মানুষ চান প্রতি বর্ষায় যে তাঁদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে না এ বিষয় নিশ্চিত করুক কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, দুটি গাঁয়ের মোট জনসংখ্যা ৪৮০০। তাঁদের অভিযোগ বাঁধ নিয়ে তাঁদের দাবিতে প্রায় কেউ কানই দেয় না। জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই এলাকায় ভোট হবে ১৯ মে। বাঁধ নিয়ে তাঁদের দাবি কোনও প্রার্থীর প্রতিশ্রুতির তালিকাতেও নেই বলে জানালেন তাঁরা।

সোনাখালি সেতুর পাশে এই গ্রাম। এ সেতু খুলেছিল ২০১১ সালে, সিপিএম সরকারের আমলে। সুন্দরবনের দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে যোগযোগের লাইফলাইন এই সেতু। সেতু, রাস্তা এবং বাড়িঘর দেখে মনে হয় এলাকায় উন্নয়ন পৌঁছেছে, কিন্তু গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রার উন্নতি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে নদী গতিপথ পাল্টাচ্ছে, তীরবর্তী মানুষের জীবনে তার ছাপ পড়ছে নিয়ত।
আমিনের ৭৩ বছর বয়সী শাশুড়ি নুসরত। তিনি বললেন, “পার্টির লোকেরা আসে, ভোট চায়, আমরা বলি আমাদের বাড়ি দরকার, অন্তত একটা ঠিকঠাক বাঁধ বানিয়ে দাও, যাতে আমরা যেখানে থাকি, সেখানেই থাকতে পারি। ওরা বলে ক্ষমতায় এলে দেখবে, কিন্তু কিছুই হয় না।”
জয়নগর আসন এখন তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। এখানকার বর্তমান সাংসদের আশা, আসন তাঁর দখলেই থাকবে। ২০১৪ সালের ভোটে প্রতিমা মণ্ডল আরএসপি-র সুভাষ নস্করকে ৪ লাখ ভোটে হারিয়েছিলেন। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই বললেন, তাঁরা এবার বিজেপির ডক্টর অশোক কাণ্ডারীকে ভোট দেবেন।
স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের মতে বাঁধ এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। দলের এক কর্মী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বললেন, “আমরা নিজেরাও এখানে থাকি। গ্রামবাসী হিসেবে আমরাও সমস্যার মুখে পড়ি। কিন্তু প্রতিবার যদি বাঁধ ভেঙে যায় আর বাড়ি ভেসে যায়, তাহলে আমরা কী করে প্রত্যেকবার টাকা দেব! আমরা ওদের এখান থেকে চলে যেতে বলি কিন্তু ওরা কথা শোনে না।”
৯ বছরের রেশমা খাতুন নদীর বুক থেকে মুখ তুলে থাকা কালো রঙের গাছের কাটা গুঁড়ি দেখিয়ে বলল, ওইখানে এক সময়ে বাঁধ ছিল।
ক্লাস ফোরের এই ছাত্রীর অভিযোগ, “আমরা স্কুল যেতে পারি না, পড়াশোনা করতে পারিনা, জোরে বৃষ্টি এলে মা রান্না করতে পারে না, জল বেড়ে আমাদের রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে।”
গ্রামবাসীরা বলছিলেন, খাঁড়ি থেকে নোনা জল গ্রামে ঢুকে মিষ্টি জলের পুকুর থেকে শুরু করে চাষের খেত অবধি নষ্ট করে দেয়।
১৯ বছরের নাসিমা খাতুন বলছিলেন, “একটা ঠিকমত বাঁধ তৈরি হলে গ্রামে আমাদের জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যেত। নোনা জল আমাদের জীবন কতটা নষ্ট করে দিচ্ছে সে কথা কেউ বোঝে না।”

তাঁর কথায়, “আমাদের মাটির বাড়ি। বান এলে খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। আমরা পুকুররে জল ব্যবহার করতে পারি না। ট্যাপ থেকে জল আনতে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা যেতে হয় আমাদের।”
নাসিমা এবার প্রথম ভোট দেবেন। তবে নার্সিংয়ের এই ছাত্রীর সে নিয়ে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। “পার্টির নেতারা আমাদের কথা শোনে? আমাদের বাড়ি যখন ভেসে যায়, তখন, ভোটের পর কোনও নেতাকে আমি আমাদের গ্রামে আসতে দেখিনি।” তাঁর গলায় রাগ স্পষ্ট।
এলাকার বাসিন্দারা বলছিলেন তৃণমূল ক্ষমতায় এসেই গ্রামে রাস্তা বানিয়েছিল। খুশি হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু তার পর থেকে এলাকায় আর কোনও উন্নয়ন হয়নি। নিকটতম কলে সুন্দরবনের পাঠানখালিতে, এ দুটি গ্রামের থেকে যার দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার। বদ্বীপ এলাকার বাসিন্দা যেসব ছাত্র ছাত্রী, তাঁদের দূরত্ব আরও বেশি। শুধু তাই নয়, কলেজ পৌঁছতে গেলে জল ও সড়কপথে বেশ কয়েকবার যানবাহন বদলাতে হয় তাঁদের।
চন্দ্রকোণা গ্রামের সন্ধ্যা সরকার বললেন, “দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) আমাদের মেয়েদের সাইকেল দিয়েছেন একথা সত্য়ি কিন্তু ছোট বাচ্চাদের প্রতিদিন এক ঘণ্টা হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। কাছাকাছি কোনও কলেজ নেই, অনেককেই মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়, কারণ প্রতিদিন এত রাস্তা যাতায়াত করা সম্ভব নয়। এর চেয়েও খারাপ ওখানে হোস্টেলে থাকার সুযোগও পাওয়া যায় না।”
Read the Story in English