পাঁচ বছর আগেও সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়ির জানালা-দরজা বন্ধ করে দিতে হতো। বাড়ির বাইরে গ্রামের রাস্তায় বেরোনোর সাহস করতেন না কেউ। প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটত গ্রামবাসীদের। এখন বলরামপুরের ঘাটবেড়া গ্রাম বিজেপি-তৃণমূলের লড়াইয়ে জমজমাট। অযোধ্যা পাহাড়ের কোলের এই গ্রামে একসময় তিনজন খুন হয়েছিলেন। এখন আর নতুন করে কেউ "অশান্তি" চান না।
২০০৭ সালে সিপিএম নেতা সুফল মান্ডিকে ঘাটবেড়া গ্রামের উপরপাড়ায় খুন করা হয়, যার ফলে তটস্থ হয়ে পড়েন স্থানীয় মানুষ। বাম আমলেই মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি হয়ে ওঠে এই গ্রাম। ২০১৩-য় খুন হন তৃণমূল নেতা জিতু সিং। এরই মধ্যে তপন দাসকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। ঘাটবেড়ার বাসিন্দারা জানান, মাওবাদীদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলেই খুন হয়েছিলেন তপন। গ্রামবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক চেপে বসে। এরপর যৌথবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যান বাবলু সিং। তাঁর দাদা মাওবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত শম্ভু সিং সর্দার এখন রাজ্য সরকারের হোমগার্ডের কাজে যুক্ত।
এখন কেমন আছে ঘাটবেড়া? লোকসভা নির্বাচনের আগের দিন শনিবার ওই গ্রামে পৌঁছে দেখা যায়, রবিবারের ভোট নিয়ে টানটান উত্তেজনা। লড়াই তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। শম্ভু সিং সরদারের ভাই সনাতনের সঙ্গে দেখা। অলস দুপুরের গরমে বাড়ির বেড়ার কাছে ঘোরাঘুরি করছিলেন। বাড়িটা একেবারে গ্রামের শেষপ্রান্তে। বাড়ি পিছনেই পাহাড়ের কোলের ঘন জঙ্গল।
কী বলছেন সনাতন? গ্রামের পাশের ইঁট ভাটায় কাজ করেন। প্রশ্নের জবাব দিলেও একটা চাপা ভাব। কোথায় আছেন দাদা এখন? সনাতন বলেন, "দাদা পরিবার নিয়ে পুরুলিয়ায় থাকে। বাড়িতে খুব একটা আসে না। তবে ফোনে নিয়মিত কথা হয়।" কী করেন? "তিন বছর আগে রাজ্য সরকার হোমগার্ডের চাকরি দিয়েছে দাদাকে। কালই ফোন করেছিলাম। বলল ভোটের কাজে ব্যস্ত আছে।" গ্রামে এখন কোনও অশান্তি নেই, জানান সনাতন, তবে গ্রামের রাজনীতি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চান নি তিনি।
গ্রামে পাঁচমেশালি দোকান চালান সুধাকর মন্ডল। কী অবস্থা এখন? তিনি বলেন, "না আতঙ্ক আর গ্রাস করে না। সন্ধ্যাবেলা দোকান বন্ধ করতে হয় না। পাড়ার রাস্তায় আড্ডা চলে। গুড়ুম গুড়ুম গুলির আওয়াজ নেই। অচেনা মানুষের আনাগোনাও নেই বললেই চলে।" তাঁর আকুতি, সেই আঁতকে ওঠার দিনগুলো যেন আর না ফেরে। কী পরিস্থিতি এখানে ভোটের? "প্রচার তো জোরদার চলছে। কিন্তু জানেন, এই বুথে তৃণমূল বিজেপির কাছে হেরে গিয়েছে।"
নির্বাচনের প্রথম দফা থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত প্রতিটি বুথেই যৌথ বাহিনীর দাবি জানিয়ে আসছে গেরুয়া শিবির। কিন্তু পুরুলিয়ার ঘাটবেড়ায় উলট পুরান। তৃণমূল কর্মী সুধাকরেরও ভরসা আধাসেনার ওপর। "এই বুথে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে যৌথবাহিনী। তাই বিজেপি ঝামেলা করতে পারবে না। ভোট তো সকলকে দিতে হবে। ওদের এখানে শক্তি বেশি," নিজেই বললেন সুধাকর। বুথে আধাসেনা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, যৌথবাহিনী বিজেপিকে নানাভাবে নির্বাচনে সাহায্য করছে। তবে বুথে বেশি সংখ্যায় যৌথ বাহিনী চান ওই সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর কথায় সায় দেন প্রভাকর মন্ডল। বলরামপুর বিধানসভার এই বুথে ভোটার রয়েছেন ১,২০০-র ওপর।
গ্রামের রাস্তায় দেখা হয়ে গেল অর্জুন মান্ডির সঙ্গে। সুফল মান্ডির ছেলে অর্জুন। বর্তমানে ঘাটবেড়ার পঞ্চায়েত সদস্য। গ্রামের বিজেপি নেতা। তাঁকে মানছেন গ্রামের বড়রাও। শনিবারের কাঠফাটা রোদ্দুরে ভোটের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আমাদের দেখে অর্জুন প্রথমে ভেবেছিলেন নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি। ভোটারদের দাঁড়ানোর লাইনের ওপরে আরেকটু বড় ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া যায় না? প্রশ্ন করার এক মুহুর্ত পরেই ভুল ভাঙে তাঁর। বাবা তো সিপিএম নেতা ছিলেন...মুখের প্রশ্ন কেড়ে নিয়ে হাসতে হাসতেই বললেন, "তাতে কি হয়েছে? বিজেপিই পারে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। বাংলায় বিজেপি চাই। এই বুথে আমরাই এগিয়ে।" আপনার বাবা সহ তিনজন খুন হয়েছেন এই গ্রামে। এখন কী হাল? অর্জুন বলেন, "এখন কোনও অশান্তি নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। রয়েছে স্রেফ রাজনৈতিক লড়াই।"
পুরুলিয়া লেকসভা আসনে এবার তৃণমূল প্রার্থী ডাঃ মৃগাঙ্ক মাহাতো এবং বিজেপি প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো-র মধ্যে জোরদার লড়াই। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই দুই লড়াইয়ের মাঝে কিন্তু ভোটের যথেষ্ট সম্মানজনক ভাগ পাবেন কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতো। তাছাড়াও ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী কতটা ভোট কাটেন সেটাও দেখার।