নির্বাচন নিয়ে কোনও উত্তাপ নেই টোটোপাড়ায়। ছবি- পার্থ পাল
দুবছর আগে লোকসভা নির্বাচনের সময় দেখা গিয়েছিল টোটোপাড়া যাওয়ার রাস্তার বেহাল দশা। এখনও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা এবড়ো-খেবড়োই আছে। তারওপর বেশ কয়েকটি পাথুরে নদী পার হয়ে পৌঁছাতে হয় ভুটানের কোলের এই জনপদে। টোটো জনজাতির প্রথম স্নাতকোত্তর ধনঞ্জয় টোটো চাকরির প্রত্যাশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। বিশ্বের টোটো উপজাতির একমাত্র বসবাস আলিপুরদুয়ারের এই টোটোপাড়ায়।
Advertisment
ছবি : পার্থ পাল
এখন টোটোদের জনসংখ্যা ১,৬১৬ জন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বলতে একটি সরকারি বাস প্রতিদিন টোটোপাড়া থেকে আলিপুরদুয়ার পর্যন্ত যাতায়াত করে। তবে বর্ষায় কী হাল হবে তা বলা যায় না, জানান ধনীরাম টোটো। তিনি বলেন, "অন্য কোনও ভাষা জানে না, শুধু টোটো ভাষায় ১০-১২জন কথা বলেন এই গ্রামে। আমি টোটো ভাষার হরফ তৈরি করে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছি।"
Advertisment
২০১৬ সালে লাইব্রেরি সায়েন্সে এমএ করেছেন ধনঞ্জয় টোটো। তারপর থেকে চাকরির চেষ্টা করে চলেছেন। শিঁকে ছেড়েনি। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে চাকরির আবেদন করেছেন। দেখা করেছিলেন রাজ্যের গ্রন্থাগারমন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর সঙ্গেও। প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে এখন সুপারীর ব্যবসা করছেন পঞ্চাযেত গাঁওয়ের ধনঞ্জয়। তিনি বলেন, "টোটোদের মধ্যে আমি প্রথম এমএ পাশ করেছি। বহু চেষ্টা করেও চাকরি পাইনি। এসএসসি বন্ধ রয়েছে। কী যে হবে।" বিশেষ ক্যাটেগরিতে শিক্ষিত টোটোদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ধনঞ্জয়। তাঁর মতে, তাহলে পরবর্তী টোটোপ্রজন্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও মনোযোগী হবে। টোটোদের মধ্যে ১৫ জন গ্রাজুয়েট হয়েছেন। প্রথম মাধ্যমিক পাশ চিত্তরঞ্জন টোটোর নামে এখানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হয়েছে।
ধনঞ্জয় টোটো ছবি : পার্থ পাল
নির্বাচন নিয়ে এখানে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। তৃণমূল-বিজেপির দু-একটা দলীয় পতাকা উড়লেও সেভাবে প্রচারও নেই টোটোপোড়ার কোনও গ্রামে। টোটপাড়া-বল্লালগুড়ির তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য পিলপিলি টোটো উন্নয়নের কথা বললেও বলতে ভুললেন না অসুবিধার কথাও। ভোটের কথা জানতে চাইলেও প্রায় সকলেই নিরুত্তর। রাজ্যের নানা প্রান্তে ভোটকে কেন্দ্র করে হিংসা, অশান্তি চলছে। আক্রান্ত হচ্ছেন খোদ প্রার্থী। তবে একযোগে টোটোপাড়ার সকলেই জানিয়ে দিলেন ভোটকে কেন্দ্র করে কখনও অশান্তি হয় না। যে যার ভোট দেয় কোনও বাধা ছাড়াই।
এখানকার পঞ্চায়েত সদস্য পিলপিলি টোটো। তাঁর দুই সন্তানই আবাসিক থেকে বাইরে পড়াশুনা করে। পিলপিলি বলেন, "মাধ্যমিকের পর বাইরের স্কুলে যেতেই হবে। তারপর গ্রাম থেকে যাতায়াতের বিরাট সমস্যা। বর্ষার সময় একদিন-দুদিন যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। তাই দুই ছেলে-মেয়েকে বাইরে হস্টেলে রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছি।" পঞ্চায়েত সদস্যার দাবি, "গ্রামে প্রায় ১৫০টি সরকারি আবাস যোজনার বাড়ি হয়েছে। টোটোপাড়ায় ১৯৭২-এ প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯৭৯-তে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এখন দুটো প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হয়েছে টোটোপাড়ায়।
ছবি : পার্থ পাল
কাজের সন্ধানে আগে টোটো যুবকরা ভুটানে যেতেন। ভগীরথ টোটো বলেন, "এখানকার প্রায় দুশো যুবক বাইরে কাজ করতে যান। করোনা আবহে ভুটানে যাওয়া বন্ধ রয়েছে। তবে যুবকরা সিকিম, কেরল, ব্যাঙ্গালুরু যাচ্ছেন পেটের তাগিদে।" এই গ্রামে ২৫-৩০ জন স্থায়ী বা অস্থায়ী সরকারি চাকরি করেন।
ধনীরাম টোটো জানান, "১৯০১-তে টোটোদের জনসংখ্যা ছিল ১৭২। ২০২১ -এ ১৬১৬ জন।" এঁদের নিজেদের পৃথক ভাষা রয়েছে। ধনীরামবাবুর কথায়, বাংলাদেশে যদি পদ্মা-সেতু তৈরি হতে পারে তাহলে সদিচ্ছা থাকলে এখানেও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করা সম্ভব। টোটোদের বক্তব্য, তাঁদের জনসংখ্যা এতটাই কম যে কখনও বিধায়ক বা সাংসদ হিসাবে তাঁদের নাম বিবেচিত হবে না। বিধানসভায় বা সংসদে তাঁদের হয়ে গলা ফাটানোর লোক থাকবে না। তাই টোটোদের দাবি, রাষ্ট্রপতি মনোনীত করে তাঁদের কাউকে সংসদে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। তাহলেই সেখানে আওয়াজ তুলে উন্নয়নের কাজ তরান্বিত হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন