তৃণমূল কংগ্রেসের ভিডিও সিরিজ 'আউটসাইড পার্লামেন্ট'-এর নবতম এপিসোডে বলা হয়েছে, কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে "হাজার হাজার" চাকরির সংস্থান হয়েছে এবং হচ্ছে।
মুন্নি খাতুন মানেন না সেকথা।
সবে কুড়ি বছরে পা দেওয়া মুন্নির তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী আজ, ২৩ এপ্রিল - তাঁর কেন্দ্র মালদা (দক্ষিণে) ভোটের দিন। এই দিনটি, এবং কোলে একরত্তি শিশু, আজাদ মোমিনের সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবনের স্রেফ এই দুই স্মৃতি অবশিষ্ট আছে। দুমাস আগে উত্তর প্রদেশ থেকে বাড়ি ফেরেন আজাদ, কফিনবন্দি অবস্থায়। ভদোহির এক কার্পেট কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত এই অঞ্চলের ন'জন কর্মীর একজন।
এনায়েতপুরে খেটে খাওয়ার উপায় বড় একটা নেই, যার ফলে কাজের খোঁজে দলে দলে উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, মুম্বই, এমনকি পশ্চিম এশিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান স্থানীয় যুবকরা। গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে রয়েছেন বয়োঃজ্যেষ্ঠ, মহিলা, এবং শিশুরা। যেসব কর্মক্ষম পুরুষ রয়েছেন, তাঁদের কাছে সুযোগ খুব বেশি নেই। বেশিরভাগই হয় আইসক্রিম বেচছেন, বা ছোটখাটো খাওয়ার দোকান চালাচ্ছেন, বা আমের বাগানে কাজ করছেন, দৈনিক ২০০-৩০০ টাকা আয়ের বিনিময়ে।
সীমান্তের কাছে মহদিপুরে উপার্জনের একমাত্র উপায়, বাংলাদেশে পেঁয়াজ এবং পাথরকুচি নিয়ে যাওয়ার শ'দুয়েক ট্রাক।
ত্রিশোর্ধ্ব সামিনুর রহমান এনায়েতপুরে তাঁর সমবয়সী কাউকে খুব একটা পান না। তাঁর কথায়, "এখানে কোনো কাজ নেই। আমি নিজেই কিছুদিন আগে পর্যন্তও সৌদিতে কাজ করছিলাম। তারপর ওরা মাইনে কমিয়ে ৪০ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার করে দিল, তাই ফিরে এলাম। এখনকার মতো কিছু টাকা আছে বাঁঁচানো, কিন্তু শিগগিরই আবার চাকরির খোঁজে বেরোব।"
দারিদ্র্যের চাপে পিষ্ট এই অঞ্চলে কিন্তু সর্বত্রই শিক্ষার অভাব, এমন নয়। মধ্য চল্লিশের তৈরন বেওয়া, ভদোহি বিস্ফোরণে যিনি হারিয়েছেন দুই ছেলেকে, বলেন তাঁর পুত্রবধূ দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন, এবং ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর থেকেই তিনি গ্রামপ্রধানের কাছে চাকরির আবেদন করে যাচ্ছেন। কোনো ফল হয়নি, বরং গোটা পরিবার এখনও তাকিয়ে ওই ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের দিকে, যা দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক কর্মীর জন্য ঘোষণা করা হয়। দুই ছেলের জন্য মোট ৪ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা তৈরনের, কিন্তু একটা ছোট্ট সমস্যা আছে। "টাকাটা ভোটের আগে পাওয়া যাবে না," বলেন তৈরন।
সম্ভবত এই আশায়, এবং "বিজেপির ভয়ে", তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন তৈরন এবং তাঁর প্রতিবেশীরা, যদিও প্রয়াত কংগ্রেস নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ বি এ গণি খান চৌধুরির স্মৃতি বিজড়িত এই কেন্দ্র বরাবরই কংগ্রেসের দুর্গ হিসেবেই পরিচিত। ২০১৪-র নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে চারটি আসন জেতে কংগ্রেস, তার মধ্যে ছিল দুুুুই মালদা (উত্তর এবং দক্ষিণ)। স্কুল থেকে শুরু করে হাসপাতাল বা রাস্তাঘাট, গণি খানের ছাপ এখনও চতুর্দিকে বিদ্যমান।
মালদা দক্ষিণের বর্তমান কংগ্রেস সাংসদ এবং গণি খানের ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরি, যাঁকে স্থানীয় মানুষ আজীবন 'ডালুদা' ডেকে এসেছেন, ফের একবার লড়াইয়ের ময়দানে। মাণিকচকের গাড়িচালক মোয়াক্কিম হোসেনের মন্তব্য, "এসব দিকে গণির নাম লেখা কলাপাতাও ভোটে জিতে যাবে।" নিজের অতীত সম্বন্ধেও এতটাই স্পষ্টবাদী তিনি। "বামফ্রন্টের কর্মী ছিলাম, কিন্তু সেসব এখন শেষ। মার খেয়ে তো লাভ নেই," বলেন বর্তমান এই কংগ্রেস সমর্থক।
তাঁর কথায় মাথা হেলিয়ে সায় দেন গৃহবধূ রেণু সিদ্দিকি, যিনি মজেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীতে। "বোনের উচিত কাজ করছেন উনি। আমার খুব ভালো লাগে ওঁকে," বলেন রেণু।
মালদা উত্তরের বর্তমান সাংসদ তথা গণি খানের ভাগ্নি মৌসম বেনজির নুরের কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে কিছু গাত্রদাহও রয়েছে এলাকায়। এতটাই, যে রায়পুরে প্রচারে গিয়ে অধুনা এই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মৌসম রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা, পানীয় জলের সংকট ইত্যাদি নিয়ে রীতিমতো জনরোষের মুখে পড়েন।
মালদা শহরে কিন্তু ছবিটা পাল্টে যায়। শহুরে ভোটারদের মধ্যে "স্পষ্টবক্তা, সমর্থ" নেতা নরেন্দ্র মোদীর প্রতি সমর্থন যথেষ্ট জোরালো। অনেকের মতেই যিনি ডালুদার বিপরীত মেরুর বাসিন্দা।
"ডালুদার তো মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। কী উন্নয়ন করেছেন উনি? বিজেপির প্রচুর সাপোর্ট এখানে। আমার এক কলিগের পরিবারের অনেকে মিলিটারিতে আছেন, তাঁরা মোদীর খুব প্রশংসা করেন। আমাদের স্কুলের অর্ধেক বিজেপির সমর্থক। আমরা তো ভেবেছিলাম ২০১৪-তেও বিজেপিই জিতবে। কংগ্রেস জেতায় অবাক হয়েছিলাম," বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় শিক্ষক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয় মালদা দক্ষিণের বিজেপি প্রার্থী শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরির প্রচার গাড়ি, যা থেকে বিহারী গানের সুরে তারস্বরে বাজছে বালাকোটে "৩০০ মারী" বিমান হানার গাথা, এবং উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের সাহসিকতার কাহিনি। দেশের এই দরিদ্র, নিরক্ষর, প্রান্তিক এলাকায় নির্বাচনী প্রচারে সেনাবাহিনীর সুনাম ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। কিন্তু জাতীয়তাবাদী প্রচার লোক টানলেও, সবার মনেই আসলে ঘুরছে উন্নয়নের চিন্তা।
পঞ্চাশোর্ধ ওই শিক্ষকের কথায়, "এখানে একটা ইঞ্জজিনিয়ারিং কলেজ আছে, কিন্তু ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট হয় না। নারায়ণপুরে একটা আই-টি হাব হওয়ার কথা, কিন্তু কাজ শুরু হয় নি এখনও..."