/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/01/lead-57.jpg)
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে, ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি। দেশভাগ দেখেছেন আবার এক মিলেনিয়াম থেকে আর এক মিলেনিয়ামে যাত্রার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। মঞ্চ এবং পর্দা-- দুটি মাধ্যমেই তাঁর নিয়মিত কাজে বয়স কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয়, আগামী আরও কয়েকটি প্রজন্মের অভিনেতাদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পেশাগত জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও বহু দেশী-বিদেশী পুরস্কার ও সম্মানে পরিপূর্ণ। তাঁর জন্মদিনে অভিনেতার পেশাগত জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ ৫টি ঘটনা একবার ফিরে দেখা--
ঘোষক সৌমিত্র
অভিনেতা নয়, অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ঘোষক হিসেবেই কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পেশাগত জীবন শুরু বলা যায়। তাঁর জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরের প্রশংসা পেতেন অল্প বয়স থেকেই। তার উপর কলেজ জীবন থেকেই মঞ্চাভিনয়ে হাতেখড়ি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের, যা তাঁর বাচিক দক্ষতা আরও বাড়িয়ে তোলে। অভিনয়ে তাঁর প্রথম গুরু ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী। কিন্তু অভিনেতা হিসেবেই যে জীবনে তিনি এগোতে চান, সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শিশির ভাদুড়ির একটি নাটক দেখার পরে। কিন্তু যদি তাঁর পেশাগত জীবন ধরা যায়, তবে মঞ্চ বা পর্দা কোনওটিই নয়, রেডিওই ছিল তাঁর প্রথম পেশাগত মাধ্যম।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/01/images-5.jpg)
সৌমিত্রকে নাকচ করেছিলেন সত্যজিৎ
১৯৫৬ সালে যখন সত্যজিৎ রায় 'অপরাজিত'-র জন্য নতুন মুখের সন্ধান করছেন, তখনই প্রথম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয় এই বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের। তখন বছর ২০ বয়স অভিনেতার, সদ্য কলেজ পাশ করেছেন। সৌমিত্রকে দেখে অপু হিসেবে পছন্দও হয়ে গিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত সৌমিত্রর কাস্টিং নাকচ করেন তিনি। 'অপরাজিত'-র অপু চরিত্রে তিনি আরও কম বয়সী কাউকে চেয়েছিলেন। তার ২ বছর পরে সত্যজিৎ রায় যখন 'জলসাঘর'-এর শুটিংয়ে ব্যস্ত, তখন ওই শুটিংয়ে একদিন পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে যান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুটিংয়ের ব্রেকে সত্যজিৎ ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেন-- ''এ হল সৌমিত্র। আমার পরের ছবি অপুর সংসার-এ অপু চরিত্রে অভিনয় করছে।'' বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন অভিনেতা কারণ তিনি সেই প্রথম জানতে পারেন যে মনে মনে কাস্টিংটা ঠিক করে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
১৯৬১
এই বছরটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনে একটা মাইলস্টোন বছর। ওই বছরেই মুক্তি পায় তপন সিনহা পরিচালিত ছবি 'ঝিন্দের বন্দী'। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে সৌমিত্রকে প্রথম দর্শক পেয়েছিলেন একটি খল-চরিত্রে। যে অভিনেতা অপু হিসেবে দর্শকের মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন, 'ক্ষুধিত পাষাণ', 'দেবী' অথবা 'সমাপ্তি'-তে যে সুদর্শন নায়ক ঝড় তুলেছেন মহিলা দর্শকের মনে, সেই অভিনেতাকে তপন সিনহা দিলেন একটি নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্র। তখনও বাংলার দর্শকের সাহিত্য পড়ার অভ্যাস ছিল প্রবল। উপন্যাসে ময়ূরবাহনকে একজন অত্যন্ত সুদর্শন ও লম্পট যুবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন শরদিন্দু। এমন একটি চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যে কেউ ভাবতে পারেন, সেটাই ছিল আশ্চর্যের। অভিনেতার পেশাগত জীবনে তাই এই বছরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/01/2-15.jpg)
প্রথম ভারতীয় অভিনেতার ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান
১৯৭০ সালে যখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অভিনেতা সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। এর কারণটি তিনি বিশদে বলেছিলেন আউটলুক পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ে বলেন, ওই সময়ে সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য তেমন কিছুই করছিল না। তাই আলাদা করে একজন ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে ওই পুরস্কার আমি নিতে চাইনি। এর অনেক বছর পরে, ২০০৪ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে পদ্মভূষণ-এ সম্মানিত কর হয়। কিন্তু যা অনেকেরই হয়তো অজানা তা হল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুবার ফ্রান্সের দুটি সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হন।
ক) 'অর্ডার দি আর্ট এ দে লেটার' হল শিল্পীদের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে তিনিই প্রথম এই সম্মানে ভূষিত হন।
খ) 'লিজিয়ঁ অফ অনার' হল ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান, এদেশের ভারতরত্ন-র সমতুল্য। প্রথম ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে ২০১৮ সালে এই সম্মানে ভূষিত হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
১৯৮৬
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বহু চরিত্রকে চিরস্মরণীয় করে গিয়েছেন পর্দায়। তিনি মানেই 'অপু' আবার এখনও তিনি মানেই 'ফেলুদা' বাংলার দর্শকের কাছে। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবির বাইরে এমন দুএকটি ছবি এবং চরিত্র রয়েছে যার সংলাপ অথবা দৃশ্য, বাংলা চলচ্চিত্র জগতে কিংবদন্তি-স্বরূপ হয়ে রয়েছে। তার প্রথমটি অবশ্যই 'কোনি' ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ-- 'ফাইট কোনি ফাইট'। সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ দিতে বাংলার পপুলার কালচারে এখনও এই সংলাপটি ঘুরে ফিরে আসে। আরও একটি সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে ফেরে, যে সংলাপটি তাঁর নয়, কিন্তু ওই সংলাপটি বলা হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রের উদ্দেশে। ছবিতে সেই সংলাপটি যতবার এসেছে, ততবারই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নীরব থেকেছেন আর তাঁর সেই নীরবতা যে কতটা মর্মভেদী, ওই চরিত্রটি যে কতটা অসহায়, যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা কোনওদিনই ভুলতে পারবেন না। ছবির নাম 'আতঙ্ক' এবং সংলাপ-- 'মাস্টারমশায়, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি।' তিনিই বড় অভিনেতা যাঁর অভিনয়ের জন্য সংলাপের প্রয়োজন হয় না! ঘটনাচক্রে ওই দুটি ছবিই মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে।