টেলিভিশন দিয়েই শুরু হয়েছিল ইরফানের জয়যাত্রা, ফিরে দেখা তাঁর ছোটপর্দার কাজ
প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খানের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছিল বলিউড থেকে হলিউডে। এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতার অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল কিন্তু ছোটপর্দা থেকেই।
প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খানের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছিল বলিউড থেকে হলিউডে। এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতার অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল কিন্তু ছোটপর্দা থেকেই।
'ভারত এক খোঁজ' ধারাবাহিকে ইরফান খান। ছবি: ইউটিউব থেকে
এদেশের ও বিদেশের বহু অভিনেতাই তাঁদের অভিনয় জীবন শুরু করেছেন ছোটপর্দা দিয়ে। আশির দশকের শেষ থেকেই ইরফান খান ছোটপর্দায় কাজ শুরু করেন। সেই সময় দূরদর্শন-এর বেশ কিছু যুগান্তকারী প্রযোজনায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা। অভিনয় জীবনের শুরুতেই শ্যাম বেনেগাল, প্রবীণ নিশ্চল, গুলজার-এর মতো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।
Advertisment
১৯৮৫ সালে দূরদর্শন-এর জন্য নির্মিত হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'শ্রীকান্ত', প্রবীণ নিশ্চলের পরিচালনায়। ওই সিরিজে অভয়া-র স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইরফান। সেটিই পর্দায় তাঁর প্রথম কাজ। এনএসডি-র এই ছাত্র যে অত্যন্ত প্রতিভাবান তা সেই সময়ের পরিচালকদের নজর এড়িয়ে যায়নি। তাই এর পরেই শ্যাম বেনেগালের 'ভারত এক খোঁজ'-এ তাঁকে কাস্টিং করা হয় একটি বিশেষ চরিত্রে।
ওই সিরিজে আকবর-এর অংশটিতে মুঘল ঐতিহাসিক-অনুবাদক বাদাউনির ভূমিকায় অভিনয় করেন ইরফান। এই কাজটি তাঁকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল কর্মক্ষেত্রে। সেটা ১৯৮৮ সাল। ইরফানের প্রথম ছবিও ওই বছরেই-- মীরা নায়ার-এর 'সালাম বম্বে'। তখনও বড়পর্দায় ভাল চরিত্র পেতে লড়াই করতে হচ্ছিল তাঁকে।
Advertisment
সেই সময়ে কিন্তু টেলিভিশন তাঁর কাছে অনেক ভাল ভাল কাজ নিয়ে আসে, যার মধ্যে রয়েছে আলি সরদার পরিচালিত 'কহকশাঁ' (১৯৯১), পিরিয়ড সিরিজ 'চাণক্য' (১৯৯২)। পাশাপাশি ছিল 'শেষ প্রশ্ন' (১৯৯৩) বা গুলজার-এর এপিসোডিক সিরিজ 'কিরদার' (১৯৯৩)। বাংলা, হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যিকদের গল্প নিয়ে তৈরি এই সিরিজের ৩টি এপিসোডে অভিনয় করেন ইরফান। কিন্তু যে ধারাবাহিকটি তাঁকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছিল এদেশের অসংখ্য দর্শকের কাছে, সেটি ছিল 'চন্দ্রকান্তা'।
'চন্দ্রকান্তা' ধারাবাহিকে ইরফান খান।
১৯৯৪ সালে একদিকে মুক্তি পেয়েছে ইরফান-অভিনীত মণি কাউলের ইন্দো-জার্মান ছবি 'দ্য ক্লাউড ডোর', যা বহু আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবে উচ্চ প্রশংসিত। আর ওই বছরই ডিডি ন্যাশনাল-এ শুরু হয় ভারতীয় টেলিভিশনের অন্যতম কাল্ট শো-- 'চন্দ্রকান্তা'। এই সিরিজে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন ইরফান। বদ্রিনাথ ও সোমনাথ, যমজ ভাইদের চরিত্রে তাঁর অভিনয় এখনও বহু দর্শকের স্মৃতিতে তাজা।
ইরফানের ছোটপর্দা ও বড়পর্দার কেরিয়ার তখন পাশাপাশি গতি নিতে শুরু করেছিল। 'চন্দ্রকান্তা'-র পরে একদিকে যেমন ছিল ছোটপর্দায় 'দ্য গ্রেট মারাঠা' (১৯৯৪), 'বনেগি আপনি বাত' (১৯৯৫) অথবা 'ডর' (১৯৯৫-৯৬)। তেমনই দেশে ও বিদেশে বড়পর্দায় তাঁর একটি স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি হচ্ছিল। ২০০১ সালের ছবি 'দ্য ওয়ারিয়র' ইরফানের প্রতিভাকে আন্তর্জাতিক স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত করে বলা যায়। আসিফ কাপাডিয়ার এই ছবিটি আলেকজান্ডার কোরদা অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ব্রিটিশ ফিল্ম-এর পুরস্কার পায় বাফতা-য়। এই ছবি পুরোপুরি ইরফানময়।
বলিউডের বোধহয় সেই সময় থেকেই টনক নড়ে। 'কসুর', 'গুনাহ', 'হাসিল'-- বড়পর্দায় চরিত্রাভিনেতা হিসেবে হিন্দি ছবির জগতে তাঁর পথ সুপ্রশস্ত হয়। কিন্তু ১৯৯৯ থেকে ২০০১-- ইরফান তখনও টেলিভিশনের ফিকশনে অভিনয় করছেন। বিশেষ করে অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে 'শশশশ... কোই হ্যায়' ধারাবাহিকের একটি এপিসোডে ওঁর অনবদ্য অভিনয়ের কথা। ২০০৩-এর ছবি বিশাল ভরদ্বাজ-এর 'মকবুল'-কে ইরফানের কেরিয়ারে একটা টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়।
('ভারত এক খোঁজ'-এ ইরফানের অভিনয়ের অংশ দেখে নিতে পারেন নীচের লিঙ্কে)
এর পর থেকেই টেলিভিশনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ক্ষীণ হতে শুরু করে। ২০০৪-এর ছবি 'রোগ' এবং 'চকোলেট' তাঁকে পুরোপুরি মেইনস্ট্রিম বলিউড ছবির স্রোতে মিশিয়ে দেয়। ২০০৪-এর পরে বেশ কিছু টেলিভিশন সিরিজে হোস্ট-এর ভূমিকায় দেখা গিয়েছে ইরফানকে-- 'কেয়া কহেঁ', 'মানো ইয়া না মানো' এবং 'ডন'। তাছাড়া ২০০৯ সালের 'এমটিভি হিরো হন্ডা রোডিজ সেভেন'-এও অংশ নিয়েছিলেন অভিনেতা।
এই সময়ের পরে দুটি টেলি-সিরিজে অভিনয় করেছেন ইরফান যে দুটির কোনওটিই ভারতীয় নয়-- ২০১০ সালে এইচবিও সিরিজ 'ইন ট্রিটমেন্ট' ও ২০১৬ সালের জাপানি মিনিসিরিজ 'টোকিও ট্রায়াল'। যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা নিজেদের অ্যাচিভমেন্ট লেখেন সিভি-তে। আর একজন অভিনেতা তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে রেখে যান অভিনয় জীবনের গ্রাফ। 'শ্রীকান্ত' থেকে 'জুরাসিক ওয়ার্ল্ড' ইরফানের এই যাত্রাই বলে দেয় সব কথা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন