বিধ্বংসী আমফানের দুঃস্বপ্ন থেকে এখনও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি কলকাতা। মধ্যবিত্ত নাগরিকরা একদিকে জল ও বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য এখনও অপেক্ষারত কোনও কোনও জায়গায়, পাশাপাশি ঝড়ের তাণ্ডবে শহরের বহু দরিদ্র মানুষের অস্থায়ী বাসস্থান গিয়েছে। ফুটপথবাসীরা দিশেহারা। শহরের সেই সব সহায়সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়ালেন অভিনেত্রী চৈতী ঘোষাল, পুত্র অমর্ত্য এবং অভিনেত্রীর পুরো পরিবার।
চৈতী ও অমর্ত্য আমফানের তাণ্ডবের পরেই সিদ্ধান্ত নেন যতটা সম্ভব নিজেদের উদ্যোগে তাঁরা অন্তত কিছু মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে খাবার বলতে শুকনো খাবার নয়, রান্না করা পুষ্টিকর খাবার। অভিনেত্রী বিগত দুদিন ধরে শহরের ১০০ জনেরও বেশি মানুষকে রান্না করে খাইয়েছেন। গড়িয়াহাট ফ্লাইওভার, দেশপ্রিয় পার্ক, সাদার্ন অ্যাভিনিউ, টালিগঞ্জ থানা ও রাসবিহারী এলাকায় ঘুরে ঘুরে তাঁরা খাবার অভুক্ত মানুষের হাতে খাবার তুলে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: সত্যজিতের সেট দেখে কখনও সেট বলে মনে হতো না: বরুণ চন্দ
সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন তাঁর এই দুদিনের অভিজ্ঞতা। কতটা অসহায় অবস্থায় কলকাতার এই এলাকাগুলিতে কিছু মানুষ সাহায্যের প্রত্যাশায় বসে রয়েছেন সেই কথাও লিখেছেন তিনি। ''জানতে পারলাম অনেকেই দুদিন ধরে কিছু খেতে পাননি। কেউ হয়তো দুদিনে একবার সামান্য কিছু খেয়েছেন। অনেকেই এই সময়ে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করছেন পাশে থাকার কিন্তু আরও অনেক সাহায্য দরকার'', সোশাল মিডিয়ায় লেখেন অভিনেত্রী, ''আমরা যতদিন পারব এই কাজটা করে যাব। শুধু শহর নয়, আশেপাশের যে গ্রামগুলি ক্ষতিগ্রস্থ, আস্তে আস্তে সেখানেও যাব।''
নিতান্তই ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে এই কাজে হাত দিয়েছেন অভিনেত্রী কিন্তু আগামী দিনে এই কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে আরও অনেক অর্থের প্রয়োজন। তাই সোশাল মিডিয়ায় সব মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যদি কেউ এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে অভিনেত্রী জানালেন, ''আমি আর আমার ছেলে, আমরা দুজনেই অভিনয় করি। অমর্ত্য এখনও পড়াশোনা করছে আর আমি নিজেও যে খুব নিয়মিত অভিনয় করেছি সম্প্রতি তা নয়। এমন নয় যে অনেক টাকা সঞ্চয় রয়েছে। তাই এই কাজটা চালিয়ে নিয়ে যেতে অনেক সাহায্যের প্রয়োজন।''
শুধু বাংলা নয়, সারা দেশ থেকেই মানুষ এগিয়ে এসেছেন। আবার বাংলা বিনোদন জগতের তারকাদের পাশাপাশি অন্যান্য নাগরিকরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের অভিনেতা অমর্ত্য পড়েন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। সেখানকার বন্ধুরাও যেমন এগিয়ে এসেছেন, তেমনই 'ময়দান'-অভিনেতার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন বাংলার বাইরের বিনোদন জগতের অনেকেই। এগিয়ে এসেছেন থিয়েটারের কর্মীরাও। অভিনেত্রীর থিয়েটারের দলের এক সদস্য সুদূর কামারহাটি থেকে দক্ষিণ কলকাতায় বাইক চালিয়ে এসে পৌঁছে দিয়েছেন চাল-ডাল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় রেশন।
''আমরা তো কোনও অরগানাইজেশন নই। তাও চেষ্টা করছি তবে সাধারণ মানুষের থেকে রেসপন্সও খুব ভাল। আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সারা জায়গায় যখন অবিশ্বাস, মানুষ বিশ্বাস করে আমাদের দানসামগ্রী পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সেটা খুব বড় বিষয়'', ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানালেন চৈতী, ''আমি, অমর্ত্য, আমার ভাই ও ভায়ের বউ-- পুরো পরিবার আছে আমার সঙ্গে। আমার কাছে এটা একটা রেভেলেশন-- ক্যানসার পেশেন্টদের জন্য, বন্যাত্রাণে, আর্টিস্টস ফোরামের হয়ে, থিয়েটারের হয়ে শো করেছি, টাকা তুলে দিয়েছি কিন্তু নিজে হাতে রান্না করা, কতটা কী রেশন লাগবে, কত খরচ হবে, তার হিসেব করা-- এই সবকিছু নিজে হাতে করা একটা অন্য অভিজ্ঞতা। আমার একটা ছোট্ট ওপেন কিচেনে যে পঞ্চাশজনের রান্না করে ফেলতে পারব, সেটা ভাবতেই পারিনি। কিন্তু অমর্ত্য আমাকে সাহস দিয়েছে, ও বলল মাম-মাম আমরা ঠিক করে ফেলতে পারব।''
শুধু যে অর্থ প্রয়োজন তা নয়। অনেকে হয়তো এই মুহূর্তে অর্থ সাহায্য করতে পারবেন না। কেউ হয়তো জামাকাপড় দান করতে পারেন, কেউ হয়তো কোনও পরিবারের কিছুদিনের বা একমাসের রেশনের দায়িত্ব নিতে পারেন। তাঁদের কাছেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন চৈতী। তিনি সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন এছাড়াও অনেক মানুষকে পাশে প্রয়োজন রাস্তায় নেমে বা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় পায়ে হেঁটে কাজ করার জন্য। যাঁরা এগিয়ে আসতে চান, তাঁদের জন্য সোশাল মিডিয়া পোস্টেই দেওয়া রয়েছে অমর্ত্য ও চৈতীর সঙ্গে যোগাযোগের উপায়।
তৃতীয়দিনে আরও একটু বেশি মানুষের খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন চৈতী-অমর্ত্য। জানালেন, ফুটপাথবাসী একটি বাচ্চা একটু মাংস খেতে চেয়েছে। ''ওকে বললাম, দাঁড়া আমি তো সবে শুরু করেছি, তোকে নিশ্চয়ই খাওয়াব। গড়িয়াহাট, মুক্তাঙ্গন এই এলাকাগুলোয় গেছি। আজ কালীঘাটের দিকে যাব, আজ একটু বেশিজনের মতো রান্না করতে পেরেছি। অত বড় হাঁড়ি বা বাসন তো ছিল না বাড়িতে। আমার কুক সে-সব জোগাড় করে দিয়েছে। আসলে আর কিছু লাগে না, একটু মনটা দরকার, ইচ্ছেটা দরকার, কাজটা করার জন্য। আমি ভাবতেও পারিনি, প্রথমদিন পঞ্চাশজনের খাবার করতে পারব। আমরা অনেক কিছু ভেবে ফেলি কিন্তু করা হয়ে ওঠে না, সময়টা পেরিয়ে যায়। ছোট করে হলেও শুরু করা উচিত। নাহলে হয়তো শুধুই সরকারি ত্রাণ তহবিলে টাকা পাঠানো ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ওভাবে টাকা পাঠানো আর নিজে হাতে মানুষের জন্য কিছু করার মধ্যে অনেকটা পার্থক্য রয়েছে।''