'বল্লভপুরের রূপকথা' চলছে সগৌরবে। ক্যাপ্টেন অফ দ্য শিপ অনির্বাণ ভট্টাচার্য যত না উচ্ছ্বসিত, ততোধিক উচ্ছ্বাস টিমের সদস্যদের। রিলিজের পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে সেই আনন্দ গুন কয়েক বেড়েছে বই কমেনি। কীভাবে সেই কাজের সুযোগ এসেছিল, পরিচালক অনির্বাণ কতটা কড়া? প্রাক এবং উত্তর রিলিজ পর্ব নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার মুখোমুখি শ্যামল চক্রবর্তী, সত্যম ভট্টাচার্য, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবরাজ ভট্টাচার্যরা।
নায়ক ওরফে ভূপতি রায় সত্যম ভট্টাচার্যের কথায়, "বিশেষ করে হল ভিজিট করার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াতেও মানুষ যেভাবে প্রশংসা করছেন, সেটাও লক্ষণীয়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম খুললেই 'বল্লভপুরের রূপকথা' নিয়ে যে ভাল ভাল কথা হচ্ছে, অনুরাগীরা গুছিয়ে না লিখতে পারলেও তাঁদের যে ভাল লেগেছে ছবিটা, সেটা তাঁদের পোস্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হেন কোনও বাঙালি যেন না থাকেন, যাঁরা বল্লভপুরের রূপকথা মিস করেন।" সুরঙ্গনা বললেন, "সিনেমাটা দেখতে গিয়ে মনে আর পাঁচজন দর্শকদের মতোই হাসি ধরে রাখতে পারিনি। উপভোগ করেছি দর্শক হিসেবেই।"
শ্যামল চক্রবর্তী বললেন, "খুবই ভাল লাগছে সকলে এত প্রশংসা করছে। একটা টিমের খাটনির ফসল সকলের পছন্দ হচ্ছে, এতে টিম মেম্বার হিসেবে আনন্দবোধ করারই কথা। হাততালি দিয়ে বলছে, এধরণের ছবি আরও দেখব। বা প্রশ্ন রাখছেন, এর দ্বিতীয় পর্ব কখন আসবে? এগুলোই বোঝায় যে, ছবির গল্প কিংবা কন্টেন্ট ভাল হলে বাংলা সিনেমার পাশে থাকুন আলাদা করে প্রচার করতে হয় না।"
সত্যমের কথায়, "আমরা অভিনয় করেছি বটে, তবে পোস্ট প্রোডাকশনের পর সিনেমাটা যখন প্রথম দেখি, তখন বিশ্বাস-ই করতে পারিনি যে সিনেমাটা এই জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে। পোস্ট প্রোডাকশন চলাকালীন আমি যখনই জিজ্ঞেস করি, কীরকম চলছে? ও তখনই খুঁতখুঁতে বলছিলেন, ঠিক ভাল লাগছে না..। তবে প্রযোজকরা প্রথম সিনেমাটা দেখে যেদিন প্রশংসা করেছিলেন, সেদিন অনির্বাণদা আমাদের সকলকে খুশি হয়ে মেসেজ করেছিলেন। তবে নিজের ভুলগুলোও ধরেছিলেন অনির্বাণদা। সেটাও জানান যে, পরবর্তী কাজে এগুলো ঠিক করতে হবে। মানুষটা এরকমই।"
অনেকেই 'ভূতের ভবিষ্যতের' সঙ্গে তুলনা টানায়, সত্যম আগেভাগেই বললেন, "ভূত-পুরনো বাড়ি, কমিক এলিমেন্ট.. এসব দেখেই বোধহয় ভূতের ভবিষ্যতের সঙ্গে তুলনা টানছেন মানুষ। এর বাইরে আর কোনও মিল নেই। ১৯৬১ সালে লেখা বাদল সরকারের নাটক অবলম্বনেই আমাদের ছবি তৈরি। আর ভূতের ভবিষ্যৎ অনীক দত্ত তৈরি করেন ২০১২ সালে। তবে অনেকেই বলছেন, ভূতের ভবিষ্যতের পরে এরকম কোনও একটা গা ছমছমে, রহস্য-রোমাঞ্চের ছবির পাশাপাশি দমফাটা হাসিও রয়েছে। ভূতের ভবিষ্যতে একটা পুরনো বাড়িকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, আর আমাদের গল্পে হালদারবাবু পুরনো বাড়িটাকেই রেখে দিতে চাইছেন। দুই সিনেমার চরিত্রদের ক্রাইসিসও আলাদা।"
দেবরাজ ভট্টাচার্য যিনি এই ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন, তিনি বললেন, "ভূতের ভবিষ্যৎ একেবারে সোজাসুজি পলিটিক্যাল। তবে আমাদের সিনেমায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। বাদলবাবুর লেখাতেও সেভাবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল না। আমরা চেয়েছি, নিখাদ মজার একটা সিনেমা তৈরি করতে। যাতে দর্শকরা উপভোগ করতে পারেন।"
আর সেটে ক্যাপ্টেন অফ দ্য শিপ অনির্বাণ ভট্টাচার্য কতটা কড়়া? সেই প্রশ্ন যেতেই দেবরাজের উত্তর,"অনির্বাণ কড়া ঠিক নয়। ওর দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে ভীষণ সচেতন নিজে। সেটে যে খুব একটা গাম্ভীর্য বজায় রাখেন, সেটাও নয়। আমরা বরং উল্টোদিকে শট দেওয়ার সময়ে ওঁর প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। শট দেখে অনির্বাণ যদি হাসেন, তাহলে বুঝে যেতাম যে শট ওকে আছে। খুব পারফেকশনিস্টও। আড্ডাও দেন টিমের সঙ্গে। তবে 'বল্লভপুরের রূপকথা' শুটের সময় আমরা একেবারে সময় পাইনি।"
'স্টার ছাড়া সিনেমা হিট করে না..' এই ত্বত্ত্ব উঠতেই সত্যম, সুরঙ্গনা থেকে দেবরাজ, শ্যামল চক্রবর্তী সকলেই সমস্বরে বলে উঠলেন- "আমাদের সিনেমা হিট করে গেছে। আর এটাই তো এই প্রচলিত ত্বত্ত্বকে খণ্ডায়। কন্টেন্ট ইজ কিং! দেবরাজ-সত্যমের মন্তব্য, আমাদের ছবিতে স্টার নেই কোথায়! ডিরেক্টর সাহেব অনির্বাণ ভট্টাচার্যই তো মূল তারকা।"
পুরনো বাড়িতে রাতে শুট করতে গিয়ে গা ছমছম করেনি? সেই প্রসঙ্গ আসতেই সুরঙ্গনা বললেন, "গ্রিন রুমে আমাদের আড্ডাটা জমত। আমি এবং আমার মায়ের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন ঝুলন ভট্টাচার্য, ওনার সঙ্গে আমি রুম শেয়ার করেছিলাম আউটডোরে। সারাদিনে শুটের ফাঁকে আমরা দুজনেই রাজবাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরে দেখতাম। পুরো রাজবাড়িটাকে এভাবেই এক্সপ্লোর করেছি। ঠিক যে জায়গাগুলিতে আমাদের বলা থাকত- এটা গন্ডগোলের জায়গা। ভুতূড়ে বিষয় থাকতে পারে। অনেকেই বলেছিল, ওদিকটায় যাস না। আমি আর ঝুলনদি ঠিক সেই জায়গাগুলোতেই চলে যেতাম। ভূত কোত্থাও খুঁজে পাইনি। তবে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়েছে।"
পরিচালক অনির্বাণ না অভিনেতা অনির্বাণকে এগিয়ে রাখবে 'বল্লবপুর' টিম? প্রশ্ন উঠতেই ব্যাটন ধরলেন শ্যামল চক্রবর্তী। বললেন, "দুটো কাজ আলাদা। অনির্বাণ যখন পরিচালক তখন নিজের সবটা উজার করে দিয়ে একটা মূর্তি গড়ছে সে। একটা শিল্প তৈরি করছে। আর ও যখন অভিনেতা, তখন আরেকজন শিল্পীর গড়া মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছে।"
এপ্রসঙ্গে দেবরাজ বললেন, "অনির্বাণকে পরিচালক হিসেবে বিচার করার সময় এখনই আসেনি। কাউকে ছোট না করেই বলব, পরিচালক হিসেবে উনি যে ছোটখাট জিনিসগুলো জানেন, সেটা টলিপাড়ার অন্য অনেক পরিচালকই জানেন না। তবে ও যে খুব বড় শিল্পী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।"
প্রসঙ্গত, একমাত্র 'মনোহর' শ্যামল চক্রবর্তীই অডিশন ছাড়া এই সিনেমায় সোজাসুজি সুযোগ পেয়েছেন। বাকি সত্যম, সুরঙ্গমা থেকে দেবরাজ সকলকেই অডিশন দিতে হয়েছে।
সিনেমার নায়ক সত্যম ভট্টাচার্যের এইপ্রথম কাজ নয় অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। 'মন্দার' ওয়েব সিরিজে তিনি ছিলেন অনির্বাণের সহকারী পরিচালক। তবে এই প্রথম তাঁর পরিচালনায় অভিনয় করলেন সত্যম। প্রস্তাবটাও এসেছিল খানিক অন্যভাবেই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে সত্যম জানালেন,"হিন্দি সিনেমার কাজ শেষ করে কলকাতায় ফেরার পরই একদিন হঠাৎ ফোন অনির্বাণদার সহকারী পরিচালকের কাছ থেকে। তোর জন্য একটা দুঃসংবাদ আরেকটা সুখবর আছে। প্রথমটা তুই অনির্বাণকে অ্যাসিস্ট করতে পারবি না পরের প্রজেক্টে। আর দ্বিতীয়টা যে সিনেমাটার কথা বলছি, সেখানে নায়কের চরিত্রে ভাবা হয়েছে। তারপর ৬বার অডিশন দিয়ে আমি সিলেক্ট হই।"
সঞ্জীব চরিত্রে দেবরাজ ভট্টাচার্যের কাস্টিংয়ের নেপথ্যের ঘটনাও বেশ মজার। অভিনেতা তথা 'বল্লভপুরের রূপকথা'র সঙ্গীত পরিচালক বললেন, "সঞ্জীব চরিত্রের প্রস্তাব খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই এসেছিল। একাদেমিতে নাটক দেখে বেরনোর পর চা খেতে খেতে হঠাৎই অনির্বাণদা আমাকে বলেন।"
প্রজেক্টের সব চূড়ান্ত, তখনও নায়িকা ছন্দাকে পাওয়া যায়নি। যে চরিত্রে সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন, তার জন্য ১১-১২জন অডিশন দিয়েছিলেন। অভিনেত্রী বললেন, "আমার কাস্টিং এত অল্প সময়ে হয়েছে যে সেটা উপভোগ করার মতো সময়ও আমি পাইনি। শুটে যাওয়ার একমাস আগে নিশ্চিত হই যে ছন্দার চরিত্রটা আমি করছি। কনফার্মড হওয়ার ১-২দিনের মধ্যেই ওয়ার্কশপ শুরু হয়।" বাকি গল্পটা সকলে প্রেক্ষাগৃহেই দেখতে পাচ্ছেন।