কাল থেকেই ভাবছি, বাপ্পিদা কি ওঁর শেষ ইনস্টাগ্রাম পোস্টে নিজের ভবিতব্যের কথাই লিখেছিলেন- 'ওল্ড ইজ গোল্ড'। সাদা-কালো অতীতের স্মৃতিবন্দি ফ্রেমে সেই তরুণ বাপ্পিদা। আমার গানের কেরিয়ার ওঁর কাছে ঋণী। পরিবারের সদস্যের উর্ধ্বে গিয়েও যদি কেউ থাকে, সেটা বাপ্পিদা। ১৯৯০ সালে ওঁর হাতেই আমার কেরিয়ারের প্রথম গান কম্পোজ করা। সেই সময়ে মুম্বইতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে পকেটে একটা চিঠি। উঠতি প্রতিভা হিসেবে গীতিকার আনন্দ বক্সি সুপারিশ করেছিলেন আমাকে। নিমাই চন্দ্র বোড়ালের প্রপুত্র হওয়ার সুবাদে যদিও গানের চর্চা ছিলই শৈশব থেকে। বক্সিই গাড়িতে করে পেরি ক্রস রোড হয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন বাপ্পিদার বাংলোতে। সেখানেই নব্বইয়ের অন্যতম হিট গান 'চলতে চলতে' গেয়ে শোনালাম আমি। সুর করেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। বাকিটা সবার জানা। 'ইতিহাস' বলতে যা বোঝায় আর কী!
১৯৯২ সালে যখন কলকাতার ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে, জীবন বাজি রেখে মুম্বইতে খালি হাতে গিয়েছিলাম, তখন বাপ্পিদার বাড়িটাই আমার একমাত্র প্রশান্তির জায়গা ছিল। ওঁর বাবা-মা অপরেশ ও বাঁশরি লাহিড়ী, দু'জনেই প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। আমাকে খুব উৎসাহ জোগাতেন। তখন সপ্তাহান্ত মানেই বাপ্পিদার বাড়িতে গানের আসর। আমরা সবাই গাইতাম। মুম্বইতে পরিযায়ী বাঙালি হিসেবে বাপ্পিদার বাড়িতেই প্রায় সার্বজনীন বাঙালি উৎসবগুলো পালিত হত। ওঁর বাড়ির সরস্বতীপুজো কখনো মিস করিনি।
<আরও পড়ুন: ‘মামা’ কিশোর কুমারের সিনেমায় অভিনয়ে হাতেখড়ি, ছবিতে ‘বাপ্পি’কে চিনতে পারছেন?>
হিন্দি গানের পাশাপাশি বাংলা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতেও বাপ্পি লাহিড়ীর করা সুরেই প্রথম গান গেয়েছিলাম। 'রক্তনদীর ধারে' ছবিতে। এরপরই ইলা অরুণের মতো বড়মাপের শিল্পীর সঙ্গে ডুয়েট গাওয়ার সুযোগ করে দেন আমাকে। 'চোলি কে পিছে ক্যায়া হ্যায়' তখন কাল্ট হিট। শুধু তাই নয়, ১৯৯৪ সালে যখন প্রথম হিন্দি সিনেমায় প্লে-ব্যাক গাওয়ার সুযোগ পাই, সেটা ছিল ঋষি কাপুরের 'প্রেম রোগ' ছবি, সেই গানও বাপ্পিদারই কম্পোজ করা। কিন্তু কখনও একমুহূর্তের জন্যও অত বড় স্টার হিসেবে হাবভাব দেখাননি।
অনেকেই হয়তো বাপ্পি লাহিড়ীকে ডিস্কো কিং বলেন, তবে ওঁর সৃষ্টি তার থেকে অনেক এগিয়ে। আসলে সঙ্গীতের পরিবেশেই ওঁর বেড়ে ওঠা। চার বছর বয়স থেকে তবলা বাজিয়ে মা-বাবার অনুষ্ঠানে সঙ্গত দিতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কেও ওঁর জ্ঞান ছিল অগাধ। সঙ্গীত বিষয়টা বাপ্পিদার কাছে এতটাই জলভাতের মতো ছিল যে সব ধরণের গান অনায়াসে ধরে ফেলতেন। ওঁর কাছে সুর-ই ছিল ঈশ্বর। আর বাপ্পিদা গান কারও শুনেই বুঝে যেতেন যে কাকে দিয়ে কোন গান গাওয়ানো যাবে।
পাঁচশোর বেশি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। বিভিন্ন জঁরের গান। আমি জানি না কেন বাপ্পি লাহিড়ী মেলোডিয়াস গানগুলোর কথা সেভাবে উল্লেখ করা হয় না। নব্বইয়ের দশক থেকে টানা ২০০০ অবধি ভার্সেটাইল সব মিউজিক কম্পোজ করেছেন। 'ওগো বধূ সুন্দরী', 'জ্বলতা হ্যায় জিয়া মেরা' দারুণ সব গান। মনে আছে, লতাজি কিংবা আসাজির মতো প্রবাতপ্রতীম গায়িকারাও কতটা শ্রদ্ধা করতেন বাপ্পি লাহিড়ীকে।
বাংলা মাটির গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই 'প্যায়ার বিনা চয়ন কাহা রে'-র মতো কাল্ট হিট গান তৈরি করে ফেলেছিলেন। ওয়ার্ল্ড মিউজিক নিয়েও চর্চা ছিল। ভারতের সঙ্গে ইলেকট্রনিক ডান্স মিউজিক মানে ইডিএম-এর পরিচয় করার নেপথ্যেও বাপ্পি লাহিড়ী রয়েছেন। মনে আছে তানজানিয়াতে যখন ওঁর সঙ্গে ছিলাম, তখন খুব বাড়ির খাবার মিস করছিলাম। উনি আমাকে পোস্ত-ভাত খাইয়েছিলেন। ওঁর গানে আফ্রিকান গানের বিটস, ছন্দের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েও গান কম্পোজ করে ফেলেছেন। এটা অবশ্যই সবার মনে রাখা উচিত যে, বাপ্পি লাহিড়ী কিন্তু কোনও দিন কারও নকল করেননি, বরং বিভিন্ন ধরমের সঙ্গীত শুনে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
<আরও পড়ুন: চালসার শালবাড়িতে এলেই জমত গানের আসর, এমনকী বালিশেও তবলা বাজাতেন বাপ্পি>
এপ্রসঙ্গে গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলব। উনি রসিকতা করে বলতেন, বাপ্পিকে একটা খবররে কাগজ দিয়ে দাও, ওটাকেও গান বানিয়ে ফেলবে। এমনকী, ইইকনিক গিটার বাদক টুবান সূত্রধরও বলেছিলেন, সিনেমার প্রযোজকদের বাপ্পিদা কীভাবে গান বোঝাতেন। যেটা আজ অবধি কেউ করে দেখাতে পারেননি।
শেষবার কথা হয়েছিল যখন উনি আমাকে মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশের স্ত্রী অম্রুতা ফড়নবীশের সঙ্গে ডুয়েটে গণপতি ভজন গাওয়ার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কোনও অহংকার ছিল না। দু'হাত খুলে আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন সবসময়ে। এমনকী কিশোর কুমারের সঙ্গে আমার পরিচয় করাতেও কোনওরকম কুণ্ঠাবোধ করেননি।
(রিঙ্কু ঘোষ-এর কাছে বাপ্পি লাহিড়ীর স্মৃতিচারণায় বাবুল সুপ্রিয়)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন