সাতের দশকে মুম্বইতে পা রাখেন উত্তরবঙ্গের অলোকেশ লাহিড়ী। এমন প্রতিভাকে চিনে নিতে দেরি করেননি জহুরী সিনে-প্রযোজকরা। বয়স তখন উনিশ কি কুড়ি। এক-দু' বছরের মধ্যেই 'নানহা শিকারি', 'চরিত্র', 'বাজার বন্ধ করো, 'এক লড়কি বদনাম সি'র মতো একাধিক হিন্দি সিনেমায় সংগীত পরিচালকের কাজ করে ফেলেন। তবে ইন্ডাস্ট্রির নজরে পড়েন ৭৫-এর 'জখমি' ছবির সুবাদে। তারপর আটের দশকের 'ডিস্কো ডান্সার' সিনেমা দিয়েই মুম্বইতে একসঙ্গে দুই বাঙালির উত্থান- বাপ্পি লাহিড়ী (Bappi Lahiri) ও মিঠুন চক্রবর্তী। জলপাইগুড়ি থেকে ভায়া মুম্বই হয়ে অলোকেশের হলিউড সফর যেন সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই। তবে কয়েক দশক ধরে মুম্বইয়ের বাসিন্দা হলেও বাঙালিয়ানা ভুলতে পারেননি বাপ্পি।
জলপাইগুড়িতে জন্ম হলেও উত্তরবঙ্গের একাধিক জায়গায় তাঁর আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, এমনকী শৈশবে চালসার শালবনিতে তাঁর মামাতো দাদার বন্ধুর বাড়িতেও যাতায়াত ছিল বাপ্পি লাহিড়ীর। ২ বছর বয়স থেকেই বাবা অপরেশ লাহিড়ী ও মা বাঁশরি লাহিড়ীর সঙ্গে ডুয়ার্সের আত্মীয়দের বাড়িতে যেতেন তিনি। মুম্বইয়ে গিয়ে এত নাম-ডাক হওয়ার পরও ভোলেননি নাড়ির টান। তাই তো বছর চারেক আগে ২০১৭ সালে যখন তুতোদাদা ভবতোষ চৌধুরির নাতির পৈতে হয়, সেই অনুষ্ঠানে সোজা মুম্বই থেকে যোগ দিতে এসে পড়েছিলেন। বুধবার সকালে তাঁর প্রয়াণের খবর পেয়েই মামাবাড়ি, মাসির বাড়িতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনরা ভেঙে পড়েছেন।
মুম্বইতে থেকে বাংলাকে কতটা মিস করতেন বাপ্পিদা? দাদা ভবতোষের কথায়, "বাপ্পি ছিলেন মাছ-পাগল মানুষ। মুম্বইতে ভাল মাছ পাওয়া যেত না বলে দুঃখ করতেন। যখনই উত্তরবঙ্গে কোথাও অনুষ্ঠান করতে এসেছেন, কোনওদিন হোটেলে রাত কাটাতেন না। আর এলেই বিভিন্ন মাছের হরেক পদ খাওয়ার আবদার রাখতেন। ইলিশ-চিতল, কাতলা ছিল বরাবরের প্রিয়।"
<আরও পড়ুন: ‘মামা’ কিশোর কুমারের সিনেমায় অভিনয়ে হাতেখড়ি, ছবিতে ‘বাপ্পি’কে চিনতে পারছেন?>
শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্কের সামনে বাপ্পি লাহিড়ীর মাসির বাড়ি। যখনই সেখানে এসেছেন গানের আসর বসেছে। কথাপ্রসঙ্গে আবেগপ্রবণ দাদা জানান, "বাপ্পি আর আমার একসঙ্গেই বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা-দৌড়াদৌড়ি কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে এখন। কিছুদিন আগেও মুম্বইতে যাব বলেছিলাম। কিন্তু অতিমারীর জন্য আটকে গেলাম। আর কোনওদিন এই বাড়িতে আসবে না বাপ্পি…" বলতে বলতে গলা বুজে এল তাঁর।
ছোটবেলায় অনেকটা সময় কাটিয়েছেন মাসি শঙ্করী চৌধুরির শিলিগুড়ির বাড়িতে। এলেই গমগম করত গোটা বাড়ি। এমনকী এই বাড়িতে তাঁর জন্য আলাদা ড্রয়ং রুমও রয়েছে। পরিবার নিয়ে ঘুরতেও এসেছেন কালিম্পং, কার্শিয়াং, মিরিকে। তাঁর মাসির দুই পুত্রবধূ কবিতা ও সুপর্ণার সঙ্গেও গানের আড্ডা দিতেন চুটিয়ে। আজ সেসব স্মৃতি বুকে আঁকড়ে রেখেছে বাপ্পির মাসি শঙ্করী চৌধুরির পরিবার।
৩ বছর বয়স থেকেই তবলা বাজাতেন। সঙ্গীতের প্রতি আনুরাগ্যও তখন থেকেই। তাই তরুণ বয়সে যখন তুতোদাদার বন্ধুর চালসার বাড়িতে যেতেন, তখন আড্ডার মাঝেই বালিশে বসে তবলা বাজাতেন, সেসব স্মৃতিও উঠে এল। আসলে বাঙালি মানেই তো গানবাজনার আড্ডা আর পাতে হরেক মৎস-পদ, সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাপ্পি লাহিড়ী 'ডিস্কো কিং' হয়েও আমৃত্যুকাল বাঙালি হয়েই থেকেছেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন